শেষ পর্যন্ত পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন নকুল লোহার।
মহিষগোট ছাড়িয়ে আন্দাজেই ঢুকে গেছিলাম জঙ্গলের আরও গভীরে। এখানেই কোথায় সেই পরিত্যক্ত এয়ারস্ট্রিপটা আছে না ! কিন্তু পথের থই পেলাম না। জঙ্গল বেশ ঘন। এ দিকে বিকেলও পড়ে এল বলে। শুনেছি, এখানকার এয়ারস্ট্রিপে একটা নজরমিনার আছে। ইচ্ছে ছিল সেই নজরমিনার থেকে সূর্যাস্ত দেখব। কিন্তু গোল বাধল পথ নিয়ে। লালমাটির রাস্তাটা ক্রমশই ভিতরে ঢুকে গেছে। আর জঙ্গলও আরও গভীর হচ্ছে। এখানে আবার মাঝেমাঝেই হাতির হামলা হয়। দলমার দামালরা প্রায়ই হানা দেয় খাবারের সন্ধানে। কিছুটা আতঙ্ক, কিছুটা হতাশা। শেষ পর্যন্ত ফিরে যাওয়াই সাব্যস্ত হল। স্বভাবতই অভিযানের ব্যর্থতায় মন খুব খারাপ।
এখনও তো দিনের আলো কিছুটা আছে। মহিষগোটে ফিরে আরেক বার চেষ্টা করলে হয় না, মনে মনে ভাবছিলাম। কিন্তু সকলের সায় মিলবে তো ?
স্করপিওতে আমরা ক’জন যাত্রা করেছি আরামবাগ থেকে। বাঁকুড়া জেলায় ঢুকে পেরিয়ে এলাম কোতুলপুর, তার পর জয়পুর। জঙ্গলের জন্য বিখ্যাত জয়পুর কত বার পেরিয়ে গেছি বিষ্ণুপুর যাওয়ার সময়। শহর পেরিয়ে বাঁ দিকে কুচিয়াকোল-বৈতল যাওয়ার রাস্তা। সেই রাস্তায় খানিক গিয়ে ডান দিকের লালমাটির পথ ধরলাম। বাঁ দিকে ঢোলসাগর, এক সুবিস্তীর্ণ জলাশয়। তেমন গভীর নয়, তবে এর বিস্তার চমকে দেয়। এই গরমে অবশ্য প্রায় নির্জলা। বর্ষায় বাতাসের জোরে ঢোলসাগরে নাকি ঢেউ ওঠে। আর শীতের শুরুতে এর আরেক রূপ। পরিযায়ী পাখির দল ছেয়ে ফেলে এই ‘সমুদ্র’।
কিছুটা গিয়ে আবার ডান দিকের পথ। ইতিউতি দাঁড়িয়ে রয়েছে শাল গাছ। বন দফতরের সাজানো ‘পিকনিক পার্ক’। সঙ্গে রয়েছে নজরমিনার। আর সেই নজরমিনারের বিভিন্ন তলায় রয়েছে ‘ফিঙে’, ‘দোয়েল’, আর ‘শ্যামা’ — রাত কাটানোর সুবন্দোবস্ত। ‘হোটেল বনলতা’-র পাশ দিয়ে ফের চলে এলাম মূল সড়কে।
এ বার জয়পুরের জঙ্গলে আমাদের হানা। জঙ্গলের সীমানা শুরু হতেই বন দফতরের সাবধানবাণী — ড্রাইভ স্লো, ডিয়ার ক্রসিং, জয়পুর ডিয়ার (চিতল)…। তা হলে জয়পুরের জঙ্গলে চিতল হরিণেরও দেখা মেলে !
একটু এগোতেই পড়ল ক্যানেল। বিষ্ণুপুরগামী সড়ক ছেড়ে আমাদের গাড়ি ঘুরল বাঁ দিকে। ক্যানেলকে ডান দিকে রেখে এগিয়ে চললাম। জঙ্গল চিরে লালমাটির পথ এগিয়ে গেছে। শালগাছগুলো যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে। এখানে জঙ্গল অবশ্য তত ঘন নয়। একটু পরে ক্যানেল পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম বন দফতরের বাসুদেবপুর বিট অফিসে। বিট অফিস ছাড়িয়ে কিছুটা এগোতেই জঙ্গলের মাঝে গ্রাম — মহিষগোট। পথ তিন ভাগ। লাল মাটির তিনটি রাস্তা চলে গেছে তিন দিকে। আমাদের সঙ্গীদের কেউ কেউ আগে এখানে এসেছে। তাদের ভরসাতেই পথ হাতড়ানোর চেষ্টা শুরু হল। শেষ পর্যন্ত তাদেরই নির্দেশিত পথ ধরে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা।
কিন্তু মুখ তুলে চাইলেন ভগবান, থুড়ি নকুল লোহার।
মহিষগোটে পৌছতেই এক যুবক এগিয়ে এলেন গাড়ির দিকে। রাঢ়বাংলার রোদজল খাওয়া পেটাই স্বাস্থ্যের যুবক।
— “আপনারা নিশ্চই সেই ওয়াচটাওয়ারটায় যাবেন ? আমি এখানে আসতেই দেখলাম আপনাদের গাড়িটা ভুল পথে ঢুকে গেল। জানতাম একটু পরে বেরিয়ে আসবেন। তাই এখানে বসেছিলাম।”
পরিচয় দিলেন যুবক — নকুল লোহার, থাকেন এই মহিষগোটেই, অল্পবিস্তর চাষাবাদ করে সংসার চালান।
“পথটা বলে দেবেন ?”
“বলে দেব কেন ? চলুন না আমিও যাই। শহর থেকে এত দূরে এসেছেন। এই জঙ্গল আমার হাতের তালুর মতো চেনা।”
হাতে চাঁদ পেলাম।
স্করপিওর সামনের সিটে নকুলকে বসিয়ে আবার জঙ্গলের অন্দরে। এই জঙ্গলে শালের গাছের পাশাপাশি সেগুনও আছে। চেনা-অচেনা নানা গাছের সমাহার এই জঙ্গলে। নকুলও কিছু চিনিয়ে দিলেন — আমলা, বহেরা, পলাশ, কুসুম, মহুয়া, নিম, আরও কত কী ! বেশ কিছু পাখিও দেখালেন। জঙ্গল যত ঘন হচ্ছে, আলো তত কমছে। দিনাবসানেরও সময় হয়ে এল। তবে চতুর্থ পাণ্ডব আমাদের ভরসা। তাই নিশ্চিন্ত।
পৌঁছে গেলাম ব্রিটিশ আমলের সেই এয়ারস্ট্রিপে। যুদ্ধের সময় জরুরি প্রয়োজনে তৈরি হয়েছিল এই এয়ারস্ট্রিপ। এখন নিঃসঙ্গ। বেশ দীর্ঘ কংক্রিটের এই এয়ারস্ট্রিপ। তবে অনেকটাই ঢেকে গেছে ঝোপঝাড়ে। নকুল নিয়ে চলল ওয়াচটাওয়ারের মাথায়। জঙ্গল এখনও যে কত গভীর তা ওয়াচটাওয়ারে উঠলে বোঝা যায়। গড়বেতা-পিয়ারডোবার দিকটা দেখিয়ে নকুল বুঝিয়ে দিলেন কোন দিক থেকে হাতির হানা হয়। আর কী ভাবে গ্রামবাসীরা সেই হামলা সামলায় তা-ও বলছিলেন।
সূর্য ঘরসংসার গুছিয়ে ফিরে যাওয়ার তোড়জোড় করছে। পশ্চিমে মেঘ জমেছে বেশ। বৃষ্টি নামবে না, আশ্বস্ত করলেন নকুল। জঙ্গলে নানা কিসিমের সবুজ, পশ্চিম আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা। তার মধ্যেই ডুবছে সূর্য। পুব আকাশে অস্তমিত সূর্যের বর্ণচ্ছটা। চরাচর জুড়ে এক অপরূপ বর্ণ-বিন্যাস। নকুল জানিয়ে দিলেন, সূর্যোদয়ও এই ওয়াচটাওয়ার থেকে দারুণ লাগে।
অবশেষে আঁধার ঘনাইল বনে বনে। মহিষগোটে এসে নকুল আমাদের ফেরার পথ ধরিয়ে দিলেন।
কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে গাড়িতে ডানকুনি-সিঙ্গুর-তারকেশ্বর-আরামবাগ-কোতুলপুর হয়ে জয়পুর ঘণ্টা চারেকের জার্নি। কলকাতা/হাওড়া থেকে বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার বাস জয়পুর হয়ে যায়। হাওড়া থেকে ট্রেনে আরামবাগ বা বিষ্ণুপুর গিয়েও বাসে বা গাড়িতে জয়পুর যাওয়া যায়। আরামবাগ ও বিষ্ণুপুর থেকে প্রচুর বাস আছে জয়পুর যাওয়ার। আরামবাগ-বিষ্ণুপুর নতুন রেল সংযোগ তৈরি হচ্ছে। এখন দৈনিক একটি ট্রেন সন্ধ্যায় বিষ্ণুপুর থেকে আধ ঘণ্টারও কম সময়ে জয়পুর আসে। টেরাকোটা স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত বিষ্ণুপুর দেখে সেখানে দু-এক দিন থেকে জয়পুর ঘুরে আসা যায়।
কোথায় থাকবেন
জয়পুরে থাকার সব চেয়ে ভালো জায়গা জঙ্গলের সীমানায় হোটেল বনলতা। যোগাযোগ : ০৩২৪৪-২৪৯২৩৪, ০৯৭৩২১১১৭০৫, ০৯৭৩২১১১৭০৬। ওয়েবসাইট www.hotelbanalata.com ।
আরামবাগ ও বিষ্ণুপুরে অনেক বেসরকারি হোটেল ও লজ আছে। বিষ্ণুপুরে থাকার সব চেয়ে ভালো ব্যবস্থা পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের টুরিস্ট লজ। অনলাইন বুকিং www,wbtdc.com ।
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।