আপনি যদি আপনার পুজো ভ্রমণের প্রথম গন্তব্য পটনা করেন তা হলে পুজোর দু’ সপ্তাহ আগেও পটনার ট্রেনের টিকিট পেয়ে যাবেন। পর্যটন মানচিত্রে কিন্তু আদৌ ফ্যালনা নয় বিহার। তাই পটনা হয়ে আরও জায়গায় যাওয়ার সুলুকসন্ধান দিল খবর অনলাইন। সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল মালদা টাউন, ঘরে ফেরার সুবিধার জন্য।
চলুন বেরিয়ে পড়ি – পটনা-বৈশালী-মুঙ্গের-ভাগলপুর-মালদা
প্রথম দিন থেকে চতুর্থ দিন – দেখুন ‘পুজোয় অদূর ভ্রমণ / ব্রাত্য বিহার ১’
পঞ্চম দিন – চলুন মুঙ্গের। রাত্রিবাস মুঙ্গের।
পটনা থেকে ধরুন সাহেবগঞ্জগামী ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস। পটনা ছাড়ে ভোর ৫.৩৫-এ, জামালপুর পৌঁছয় ৯.৫৫ মিনিটে। জামালপুর থেকে মুঙ্গের ৮ কিমি, পাবেন ডেমু ট্রেন/বাস/গাড়ি/ট্রেকার/অটো।

মুঙ্গেরে কী দেখবেন
মহাভারতের মোদগিরি আজ হয়েছে মুঙ্গের। বিহারের শেষ নবাব মিরকাশিমের রাজধানীও ছিল গঙ্গা তীরবর্তী এই মুঙ্গের। তারই অনেক চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এখানে।
(১) মিরকাশিমের দুর্গ – লোকশ্রুতি এই দুর্গটি নাকি মহাভারতের কালে। ১৯৩৪-এর ভূমিকম্পে বেশ ক্ষতি হয় এই দুর্গের। একেবারে গঙ্গার ধারে অবস্থিত এই দুর্গের চারটি প্রবেশ ফটক ছিল। তিনটি ধ্বংস হয়ে গেলেও ‘লাল দরওয়াজা’ এখনও অটুট। এর স্থাপত্যের সঙ্গে হিন্দু, বৌদ্ধ স্থাপত্যের মিল রয়েছে।
(২) পির শাহ নুফার সমাধি – দুর্গের দক্ষিণ ফটকের কাছে।

(৩) কষ্টহারিণী ঘাট – গঙ্গার এই ঘাটে স্নান করলে আজও কষ্টহরণ হয়। ঘাটের কাছে সীতাচরণ — লোকশ্রুতি, পাথরে সীতার পায়ের চাপ।
(৪) মিরকাশিম টানেল – ঘাটের সামনে।
(৫) শ্রীকৃষ্ণ বাটিকা – বিহারের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিংহের নামে উদ্যান। এখানে মিরকাশিমের দুই পোষ্য গুল আর বাহারের নামে দু’টি স্মারকস্তম্ভ আছে।
(৬) চণ্ডী মন্দির – নেতাজি চক হয়ে গঙ্গাতীরে। সুন্দর মন্দিরে চণ্ডী, কালী ও শিবের বিগ্রহ।

(৭) গোয়েঙ্কা শিবালয় – বিশাল মছলি তালাও-এর মাঝে শিবমন্দির। শহরের সঙ্গে শ্বেতাপাথরের সেতু দিয়ে যুক্ত। মন্দিরকে ঘিরে সুন্দর বাগান।
(৮) সীতাকুণ্ড – ৬ কিমি পুবে। রাম, ভরত ও লক্ষ্মণের নামেও এখানে কুণ্ড রয়েছে। জল ফুটছে বিরামহীন ভাবে। হাত দিলে জ্বালা অনুভব হলেও জ্বলে না।

(৯) খড়গপুর – শহর থেকে ৪৩ কিমি দূরে পাহাড়ে ঘেরা লেক, দুর্গামন্দির ও টিলার টঙে উচ্চেশ্বর শিবমন্দির নিয়ে মনোরম জায়গা।
(১০) জামালপুর – ৮ কিমি দূরে হিরণ্য পাহাড়ের কোলে রেলশহর জামালপুর। দেখে নিন কালীপাহাড় অর্থাৎ পাহাড়শিরে কালী মন্দির।
ষষ্ঠ দিন – গন্তব্য ভাগলপুর। দূরত্ব ৬১ কিমি। জামালপুর থেকে ট্রেনে চলুন। বাসেও যেতে পারেন। রাত্রিবাস।
জামালপুর থেকে ভোর ৫.৫০-এর ট্রেন ভাগলপুর পৌঁছে দেয় ৭.২২-এ। সকাল সাড়ে ৭টার ট্রেন পৌঁছে দেয় সকাল ৯.০৮-এ। এর পর ঘণ্টা তিনেক পরে আবার পর পর ট্রেন। সময় নেয় এক থেকে দেড় ঘণ্টা।
সপ্তম ও অষ্টম দিন – ভাগলপুর ঘোরাঘুরি। রাত্রিবাস।
ভাগলপুরে কী দেখবেন
রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র-বনফুলের স্মৃতিবিজড়িত ভাগলপুর বাংলা সাহিত্যের তীর্থক্ষেত্র।

(১) রবীন্দ্র ভবন – স্টেশন থেকে ৩ কিমি দূরে টিলার টঙে রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত টিলাকুঠিতে।
(২) শরৎচন্দ্রের মাতুলালয় – বাঙালিটোলায় গঙ্গার ধারে।
(৩) বুঢ়ানাথ মন্দির – গঙ্গার ধারে যোগসারে বহু প্রাচীন শিবমন্দির। দুর্গামন্দিরও রয়েছে চত্বরে।
(৪) নাথনগর – ৪ কিমি দূরে জৈনতীর্থ। শান্তিনাথ ও মহাবীরের মন্দির। আরও অনেক জৈন মন্দির। সুন্দর বাগিচায় ২৪ জৈন তীর্থঙ্করের মূর্তি।
(৫) বাসুপুজ স্বামী জৈন মন্দির – সুন্দর শ্বেতপাথরের মন্দির।

(৬) কুপ্পাঘাট – গঙ্গার তীরে মনোরম পরিবেশে কর্ণগড় পর্বতের গুহা ও আশ্রম।
(৭) আজগৈবিনাথ – ২৮ কিমি দূরে সুলতানগঞ্জে গঙ্গার মাঝে শৈলশিখরে শিবের মন্দির। লোহার সেতুতে যুক্ত পার্বতী মন্দির ছাড়াও আরও নানা মন্দির রয়েছে এই চত্বরে। গঙ্গার চড়া পেরিয়ে যাতায়াত। বর্ষায় নৌকায়।
(৮) পাথর কেটে মন্দির, কোলগঞ্জ – সুলতানগঞ্জ থেকে আট কিমি। গুপ্ত আমলের (পঞ্চম-ষষ্ঠ শতক) পাহাড়ের গা কেটে নানা দেবদেবীর মূর্তি। হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধ স্থাপত্য।
(৯) মান্দার হিল – ৫০ কিমি দূরে। ১৫০০ ফুট পাহাড়ে জৈনতীর্থ। জৈন তীর্থঙ্করদের নানা মূর্তি ছাড়াও পাহাড়চুড়োয় আছে ২০ ফুটের বুদ্ধমূর্তি, ৫ ফুটের বিষ্ণু, শাকম্ভরী দেবীর মূর্তি। পাহাড়চুড়ো থেকে চারি দিকের দৃশ্য অপূর্ব সুন্দর।

(১০) বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয় – ৩৮ কিমি দূরে। আট শতকে ধর্মপালের তৈরি। হারানো অতীত রোমন্থন করায়। ১১ শতকে শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর আচার্য ছিলেন। ১৯৬২-তে ২৫০ একর জায়গা জুড়ে আবিষ্কৃত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ। খননে পাওয়া প্রত্নসম্ভার নিয়ে রয়েছে সংগ্রহশালা।
নবম দিন – গন্তব্য মালদা টাউন। রাত্রিবাস।
দশম দিন – দেখুন গৌড় ও পাণ্ডুয়া। রাত্রিবাস মালদা।
ভাগলপুর থেকে বিকেল সাড়ে ৪টের জামালপুর-মালদা টাউন ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ধরে মালদা টাউন আসুন রাত ৯টায়।

কী দেখবেন মালদায়
সারা দিনের জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করে ঘুরে নিলে সুবিধা। সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে পড়ুন।
(১) ১০ কিমি দূরের ৩৩ একর ব্যাপ্ত দিঘির পিয়াস বারি বা পিয়াজবাড়ি দেখুন।
(২) পিয়াস বারির ডাইনে বাঁক খাওয়া গ্রাম্যপথে রামকেলি। তমালতলে শ্রীচৈতন্যের কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন রূপ ও সনাতন গোস্বামী। মন্দিরের আশেপাশে ৮টি কুণ্ড।
(৩) রামকেলি থেকে আধ কিমি দক্ষিণে গৌড়ের বারোদুয়ারি। তার পর একে একে দেখে নিন গৌড়ের বাকি দ্রষ্টব্য বড়োসোনা মসজিদ, দাখিল দরওয়াজা, ফিরোজ মিনার, কদম রসুল মসজিদ, নেক বিবির সমাধি, চিকা মসজিদ, দাতন মসজিদ, হুসেন শাহর তৈরি গুমটি ঘর, লুকোচুরি গেট, বাইশগজী প্রাচীর, রয়্যাল প্যালেস, কোতোয়ালি দরওয়াজা, তাঁতিপাড়া মসজিদ, লোটন মসজিদ, গুণমন্ত মসজিদ প্রভৃতি।

(৪) গৌড় দর্শন সাঙ্গ করে মালদায় ফিরে দুপুরের আহার সেরে দ্রুত বেরিয়ে পড়ুন ১৬ কিমি দূরের পাণ্ডুয়ায়। সেখানে দেখে নিন বড়ী দরগাহ, সালামি দরওয়াজা, ছোটি দরগাহ, একলাখি মসজিদ, কুতবশাহি মসজিদ, আদিনা মসজিদ, সাতাশ ঘরা ইত্যাদি।
একাদশ দিন – ফিরুন ঘরপানে।
কোথায় থাকবেন
পটনা ছাড়া কোথাও বিহার পর্যটনের কোনো হোটেল নেই। মালদা ছাড়া বাকি জায়গাগুলিতে বেসরকারি হোটেলই ভরসা। হোটেল বুকিং-এর বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে বেসরকারি হোটেল পেয়ে যাবেন।
যোগাযোগ করুন বিহার পর্যটনের কলকাতা অফিসে। ঠিকানা- ২৬বি, ক্যামাক স্ট্রিট, দূরভাষ- ২২৮০৩৩০৪।
মালদাতে তো বেসরকারি হোটেল পাবেনই। তা ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের ট্যুরিস্ট লজ। অনলাইন বুকিং-এর জন্য ওয়েবসাইট দেখুন www.wbtdcl.com
কী ভাবে ঘুরবেন
(১) পটনা ও বৈশালীতে ঘোরাঘুরি কী ভাবে করবেন জানতে দেখুন ‘পুজোয় অদূর ভ্রমণ / ব্রাত্য বিহার ১’।
(২) মুঙ্গেরে পৌঁছে স্থানীয় দ্রষ্টব্যগুলো রিকশা চেপে দেখে নিয়ে একটা গাড়ি ভাড়া করে ঘুরে নিন সীতাকুণ্ড আর খড়গপুর।

(৩) ভাগলপুরে চুক্তিতে রিকশা নিয়ে প্রথম দিন স্থানীয় দ্রষ্টব্য দেখে নিন। দ্বিতীয় দিন ঘুরে আসুন বিক্রমশীলা। সকালের দিকে সাহেবগঞ্জ লুপ লাইনের ট্রেন ধরুন। ঘন্টা খানেকের পথ। বিক্রমশীলা হল্ট স্টেশন থেকে টাঙায় চলুন ৫ কিমি। বিকেলের ট্রেন ধরে ভাগলপুর ফিরুন। তৃতীয় দিন চলুন মান্দার হিল। মান্দার হিল ভাগলপুর থেকে ট্রেনে দু’ ঘন্টার পথ। মান্দার হিল স্টেশন থেকে পাহাড়ের পাদদেশ ৫ কিমি। বাস বা গাড়ি ভাড়া করে এলে পাদদেশে পৌঁছে যাওয়া যায়। চতুর্থ দিন সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে আজগৈবিনাথ ও কোলগঞ্জের মন্দির দেখে দুপুরের মধ্যে ফিরে আসুন। বিকেলে মালদা যাওয়ার ট্রেন ধরুন।
মনে রাখবেন
(১) পটনায় কুমরাহরের মিউজিয়াম সোমবার ছাড়া সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা।
(২) পটনা মিউজিয়াম সোমবার ছাড়া সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টে পর্যন্ত খোলা।
(৩) পটনায় সদাকত আশ্রম সোমবার ছাড়া অন্যান্য দিন খোলা। দুপুরের দিকে ঘণ্টা দুই-তিন বন্ধ থাকে। গ্রীষ্ম আর শীতে খোলার সময় কিঞ্চিৎ আলাদা। আগেভাগে জেনে নেবেন।
(৪) ভ্রমণের সময় সংক্ষেপ করতে চাইলে পটনা শহরে দু’ দিন থাকুন। এক দিন পটনা শহর ঘুরে নিন, আরেক দিন বৈশালী। তবে দু’টো দিন পটনা শহরের জন্য রাখলে ধীরেসুস্থে ঘুরতে পারেন।
(৫) বৈশালীতে মিউজিয়াম শুক্রবার ছাড়া ১০টা-৫টা খোলা।
(৬) বিক্রমশীলা হল্ট স্টেশনে নেমে বিকেলে ভাগলপুর ফেরার ট্রেনের সময় জেনে নিতে ভুলবেন না।
আরও পড়ুন পুজোয় অদূর ভ্রমণ / ব্রাত্য বিহার ১

কী ভাবে ফিরবেন
মালদা থেকে ফেরার ট্রেন
(১) ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস –মালদা ছাড়ে ভোর সাড়ে ৪টেয়, হাওড়া পৌঁছোয় সকাল ১১.২৫ মিনিটে।
(২) ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস – মালদা ছাড়ে সকাল ৬.১০, হাওড়া পৌঁছোয় দুপুর ১২.৫০-এ।
(৩) তেভাগা এক্সপ্রেস – বালুরঘাট থেকে আসা এই ট্রেন মালদা ছাড়ে সকাল ৮.১০, কলকাতা স্টেশন পৌঁছয় দুপুর ২.২৫-এ। এই ট্রেন রবিবার চলে না।