শক্তি চৌধুরী
এসপ্ল্যানেড বিধান মার্কেটের উলটো দিকের বাসস্ট্যান্ড থেকে সকাল সাড়ে ছ’টার বাসের টিকিটটায় সিট নম্বর দেখে নিজেকে বেশ নিশ্চিন্ত লাগল, যাক বসতে পাওয়াটা পাকা। কিন্তু এ কী গেরো! বাসে উঠে দেখি আমার জায়গায় পরম নিশ্চিন্তে বসে এক বিহারি দম্পতি গল্পগুজবে মত্ত। মেজাজটা সক্কাল সক্কাল গেল বিগড়ে। “ইয়ে হমারা সিট হায়, আপলোগ সিট ছোড়ো”, যেন মহাত্মা গান্ধী ইংরেজকে ভারত ছাড়তে বলছেন এ রকম একটা সুরে হুঙ্কার ছাড়লাম। আমার মেজাজ দেখে ওঁরা তাড়াতাড়ি সরে পড়লেন। পরে বুঝতে পারলাম ওঁরা বুঝতেই পারেননি যে আগে থেকে টিকিট কাটতে হয়।
এই উপাখ্যানটা না বললেও চলত, কিন্তু বললাম আপনাদের এই ধারণা দেওয়ার জন্য যে গঙ্গাসাগরে যে আপামর জনসাধারণ ভিড় করেন তাঁরা কারা। বিহার, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থানের একেবারে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ এসে জড়ো হন এই গঙ্গাতীরে। কোনো দাবি নেই, কোনো অভিযোগ নেই, কোনো কষ্ট নেই। শুধু একটু পুণ্য কামনা, তা-ও নিজের জন্য নয়, পরিবারের জন্য। ডিজিটাল ইন্ডিয়া থেকে অনেক দূরে চিরাচরিত ভারতীয় সংস্কৃতি ও আবেগকে উপলব্ধি করতে গেলে, ভারতের আসল চেহারাটা বুঝতে গেলে, আসুন কসমোপলিটন কমফর্ট জোন থেকে বেরিয়ে এখানে কয়েকটা ঘণ্টা কাটিয়ে যান।
ওই দেখ কী বলতে কী বলছি? ছিলাম বাসে… চলে গেছি ভারত ভ্রমণে। যাই হোক নিজের সিটে বসে রওনা হলাম গঙ্গাসাগরের উদ্দেশে। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা বাসযাত্রার পর নতুন রাস্তার মোড়ে কন্ডাক্টরের ডাকে সারা দিয়ে বাসের গর্ভ খালি করে আমরা সব্বাই নেমে পড়লাম। এই জায়গাটা লঞ্চঘাট থেকে প্রায় ৪ কিমি দূরে। বাংলার পাবলিক ট্রান্সপোর্টে নবতম সংযোজন সেই টোটো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে লাইন দিয়ে। যাত্রীপিছু ১০ টাকা। সকালে বেরিয়েছেন, সে ভাবে প্রাতরাশ হয়নি … নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে…। আশেপাশের দোকান থেকে কিছু খেয়ে নিন। বিখ্যাত লট এইটে নামার পরেই শুরু হল সত্যিকারের গঙ্গাসাগরযাত্রা। ক্রাউড ম্যানেজমেন্টের জন্য তৈরি বাঁশের ব্যারিকেডের ভিতর দিয়ে প্রায় দু’ কিমি হেঁটে তবে পৌঁছোবেন লঞ্চঘাটে। আপনার সঙ্গে হাঁটবে হাজারে হাজারে মানুষ, মাথায়-পিঠে বোঝা, সঙ্গে হেঁটে চলেছে ছোটোরা। বাংলার মানুষ আপনি, ভিড় দেখার যথেষ্ট অভ্যাস আছে। কিন্তু এ ভিড়ের চরিত্র অন্য। ধুতি, ঘোমটায় ঢাকা শরীরগুলো ভিড়ের তালে পা মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে। প্যান্ট-শার্ট শোভিত বডি স্প্রে-র গন্ধ-মাখা হেডফোনে সজ্জিত লোকগুলো ওখানে সত্যিই বিরল। ব্যারিকেডের পর ব্যারিকেডের বাধা টপকে যখন লঞ্চে উঠলাম সে এক বিরল অভিজ্ঞতা। লঞ্চের মেঝেতে উপস্থিত প্রায় গোটা ভারতবর্ষ। কে নেই সেখানে। বাংলা, বিহার, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা সব্বাই বসে আছে সেখানে। নানা রঙ, নানা পোশাক, নানা মুখ। লক্ষ্য কিন্তু একটাই, গঙ্গাসাগর। লঞ্চ রওনা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমবেত পুরুষদের ‘জয় গঙ্গা মাইয়া কি জয়’ ধ্বনিতে আর নারীদের উলুধ্বনিতে গোটা পরিবেশটা একটা অন্য মাত্রা পেল। মিনিট চল্লিশের যাত্রাপথ জুড়ে জল আর সিগালের ঝাঁক। খোলা আকাশ, আদিগন্ত জলের ঢেউ, লঞ্চের রেলিং-এ হেলান দিয়ে নিজের চোখ দু’টোকে মুক্তি দিন। কারণ ছাড়া সে দৃষ্টিকে হারিয়ে যেতে দিন যত দূর খুশি। এখানে একটা সমস্যার কথা বলি। যদি কপাল মন্দ থাকে, তবে ভাটার কবলে পড়লে কিন্তু এই পরিষেবা কয়েক ঘণ্টা বন্ধও থাকতে পারে। তাই নদীতে একটু সকাল সকাল যাত্রা করাটাই ভালো।
লঞ্চে করে যেখানে পৌঁছোবেন সেই জায়গাটার নাম কচুবেড়িয়া। সাগর জায়গাটা আসলে ৬৫ বর্গ কিমির একটা দ্বীপ। লঞ্চঘাট থেকে সাগর বাসস্ট্যান্ডে যেতে কতটা সময় লাগবে সেটা নির্ভর করে কত নম্বর ঘাটে লঞ্চ লাগানো হল তার উপর। মোটামুটি ১০ থেকে ২০ মিনিটের হাঁটাপথে আপনি পৌঁছোবেন সাগর বাসস্ট্যান্ডে। অসংখ্য বাসের ব্যবস্থা করে প্রশাসন। তবে ভিড়ের কোনো খামতি নেই। একটা বাসে বসার জায়গা না পেলে পরেরটার জন্য অপেক্ষা করুন। বাস কন্ডাক্টরদের কথায় বিভ্রান্ত হবেন না। এখানে যথেষ্ট দ্রুত গতিতে বাস চলে। আশা করা যায় চল্লিশ মিনিটের ভিতর পৌঁছে যাবেন মেলাপ্রাঙ্গণে।
আমার এক ভ্রাতৃসম বন্ধুর তৎপরতায় আগেই থাকার সুবন্দোবস্ত ছিল ভারত সেবাশ্রম সংঘের আশ্রমে। ঘর পেতে কোনো অসুবিধা হল না। ঘড়ি বলছে বেলা ২.৩০। পাকস্থলীর ডাক অনুভব করছি বেশ ভালোই। অতঃপর মহারাজদের আতিথ্য গ্রহণে কোনো বিলম্ব করলাম না।
এর পরেই বেরিয়ে পড়া ভারতের এক ক্ষুদ্র সংস্করণ দেখতে। হাজারে হাজারে মানুষ ঢেউ-এর মতো আছড়ে পড়ছে সাগরের ওই বেলাতটে। যেমন বিশাল মেলাপ্রাঙ্গণ, তেমনই ব্যাপক তার প্রস্তুতি। শয়ে শয়ে স্বেচ্ছাসেবক দিন রাত এক করে খেটে চলেছেন। সাধারণ পুণ্যার্থীদের সঙ্গে আছেন প্রচুর সাধু, সন্ত। ভিড় না বাঁচিয়ে বরং ভিড়ের সঙ্গেই মিশে যান। নানা জায়গার মানুষ তাঁদের নিজেদের মতো করে ‘গঙ্গা মাইয়া’-কে শ্রদ্ধা ও পূজা নিবেদন করছেন। তাদের পদ্ধতি প্রকরণ সব আলাদা কিন্তু লক্ষ্য একই। সুদূর উত্তরাখণ্ডের হিমবাহ থেকে যে গঙ্গার যাত্রা শুরু, এই সাগরদ্বীপে এসে সে মিশে যাছে অনন্ত সাগরে। এত দিন সে ছিল আমার ঘরের মেয়ে, মা, আমাদের সবার সুখ-দুঃখের সাথী। তাই আজ তার মহা মহা অনন্তের সাথে মিলন-মুহূর্তে সব্বাই এসেছে তাকে বিদায় জানাতে। অদ্ভুত একটা তৃপ্তির আবহাওয়া চার দিকে। আশ্রমে আশ্রমে চলছে পূজা, পাঠ, কীর্তন। বাইরে মাইকে বাজছে একটা অদ্ভুত বাঁশির সুর, শেষ বিকেলের রক্তিম সন্ধ্যায় বিদায় নিছেন সূর্যদেব। সব কিছুর মধ্যে থেকেও সব কিছুর ঊর্ধ্বে নিজেকে একটু অন্য ভাবে পেয়ে যেতে পারেন আপনি।
যদিও গঙ্গার পারে প্রচুর আলোর ব্যবস্থা থাকে কিন্তু অন্ধকার নামার পর ওখানে বসে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। চলে আসুন মেলাপ্রাঙ্গণে। পুরো মেলাচত্বরটা পাঁচটি সমান্তরাল রাস্তা দিয়ে ভাগ করা হয়েছে। রাস্তাগুলোর মাঝখানের অংশটাতেই বসে মেলা, প্রচুর দোকান চারদিকে। কী নেই সেখানে। খিদে পেলে নানা রকমের খাবার পাবেন। পঞ্চম রাস্তাটা মূলত ভিআইপি এলাকা। প্রায় সমস্ত সরকারি শিবির এই রাস্তার উপরেই আছে। তবে এই মেলাপ্রাঙ্গণের একটা জিনিস আমাকে ভীষণ স্বস্তি দিয়েছে। তা হল, সব কিছুই এখানে খুব প্রয়োজনমাফিক। দোকানের সাজসজ্জা থেকে দোকানির হাবভাব সব কিছুই আপনার খুব কাছাকাছি। আলাদা আকর্ষণের কোনো রকম প্রচেষ্টা নেই। জানি না, এ পরিবেশ আর কত দিন বজায় থাকবে, গঙ্গাসাগর মেলা আর কত দিন আমার মতো আর পাঁচটা অতি সাধারণের মেলা হয়ে থাকতে পারবে।
সন্ধেবেলার এক বিশেষ আকর্ষণের জায়গা হল কপিল মুনির আশ্রমের আলোকসজ্জা। অত্যাধুনিক ইলেকট্রিক্যাল লাইটের কারিকুরি দেখার মতো। ফেরার পথে আমরা একটা খাবার দোকান থেকে রাত্রের খাবার পর্বটা মিটিয়ে ফেললাম। ফিরে এলাম আশ্রমের ঘরে। সারা দিনের প্রচণ্ড ঘোরাঘুরির ক্লান্তিতে ঘুম আসতে সময় লাগল না। ঘুম ভাঙল ঠিক ভোর চারটেয়। আশ্রমের পূজা-আরতির শব্দে।
ভোর ছ’টার ভিতর নদীর ধারে উপস্থিত হলাম আর অবাক হয়ে দেখলাম, মানুষ ওই প্রচণ্ড ঠান্ডায় কী অনায়াসে নদীর জলে ডুব দিচ্ছেন। রাত ৯টা অবধি লঞ্চ চলে তাই অনেক রাত অবধি লোক আসেন এখানে। সারা রাত অনেকেই খোলা আকাশের তলায় বসে অপেক্ষা করেন কখন ভোর হবে? সূর্য ওঠার মুহূর্তে স্নান করেন। ধন্য মানুষ ধন্য তোমার বিশ্বাস। অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম মানুষের সঙ্গে মানুষের মতো করে। অবশেষে আশ্রমের মহারাজদের ধন্যবাদ দিয়ে ফেরার বাস ধরলাম। কানে বাজতে থাকল সেই বাঁশির সুরটা, চোখে ভাসছিল সেই নিশ্চিন্ত র্নিলিপ্ত মুখগুলো …… “ও দাদা আপনার বেহালা এসে গেছে …নামবেন না…” সহযাত্রীর ডাকে হুঁশ ফিরল। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ৫টা বেজে গেছে। দু’ দিনে বোধহয় প্রথম বার ঘড়ির দিকে তাকালাম। ভাগ্যিস ভদ্রলোক ডাকলেন, না হলে ওই বাঁশির শব্দ যে আমায় আর কতদূর নিয়ে যেত কে জানে।
থাকা ও খাওয়া- এখানে প্রায় সব বড়ো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেরই আশ্রম আছে, চাইলে তাদের সঙ্গে আগে থেকে যোগাযোগ করে থাকার জায়গা ঠিক করে আসুন। হোটেল নামে মাত্র, আর আছে কিছু ব্যবসায়িক সংগঠনের ক্যাম্প। তবে মেলার সময় আগে থেকে জায়গা ঠিক না করে এলে এখানে এসে কিন্তু মুশকিলে পড়বেন। খাবারদাবারের কোনো অভাব নেই। হোটেল আছে অনেক, এ ছাড়াও সব আশ্রমেই প্রায় খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
ছবি: লেখক ও রাজীব বসু
A most wonderful write up with amazing pics. Extremely interesting n informative. Loved immensely the way the places were described.
Thanx tons n tons.