পাপিয়া মিত্র
শুরু করেছিল ‘হৃদয়’, উদ্যাপন শেষ করল ‘ইন্দিরা’। ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার অমোঘ টানে অপেক্ষার একটা বছর গানে গানে কেটে গেল। আজকের প্রতিবেদন সংগীতশিল্পী শ্রীনন্দা মল্লিককে নিয়ে।
ভাবতে অবাক লাগে তেষট্টি বছর আগে একটি বারো বছরের বালিকা ‘দক্ষিণী’তে ক্লাস করতে যেত একা একা! অবাক লাগার আরও এক ঘটনা ঘটল সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রিগুণা সেন মঞ্চে সেই মানুষটি ৭৫ অতিক্রম করে যখন পর পর গেয়ে গেলেন ১১টি গান! কথা, সুর, সাল, তারিখ – ঝরঝরিয়ে বলে যান। এমনই তাঁর মেধা।
কিন্তু কিসের এই আয়োজন? ইন্দিরা শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গে গানে গানে জড়িয়ে আছেন শিল্পী শ্রীনন্দা মল্লিক। শুধু গান? না, তা হয়তো নয়। কারণ ‘ইন্দিরা’ একটি বৃহৎ পরিবার এবং সেই পরিবারের তিনি ‘বড়দি’। সেই ‘বড়দি’র ৭৫তম জন্মজয়ন্তী ও ইন্দিরা পরিবারের সঙ্গে ৫০ বছর শিক্ষকতার সূত্রতায় এক আন্তরিক ভালোবাসার উপহার প্রদান করলেন ছাত্রছাত্রীরা এই আয়োজনের মধ্যে দিয়ে। সূচনাসংগীত ‘প্রথম যুগের উদয় দিগঙ্গনে’ গাইলেন ‘ইন্দিরা’র সদস্যরা। ঠাকুরবাড়ির গানে অন্তিম বর্ষের ছাত্রীরা পরিবেশন করলেন ‘তুমি যে সু্রের আগুন’। এ ছাড়াও পরিবেশিত হল বসুধারা রায়সরকারের কণ্ঠে ‘তোমার সূতায় গেঁথে লব’ (দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর), অন্বেষা সেনগুপ্তের কণ্ঠে ‘ওগো ললনা বলি বলো না’ (সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর), শ্রুতি গোস্বামীর কণ্ঠে ‘আমার ফাগুন শেষের বেলাখানি’ (সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর) ও সমবেত সংগীত ‘ধীরে ধীরে বায়ু বহিতেছে’ (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
বছরখানেক আগে ইন্দুমতী সভাগৃহে বেহালার একটি সংস্থা ‘হৃদয়’ শিল্পীর জীবনের ৭৫তম জন্মদিন উদ্যাপন করেছিল। সম্মাননা জানিয়েছিলেন তাঁর ছাত্রছাত্রীরা রুপোর হারমোনিয়াম ও নানা সামগ্রী দিয়ে। প্রকাশ করেছিল ‘শ্রীনন্দা’ স্মারকগ্রন্থ। সে দিনও পর পর ৮টি গান পরিবেশন করেছিলেন একেবারে খাতা-বই না দেখে। যাঁরা শ্রোতা ছিলেন, সেই শ্রোতাদের বেশ কিছু অংশ এ বারও ত্রিগুণা সেন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সেই হারিয়ে যাওয়া মণিমাণিক্য শিল্পীর কণ্ঠে শোনার জন্য।
গত বছর অনেক নবীন শ্রোতা-দর্শক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

শ্রীনন্দা মল্লিক।
‘হৃদয়’ আয়োজিত অনুষ্ঠানে সে দিনের অতিথিদের বক্তব্য থেকে জানা গিয়েছিল, সংগীতজীবনের পাশাপাশি আরও এক রুচিশীল, সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা, বাইরে কঠিন আবরণের ভিতরে এমন নরম মিষ্টি মনের মানুষটিকে। নানা রঙের গানের ভাণ্ডারী তিনি যে! তাঁর সংগীতজীবনে ছিল না কোনো ফাঁকি, ছিল নিরন্তর গান শোনা ও গান তোলার প্রচেষ্টা। তারই ফলস্বরূপ আমরা পেয়ে যাই ইউটিউব চ্যানেলে তাঁর গানের ভুবন।
রবীন্দ্রনাথ থেকে পুরাতনী, ব্রহ্মসংগীত থেকে ঠাকুরবাড়ির গান, উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার রায়, দুর্গানাথ রায়, রামমোহন রায়, হিমাংশুগীতি, সলিল চৌধুরী-সহ বহু পুরাতন গান শ্রীনন্দা মল্লিকের কণ্ঠস্থ। আর চলনে বলনে মিতভাষী, ঋজু, দীপ্ত ও দৃপ্ত মানুষটির অভিধানে ‘না’ শব্দটি নেই। সে গলার মালা গাঁথা থেকে কেক বানানো, পরমান্ন থেকে কচুরি খাওয়ানো, দৃষ্টি শীতল করা শাড়ি থেকে জুতো ও হাতের ঘড়িটি পর্যন্ত পরিপাটি। আর কলকাতার রাস্তা চেনা। এখান থেকে বোঝা যায় চব্বিশ ঘণ্টা আসলে অনেকটা সময়।
এমন মানুষের সংগীতজীবন জানতে ও জানাতে কার না ভালো লাগে। পিছনে ফিরলে দেখা যায় বাবা ব্রজসুন্দর দাস ছিলেন নাট্যকার, পরিচালক, আবৃত্তিকার, অভিনেতা ও বাংলার শিক্ষক (বড়িশা হাইস্কুল)। মা অমিতা দাস লখনউ মরিস কলেজ অফ মিউজিক থেকে পাশ করেন। বাড়িতে এ হেন সংগীতময় পরিবেশ থাকায় শ্রীনন্দা কিন্তু বালিকাবেলায় কোনো দিন মায়ের কাছে গান শিখতে বসেননি। আর বাবাকে তো অসম্ভব ভয় পেতেন। আর কতটুকুই বা বাড়িতে থাকতেন বাবা ব্রজসুন্দর। গানের প্রতি ঝোঁক, রেডিও, গানের রেকর্ড থেকে গান শুনে শুনে গান তোলার চেষ্টা দেখে ‘দক্ষিণী’র ছাত্র ব্রজসুন্দরবাবু সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিলেন ‘দক্ষিণী’তে। তার পর থেকেই শ্রীনন্দার একার পথ চলা।
বেহালার বকুলতলা থেকে ৭ নম্বর বাসে রাসবিহারী, সেখান থেকে হেঁটে দেশপ্রিয় পার্ক। ফেরাও এক ভাবে। পড়াশোনা সরশুনা গার্লস হাইস্কুল, বড়িশা গার্লস হাইস্কুল ও নিউ আলিপুর কলেজ। বিএসসি পাশ করার পর্বে ভাইবোনের জ্যেষ্ঠ সহোদরার এই ভাবে কেটে যায় ‘দক্ষিণী’র সংগীতশিক্ষা। চতুর্থ বর্ষ থেকে শুভ গুহঠাকুরতার কাছে শেখা। স্পেশাল ক্লাসের পরে ‘দক্ষিণী’র পর্ব শেষ হয়ে যায়।
সময়টা ১৯৭১, ‘দক্ষিণী’র একটা রেডিও প্রোগ্রামে পরিচালক হিসেবে সুভাষ চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় হয় শ্রীনন্দার। সেই সময় থেকে ‘ইন্দিরা’তে ঠাকুরবাড়ির গান শেখার জন্য যাওয়া। প্রথম যে দিন যান সে দিন সুপূর্ণা চৌধুরী ছাড়াও ছিলেন গীতা ঘটক, অরূপরতন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রসূন দাশগুপ্ত, মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়শ্রী রায়রা। যে দিন ‘ইন্দিরা’তে গিয়েছিলেন তাঁর বসার জায়গাটি হয়েছিল সুপূর্ণা চৌধুরীর পাশটিতে। পরবর্তী কালে সেই জায়গার কোনো পরিবর্তন হয়নি। তখন সুপূ্র্ণা চৌধুরীর পরিচয় জানা ছিল না। তাঁর ন’দি ছিলেন ইন্দিরাদেবী চৌধুরানী। তাঁরই নামে নামাঙ্কিত ‘ইন্দিরা’। ক্রমে সুপূর্ণাদির কাছ থেকে নানা ধরনের গল্প শোনা ও ‘ইন্দিরা’কে মনে মনে ভালোবেসে ফেলা।

বাঁ দিক থেকে গৌতম রায় (তবলা), সঞ্চালক ও সদস্য প্রবীর ঘোষ, শ্রীনন্দা মল্লিক, শ্রীনন্দা মুখোপাধ্যায় ও দেবাশিস সাহা (কিবোর্ড)।
১৯৭৪ সালের একটি অনুষ্ঠানের কথা জানিয়েছেন শ্রীনন্দা মল্লিক। ইন্দিরাদেবী চৌধুরানীর জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠান। রবীন্দ্র সদনে তিন দিনের অনুষ্ঠান। প্রথম দিনে ঠাকুরবাড়ির গান ও ব্রহ্মসংগীত। দ্বিতীয় দিন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ও শেষ দিনে ছিল রবীন্দ্রনাথের গান (ইন্দিরাদেবী চৌধুরানীকৃত স্বরলিপি)। সেই অনুষ্ঠানে কে না গান করেছিলেন! শান্তিদেব ঘোষ, ভিভি ওয়াঝেলওয়ার, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্ঘ্য সেন, গীতা ঘটক, প্রসাদ সেন, নীলিমা সেন, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। সুচিত্রা মিত্র তো থাকতেনই। তিনি ‘ইন্দিরা’র প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তখন কতই-বা বয়স শ্রীনন্দার।
‘ইন্দিরা’র কত কালজয়ী অনুষ্ঠানের সাক্ষী এই শ্রীনন্দা মল্লিক। ১৯৭৫-এ হল ‘রবীন্দ্রসংগীতের ত্রিবেণী সঙ্গম’। ১৯৭৬-এ হল ‘একটি রক্তিম মরীচিকা’। শঙ্খ ঘোষ শুধু বিন্যাসেই ছিলেন না, তিনি পাঠও করেছিলেন। পাঠ করেছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, গৌরী ঘোষ ও সুচিত্রা মিত্র। গানে ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রসূন দাশগুপ্ত, অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায় ও অর্ঘ্য সেন প্রমুখ।
শ্রীনন্দা মল্লিক জানালেন আরও কয়েকটি কথা। শঙ্খ ঘোষের বিন্যাসে ও সুভাষ চৌধুরীর পরিচালনায় কত অনবদ্য কাজ হয়েছিল ‘বাসায় ফেরা ডানার শব্দ’। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের বিন্যাসে হয়েছিল ‘যে বাণী ওই ধানের ক্ষেতে’, ‘তুমি উষার সোনার বিন্দু’, সুধীর চক্রবর্তীর ‘দেওয়া নেওয়া ফিরিয়ে দেওয়া’। গেয়েছিলেন সুপূর্ণা চৌধুরী, ঋতু গুহ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কুমকুম চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শ্রীনন্দা মুখোপাধ্যায়। মৃগাঙ্ক সরকার ও শ্রীনন্দা মল্লিক দ্বৈতকণ্ঠে সংগীত পরিবেশন করেন।
সুভাষ চৌধুরী অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে ‘ইন্দিরা’র দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শ্রীনন্দা মল্লিক। ‘ইন্দিরা’ আয়োজিত সাম্প্রতিক অনুষ্ঠানে ইন্দিরার কর্ণধার সুভাষ-কন্যা শ্রীনন্দা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠস্বর তাই ভিজে ওঠে, ‘বাবা বুঝেছিলেন যোগ্য মানুষের কাঁধে দায়িত্ব ভার দিয়ে’ এই লাইনটি উচ্চারণ করার সময়। আজও সমান উৎসাহ নিয়ে গান-পরিবেশ সৃষ্টি করেন প্রতি শুক্রবার, পাঠভবন স্কুলে ইন্দিরার ক্লাসে।

এক সময়ে প্রসূন দাশগুপ্ত শেখাতেন। গান শেখানোর পাশাপাশি সুভাষবাবু তৈরি করছিলেন উত্তরসূরিদের। সংগীতশিল্পী শ্রীনন্দা মল্লিক শিক্ষক ও সকলের ‘বড়দি’। ইন্দিরার প্রশাসনিক কর্তা শিল্পী শ্রীনন্দা মুখোপাধ্যায় ‘ছোড়দি’। এই বড়দি-ছোড়দি আমাদের ‘ইন্দিরা’র সাংস্কৃতিক জগতে অন্য ধারায় প্রবাহিত। এই হাওয়া ১৯৬৫ সালে সুভাষ চৌধুরীর নেতৃত্বে বইতে শুরু করেছিল, যা আজও অব্যাহত।
‘হৃদয়’ আয়োজিত অনুষ্ঠানে শ্রীনন্দা মল্লিক গীত গানের কলি মনে করা যাক – ‘তোমার মন জানি নে’, ‘এসেছে ব্রহ্ম নামের তরণী’, ‘সখী এমনি করে তারও কি কাঁদে প্রাণ’, ‘ওগো ললনা’, ‘রাতের ময়ূর ছড়ালো যে পাখা’, ‘এত সাধিলাম তারে, ভালোবাসিলাম তারে’, ‘ঠিকানা বন্ধু চেয়েছো’। সূচনাসংগীত ছিল ‘মোর সন্ধ্যায় তুমি’। সংগীত পরিবেশন করেছিলেন শাশ্বতী বন্দ্যোপাধ্যায়, স্নিগ্ধদেব সেনগুপ্ত, পারমিতা রায়, সুচরিতা বিশ্বাস ও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। অতিথি আসনে ছিলেন সৌরীন ভট্টাচার্য, শ্রীনন্দা মুখোপাধ্যায়, নন্দিতা চক্রবর্তী ও প্রণব বিশ্বাস।
‘ইন্দিরা’ আয়োজিত সম্মাননা অনুষ্ঠানে শিল্পী শুরু করেন ‘তুমি সুন্দর যৌবনঘন রসময় তব মূর্তি’ খাম্বাজ-বাহার রাগে ষষ্ঠী তালে নিবদ্ধ, পূজা পর্যায়ের গানটি দিয়ে। পরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কেন জাগো নিরানন্দ’ পরিবেশন করেন। এর পরে ডুব দেন সেই সব সোনার দিনের সুরসাগরে। তুলে আনলেন ‘সাঁঝের তারকা আমি’, ‘নাইবা ঘুমালে প্রিয়’, ‘আমায় দোলা দিয়ে যায়’, ‘যদি ভুলে যাবে মোরে’, ‘প্রান্তরের গান আমার’, ‘বলেছিলে তুমি গান শোনাবে’, ‘কি কখন বলে বাঁশি’, ‘নীল আকাশের নীচে পৃথিবী’ ও শেষে ‘ঠিকানা’। শেষ গানে শ্রোতাদের চোখ ভিজে ওঠে শিল্পীর কণ্ঠে ‘বন্ধু বিদায়’ শব্দবন্ধটি শুনে। ‘ইন্দিরা’র পক্ষ থেকে শিল্পীকে প্রদান করা হয় মানপত্র, নানা সময়ের ছবি দিয়ে অ্যালবাম, মিউজিক সিস্টেম ও নানা সামগ্রী।
অনেক নবীন প্রজন্ম ‘ইন্দিরা’তে আসছে। আলাদা অনলাইন ক্লাসে ঠাকুরবাড়ির কোর্স করানো হচ্ছে দক্ষ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে। তাই দীর্ঘ বছর ধরেই যেন শ্রীনন্দা মল্লিক আর ‘ইন্দিরা’ একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। দুটি সম্মাননা সন্ধ্যায় নিবেদনে ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বর্ণকুমারীদেবী, সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হিমাংশু দত্ত, কমল দাশগুপ্ত, প্রণব রায়, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, কে এল সায়গল, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সলিল চৌধুরীর গান।
দু’ দিনের অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন স্বপ্না রায় ও প্রবীর ঘোষ।