শ্রয়ণ সেন ঋভু
বিরাট ভরসা বিরাট। এঁর দিকেই তাকিয়ে গোটা দেশ।
ডিসেম্বর ২০০৬, দিল্লির হয়ে সদ্য রঞ্জি অভিষেক ঘটিয়েছেন ১৮ বছর বয়সি এক কিশোর। কর্ণাটকের বিরুদ্ধে চলছে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। প্রথমে ব্যাট করে দিল্লির ঘাড়ে প্রায় সাড়ে চারশো রানের বোঝা চাপায় কর্ণাটক। দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষ হওয়ার সময় দিল্লির অবস্থা বেশ কাহিল। সামনে ফলো-অনের এবং ম্যাচ হেরে যাওয়ার খাঁড়া। সে দিন খেলা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপরাজিত ছিলেন এই কিশোর। রাতেই তাঁর জীবনে ঘটে গেল মর্মান্তিক এক ঘটনা। এক মাস অসুস্থ থাকার পর মৃত্যু হল তাঁর বাবার। পরের দিন তাঁর টিমমেটরা সবাই যখন ভেবে নিয়েছিলেন তাঁকে ছাড়াই ইনিংসে এগোতে হবে, তখনই ড্রেসিংরুমে আবির্ভাব তাঁর। বন্ধুরা বলেছিলেন ক্রিকেট ম্যাচের থেকে পরিবারের তাঁকে বেশি দরকার, কিন্তু একরোখা এই ছেলেটা মানতে নারাজ। তাঁর সংকল্প, যাঁর অনুপ্রেরণায় এই খেলায় আসা, স্বর্গীয় বাবার জন্যই তাঁকে খেলতে হবে। আর সেটাই হবে বাবার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা। ছেলেটা ব্যাট হাতে নামল। আর যখন আউট হল, দিল্লি তখন ফলো-অন এড়িয়ে ফেলেছে। স্কোরবোর্ডে তাঁর নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে ৯০। আউট হয়ে ফিরেই ছেলেটি চলে গেল শ্মশানে তাঁর বাবার পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মে। সেই ছেলেই আজকের বিরাট কোহলি। ভারতীয় দলের মূল স্তম্ভ।
এমন যাঁর মনের জোর তাঁকে ঠেকায় কে! দেড় বছর পরেই বিরাট ২০০৮-এর অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হলেন। তাঁর নেতৃত্বেই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় ভারত। নেতৃত্ব দেওয়া যে তাঁর সহজাত ক্ষমতা, বিশ্বজয়ের দিন থেকেই ক্রিকেটবিশ্ব বুঝে গেল। কয়েক মাস পরেই সিনিয়র ভারতীয় দলে ডাক পড়ল। কিন্তু পরিবর্ত খেলোয়াড় হিসেবে। সচিন তেন্ডুলকর আর বীরেন্দ্র সহবাগের পরিবর্তে তাঁকে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে এক দিনের সেই সিরিজে খেলানো হয়। একটি অর্ধশতরান-সহ মোটামুটি ভালো রান করলেও সিনিয়র প্লেয়াররা দলে ফিরতেই কোপ পড়ে বিরাটের ওপর। দীর্ঘ এক বছর অপেক্ষার পর যখন সুযোগ এল, দুর্দান্ত ভাবে সদ্ব্যবহার করলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে অপরাজিত ৭৯-এর একটি ইনিংস তাঁকে দিল তাঁর প্রথম ‘ম্যান-অফ-দ্য ম্যাচ’ পুরস্কার। এই ম্যাচে বিরাট সুযোগ পেয়েছিলেন চোটগ্রস্ত যুবরাজের পরিবর্তে। যুবরাজ ফিরে আসতেই আবার কোপ। এই ভাবে নিজের ক্রিকেট কেরিয়ারের প্রথম কয়েকটি সিরিজ তাঁকে চোটগ্রস্ত প্লেয়ারের পরিবর্ত হিসেবে খেলতে হলেও, আস্তে আস্তে নিজের পারফর্ম্যান্সের জোরেই দলে জায়গা পাকা করলেন। ২০১০ সালটি ছিল বিরাটের কেরিয়ারে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বছরটি যখন শেষ হয় বিরাটের এক দিনের কেরিয়ারে তখন এক হাজারের ওপর রান। চারটি শতরানও করে ফেলেছেন কোহলি। ভারতীয়দের মধ্যে ওই বছরে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী। ব্যাটিং অর্ডারে তিন নম্বর জায়গাটিতেও নাম লিখিয়ে ফেলেছেন তিনি, যদিও ২০১১ বিশ্বকাপে তাঁকে চার নম্বরে খেলানো হয়। বিশ্বকাপ ফাইনালে ৩৫ রানের ইনিংসটা বিরাটের জীবনে একটি ল্যান্ডমার্ক। ওই দিন গৌতম গম্ভীরের সঙ্গে তাঁর ৮৩ রানের পার্টনারশিপটাই ছিল ভারতের বিশ্বজয়ের প্রথম ধাপ।
ওই বছর থেকেই এক দিনের ম্যাচে শতরান করা মোটামুটি অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছেন বিরাট। একের পর এক রেকর্ডও ভাঙতে শুরু করেছেন। সচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গেও তাঁর তুলনা টানা শুরু হয়ে গেছে। তাঁর টেকনিকও যথেষ্ট প্রশংসিত। মূলত আক্রমণাত্মক এই ব্যাটসম্যানের বটম হ্যান্ড গ্রিপ আর চটপটে ফুটওয়ার্কই তাঁর সাফল্য পাওয়ার রসদ। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের আরও চোখ টেনেছে বিরাটের ইনিংস সাজানো এবং চাপের মধ্যে থেকে তাঁর ব্যাট থেকে অসাধারণ ইনিংস বের করা, বিশ্বকাপ ফাইনাল যার অন্যতম। বিরাটের শক্তি মিড উইকেট আর কভারের মধ্যবর্তী অঞ্চল। তিনি বলেন যে কভার ড্রাইভই তাঁর প্রিয় শট। অবশ্য ফ্লিকও খেলতে পারেন তিনি অবলীলায়।
২০১১-তে টেস্ট অভিষেক ঘটলেও সে ভাবে কোনও সাফল্য আসেনি তাঁর ব্যাটে। কিন্তু বছর ঘুরতেই টেস্ট ভাগ্য সুপ্রসন্ন হল তাঁর। পেসারদের স্বর্গরাজ্য পার্থে যখন অস্ট্রেলিয়ার পেসারদের দাপটে ভারতীয় ব্যাটিং ব্যর্থ, হাল ধরেন বিরাটই। দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁর ব্যাট থেকে বেরোয় ঝকঝকে ৭৫, যেটা তাঁর টেস্ট কেরিয়ার এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ সুগম করে। ঠিক পরের টেস্টে অ্যাডিলেডে প্রথম শতরান পূর্ণ তাঁর। আড়াই বছর পর এই অ্যাডিলেডেই বিরাট করেন তাঁর টেস্ট কেরিয়ারের সপ্তম শতরান। মাঝের এই আড়াই বছরে বিরাট এক দিনের ক্রিকেটে সেরাদের মধ্যে নাম লিখিয়ে ফেলেছেন। এক দিনের কেরিয়ারে দ্রুততম চার হাজার, পাঁচ হাজার আর ছ’হাজার রানের ক্লাবে নাম লিখিয়েছেন তিনি। (এই মুহূর্তে এই তিনটি রেকর্ডই হাশিম আমলার)। তাঁর ব্যাট থেকে বেরিয়েছে ২১টি শতরান (এই মুহূর্তে তাঁর শতরানের সংখ্যা ২৫)। ধোনি-উত্তর যুগে দলের নেতা যে তিনিই হতে চেলেছেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ইতিমধ্যেই টেস্টে দলের হাল বিরাটের হাতে। আর এক দিনের ম্যাচে আপাতত সহ-অধিনায়ক। কিছু এক দিনের ম্যাচের সিরিজে অধিনায়কত্ব করার অভিজ্ঞতাও হয়েছে। ভারতীয় খেলোয়াড় হিসেবে ২০১২, ২০১৩ আর ২০১৪-তে এক দিনের ম্যাচে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বভাবেও অনেক বেশি পরিণত। আগেকার সেই বদরাগী মেজাজ তাঁর মধ্যে নেই। হয়তো দলে তাঁর দায়িত্ব বেড়ে যাওয়াতেই তাঁর এই পালটে যাওয়া।
ওই অ্যাডিলেড টেস্টেই প্রথম বারের মতো টেস্ট অধিনায়কত্ব করার সুযোগ আসে বিরাটের সামনে। তিনি যে বাড়তি দ্বায়িত্ব নিতে পছন্দ করেন, টেস্টের দু’ইনিংসেই সেঞ্চুরি তাঁর প্রমাণ। দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁর ১৪১ রানের সুবাদে অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ৩৬৪ রানের টার্গেট প্রায় তাড়া করে ফেলেছিল ভারত। মাত্র ৪৮ রানে হারে ভারত। ম্যাচ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে কোহলি বলেন, তিনি সব সময় চাইছিলেন তাঁর দল যেন ডিফেন্সিভ না হয়ে রানটা তাড়া করে কারণ অতিরিক্ত ডিফেন্সিভ হয়ে গেলে উইকেট হারানোর সম্ভাবনা বেশি থাকে। এমন মনোভাব থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় অধিনায়ক কোহলি কেমন হতে চলেছেন। সিরিজের তৃতীয় টেস্টের পরেই ধোনির টেস্ট থেকে আকস্মিক অবসর, পাকাপাকি ভাবে ভারতীয় টেস্ট দলের অধিনায়ক করে দিল বিরাটকে। বিরাট এরই মধ্যে ওই মেলবোর্ন টেস্টে আরেকটা সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন। মিচেল জনসনদের ঠেঙিয়ে করা ১৬৯ এখনও পর্যন্ত টেস্টে তাঁর সেরা ইনিংস। সিডনিতে চতুর্থ টেস্টে স্থায়ী অধিনায়ক হিসেবে অভিষেক হল বিরাটের, আর সেই টেস্ট স্মরণীয় করে রাখতে তাঁর ব্যাট থেকে বেরোল আরও একটা সেঞ্চুরি। বিরাট অস্ট্রেলিয়া সফর শেষ ৬৩৯ রান করে। এক দিনের ম্যাচের সেরা তো তিনি ছিলেনই, এই সিরিজ তাকে টেস্টেও ভবিষ্যতের সেরাদের তালিকায় নিয়ে গেল। টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে খুব অল্প সময়েই শ্রীলঙ্কা আর দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সাফল্য এসেছে। বিরাটের অধিনায়কত্বে গত চার বছরে প্রথম বার কোনও বিদেশের মাটি থেকে টেস্ট সিরিজ জিতে ফিরেছে ভারতীয় দল।
টি-২০ ব্যাটিং-এর সংজ্ঞা বদলে দিয়েছেন বিরাট। হুড়ুমতালেই যে টি-২০ ব্যাটিং হয় না, শিল্পও যে লাগে, ২০১৪’র টি-২০ বিশ্বকাপ থেকে বারবার বোঝাচ্ছেন তিনি। অন্য বিস্ফোরক ব্যাটসম্যানদের মতো শুরুতেই চার-ছক্কা মারার বান্দা তিনি নন। শুরুর দিকে খুচরো রানেই ভরসা। এ বছরের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ায় তিন ম্যাচের টি-২০ সিরিজে রান ছিল যথাক্রমে অপরাজিত ৯০, অপরাজিত ৫৯ আর ৫০। ফেব্রুয়ারিতে এশিয়া কাপে পাকিস্তান ম্যাচে মহম্মদ আমিরকে যে ভাবে সামলেছিলেন, আজকের দিনে একমাত্র তিনি ছাড়া আর কেউ পারতেন কি না সন্দেহ! এই বিশ্বকাপে পাকিস্তান ম্যাচে ব্যাটিং-অযোগ্য পিচে যে ভাবে দলকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছিলেন, সেটা টি-২০ ক্রিকেটে ব্যাটিং-এর নতুন উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতেই পারে। আগের পাকিস্তান ম্যাচ পর্যন্ত এই বছরে ১০টি টি-২০ ইনিংসে ৯০.৮ গড় নিয়ে ৪৫৪ রান করেছেন বিরাট। এখন টি-২০তে ক্রিস গেলের মারমার-কাটকাটের থেকেও বেশি দরকার বিরাটের মতো মাথা ঠাণ্ডা রেখে, শুরুর দিকে এক রান-দু’ রান নিয়ে খারাপ বল দেখে বাউন্ডারিতে পাঠানোর মতো ব্যাটসম্যান।
এই বিরাটের ওপরেই ভরসা করে রয়েছেন আপামর ভারতবাসী। রবিবার অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ জিতে ভারতকে সেমিফাইনালে যেতে হলে এই বিরাট কোহলিকেই ব্যাট হাতে দলের বৈতরণী পার করে দিতে হবে।
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।
kohali ke nie lekha khub valo laglo. eke bare tan tan. ajker din parjonto kohalir achievement gulo . aro kata ki likhte hobe tar jonno prastut thakte hobe