ঢাকা থেকে ফারুক ভূঁইয়া রবিন
পৃথিবীর কিছু কিছু ক্রীড়াঙ্গন থাকে, যেখানে খেলার জন্য মুখিয়ে থাকেন ক্রীড়াবিদেরা। ক্রিকেটের বেলায় যেমন এমন সব স্টেডিয়ামের তালিকায় নির্দ্ধিধায় চলে আসবে ইংল্যান্ডের লর্ডস, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন-সিডনি কিংবা কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সের নাম। এ বার ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে এই ইডেন গার্ডেন্সেই শুরু হচ্ছে বাংলাদেশের সুপার টেন যাত্রা।
এ বারের টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ম্যাচের জন্য যে কয়েকটি স্টেডিয়াম নির্ধারিত রয়েছে, তার প্রতিটির স্বতন্ত্র বিশেষত্ব রয়েছে। গ্রুপ পর্বে (আদতে যেটি বাছাই পর্ব) বাংলাদেশের খেলা ছিল ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম নয়রাভিরাম ক্রীড়াঙ্গন ধরমশালার হিমাচল প্রদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন স্টেডিয়ামে। আর গ্রুপপর্বে প্রত্যাশা অনুযায়ী নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড ও ওমানকে উড়িয়ে দিয়ে সুপার টেনে নাম লেখায় বাংলাদেশ। সুপার টেনে নিজেদের প্রথম ম্যাচ ও শেষ ম্যাচে বাংলাদেশ নামবে কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে, মর্যাদার দিক থেকে যেটি উপমহাদেশের অপ্রতিদ্বন্দ্বী স্টেডিয়াম। টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রাথমিক সূচিতে সুপার টেন পর্বে ইডেন গার্ডেন্সে ৩টি ম্যাচ ছিল (পরে অবশ্য ভারত-পাকিস্তান ম্যাচটিও যুক্ত হয়), এর মধ্যে দু’টিই বাংলাদেশের খেলা। আর সুপার টেনে নিজেদের বাকি দুই ম্যাচে টাইগাররা খেলবে বেঙ্গালুরুর ৪০ হাজার আসনবিশিষ্ট চেন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে, আসন সংখ্যার দিক থেকে যা ভারতের অন্যতম বৃহৎ স্টেডিয়াম। ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে এ স্টেডিয়ামটি পেয়েছে ৩টি ম্যাচ, যার দু’টিই বাংলাদেশের খেলা।
ধরমশালায় গ্রুপ পর্বে খেলার আগে বাংলাদেশের সামনে বেশ কিছু আশঙ্কা ছিল। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচের মাত্র এক দিন আগে এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলে ধরমশালায় বাংলাদেশ দলের পৌঁছানো, অপর্যাপ্ত অনুশীলন, পরিবর্তিত আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পর্যাপ্ত সময় না পাওয়া, সমুদ্রপৃষ্ঠের সাড়ে ৪ হাজার ফুট ওপরের স্টেডিয়ামে খেলা — এ সব বিষয় টাইগার সমর্থকদের কিছুটা হলেও ভাবনায় রেখেছিল। কিন্তু প্রথম পর্বে বাংলাদেশের দলের খেলায় এ সবের ছাপ পড়েনি। বরং ধরমশালার বেশির ভাগ ম্যাচে বৃষ্টির হানা থাকার পরও বাংলাদেশকে বাছাই পর্ব উতরাতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। সহজেই পেয়ে যায় সুপার টেনের টিকিট, যার যাত্রা শুরু হবে কলকাতার ইডেন গার্ডেন্স থেকে।
ক্রিকেট আর ইডেন গার্ডেন্স — একে অপরের সঙ্গে মিশে আছে গলাগলি করে। এক সময় ইডেন গার্ডেন্সে এক সঙ্গে এক লক্ষ লোক খেলা দেখার সুযোগ পেত। যদিও সংস্কারের পর ইডেনের আসনসংখ্যা এখন ৭০ হাজারেরও নীচে নেমে এসেছে। কিন্তু এতে ইডেনের ক্রিকেট-আমেজে আগের তুলনায় মোটেও খামতি পড়েনি। বাংলাদেশের বাইরে ইডেন গার্ডেন্সই ঢাকার সব চেয়ে কাছের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম।
কিন্তু বাস্তবতা হল ইডেন গার্ডেন্সে বাংলাদেশের এ প্রজন্মের কোনও ক্রিকেটারেরই এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা হয়নি। একমাত্র সাকিব আল হাসানের অভিজ্ঞতা আছে এই মাঠে আইপিএল ম্যাচ খেলার। আরও রূঢ় বাস্তবতা হল বাড়ির কাছের ইডেন গার্ডেন্সে টাইগাররা নেমেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রাগৈতিহাসিক আমলে, সেই ১৯৯০ সালে। উপলক্ষ এশিয়া কাপ, প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা। গত দু’ যুগে ইডেনে সেটাই বাংলাদেশের প্রথম, আর আজ অবধি সেটাই শেষ ম্যাচ। সেই ম্যাচে খেলার সময় বাংলাদেশ ছিল আইসিসির সহযোগী সদস্য। এর পর পদ্মা-গঙ্গায় অনেক জল গড়িয়েছে, আইসিসির সহযোগী সদস্য থেকে বাংলাদেশ এখন পূর্ণ সদস্য, এক সময়ের ‘মিনোজ’রা এখন বেশ পরিণত, বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে যে কোনও টিমকে ধসিয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত, সময়ের পরিক্রমায় খেলা হয়ে গেছে ক্রিকেট বিশ্বের নামকরা সব স্টেডিয়ামেই। এমনকী ক্রিকেট-উন্নাসিক অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের বিখ্যাত সব মাঠেও খেলার আমন্ত্রণ পেয়েছে বাংলাদেশ। শুধু ঘরের পাশের ইডেন গার্ডেন্সে নামার সুযোগই দুই যুগ ধরে অধরা।
বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পেছনে সব চেয়ে বেশি অবদান রয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের পরম বন্ধু তখনকার আইসিসি প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়ার। কিন্তু টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার দীর্ঘ ১৫ বছর পর্যন্ত সব চেয়ে কাছের প্রতিবেশী ভারতের কোনও ধরনের আতিথেয়তা পায়নি বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার ১৬ বছরের মাথায় বাংলাদেশ জাতীয় দল যে ভারতে আছে, সেটাও কিন্তু ভারতের আমন্ত্রণে নয়; এটি আসলে ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসির বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট। ঘরের পাশেই ইডেন গার্ডেন্স, সব চেয়ে কাছের প্রতিবেশী ভারত, অথচ সেই সেখানেই বাংলাদেশের আতিথেয়তা মেলে না, এটা নিশ্চয় ক্রিকেটের জন্য ভালো বিজ্ঞাপন নয়।

পাকিস্তানের বিপক্ষে টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সুপার টেনের ম্যাচ দিয়ে এ বার ঘুচতে যাচ্ছে ইডেনে বাংলাদেশের খেলার অপেক্ষার পালা। প্রায় ৭০ হাজার দর্শকের সামনে খেলতে নামা নিশ্চয় অন্য খেলোয়াড়দের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। আর বাংলাদেশের দলের মাঠে নামাও নিশ্চয় ইডেনের দর্শকদের উদ্বেলিত করবে। ইডেনে যখন বাংলাদেশ দল যখন জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইবে, তখন হয়তো ইডেনের গ্যালারিও আবেগে ভাসবে। নাগরিকত্বের দিক থেকে দুই দেশে ভাগ হয়ে থাকলেও রবীন্দ্রনাথ, বাংলা ভাষা আর বাঙালিয়ানা হয়তো এক সুতোয় গেঁথে রাখবে বাংলাদেশের ক্রিকেটার আর ইডেনের দর্শকদের। আতাহার আলী খান যখন ধারাভাষ্যে বসবেন, তখন তার সামনেও নিশ্চয় ২৫ বছর আগের ম্যাচের স্মৃতি স্বমহিমায় ভেসে উঠবে।
আর ক্রিকেটের এমন অভিজাত স্টেডিয়ামে নিজেদের সব টুকু ঢেলে দিতে কোনও খামতি থাকবে না টাইগারদের। দুরন্ত পারফরম্যান্সের সাহায্যে পাকিস্তান বধের মধ্য দিয়ে শুরু হোক বাংলাদেশের সুপার টেন লড়াই। বসন্তের এই দিনে হাওয়া লাগুক টাইগারদের ব্যাটে-বলে। মধুমাসে ক্রিকেটের নন্দন কাননে টাইগাররা সিগ্ধ হোক জয়ের পুষ্পরাজিতে। পাকিস্তান ম্যাচ থেকে পেয়ে যাক টুর্নামেন্টের বাকি পথটুকু লড়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয় রসদ। টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্বপ্নে সলতে আরেকটু জ্বলে উঠুক ইডেন থেকেই।
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।