ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ফাইনাল! সুপার ওভার টাই করে প্রথম বার বিশ্বকাপ ঘরে আনল ক্রিকেটের জনকরা

0

নিউজিল্যান্ড: ২৪১-৮ (নিকোল্‌স ৫৫, ল্যাথাম ৪৭, ওক্স ৩-৩৭) [সুপার ওভার-১৫-০]

ইংল্যান্ড: ২৪১ (স্টোক্স ৮৪ অপরাজিত, বাটলার ৫৯, নিশাম ৩-৪৩) [সুপার ওভার- ১৫-০]

লন্ডন: ক্রিকেটের জনক তারাই। অথচ ক্রিকেটের সেরা মুকুটটি এত দিন পর্যন্ত অধরাই রয়ে গিয়েছিল তাদের। তিন বার ফাইনালে এসেও ব্যর্থ হয়েছিল তারা। অবশেষে সেই অপ্রাপ্তির জ্বালা কাটিয়ে উঠল ইংল্যান্ড ক্রিকেট। ‘হোম অব ক্রিকেট’-এ বিশ্বকাপ ঘরে তুলল মর্গ্যান বাহিনী। আর যাঁর অবদানের জন্য ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ পেল, তিনি বেন স্টোক্স।

কিন্তু ক্রিকেটে সেরা মঞ্চের সেরা ফাইনাল যে এ রকম জায়গায় যাবে কে জানত। শেষমেশ কি না বিশ্বকাপ ফাইনাল টাই হয়ে গেল। আর দু’দলের মধ্যে তফাত গড়ার জন্য দরকার হয়ে পড়ল সুপার ওভার। সুপার ওভারও হল টাই। শেষমেশ বেশি বাউন্ডারি মারার সুবাদে বিশ্বকাপের ট্রফি ঘরে তুলে নিল ইংল্যান্ড। টি২০ ছাড়িয়ে এই প্রথম ৫০ ওভারের মঞ্চে ঢুকে পড়ল সুপার ওভার। ইতিহাসের সেরা বিশ্বকাপ ফাইনালের এটা যে আরও এক বড়ো প্রাপ্তি।

স্কোরবোর্ড সব সময় সত্যি কথা বলে না। কারণ আপনি যদি প্রথম ইনিংসের স্কোরবোর্ডের দিকে তাকান তা হলে দেখবেন ইংল্যান্ডের সব থেকে সফল বোলার ক্রিস ওক্স। কিন্তু ব্রিটিশ বোলারদের মধ্যে যাঁর প্রভাব সব থেকে বেশি ছিল তিনি লিয়াম প্লাঙ্কেট। কারণ মোক্ষম সময়ে তিনটে গুরুত্বপূর্ণ উইকেট তিনি না তুললে, নিউজিল্যান্ডের ইনিংস আরও অনেকটাই যেতে পারত।

লর্ডসের পিচে সবুজ আভা দেখে অনেকের মধ্যেই দোটানা ছিল। টসে জয়ী অধিনায়ককে ঠিক কী করা উচিত। পিচ রিপোর্টের সময়ে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন, টসে জিতে ব্যাটিং নেওয়া ছাড়া অন্য কিছুই ভাবা উচিত নয়। তাঁর যুক্তি, এই ঘাস সাংঘাতিক ঘাতক কিছু নয়। ধীরে ধীরে খেলে প্রথম দশ ওভার সামলে নিলে আর কোনো সমস্যা হবে না। ফাইনালে সব সময় আগে ব্যাট করে স্কোর তুলে নিতে বিপক্ষ চাপে পড়বে বলেও যুক্তি দেন সৌরভ।

তা কেন উইলিয়ামসনও যে সৌরভের মতোই ভাবছিলেন, তা বোঝা গেল ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে তাঁর আত্মবিশ্বাস দেখে। অন্য দিকে মর্গ্যান বললেন, টসে হেরে তিনি খুশি, কারণ তাঁকে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হল না।

সৌরভের কথামতোই কিন্তু নিউজিল্যান্ড ব্যাটিং শুরু করল। দলের দুর্বল জায়গাটি হচ্ছে ওপেনিং জুটি। কারণ মার্টিন গাপ্টিল এবং হেনরি নিকোল্‌স, দুই ওপেনারেরই রান নেই বিশেষ। গাপ্টিল এ দিনও কিছু করতে পারলেন না। তবে শুরুর দিকে বেশি উজ্জ্বল ছিলেন। কিন্তু কুড়ি বল খেলার আগেই প্যাভিলিয়নের পথ দেখেন। এর পর যাবতীয় দায়িত্ব ছিল উইলিয়ামসন এবং নিকোল্‌সের ওপরে।

স্কোরবোর্ড সচল রাখার দায়িত্বটি দুর্দান্ত ভাবে পালন করছিলেন কেন এবং হেনরি। তবে যত ইনিংস এগিয়েছে নিকোল্‌সকে যতটা ছন্দে দেখা গিয়েছে, উইলিয়ামসনকে ততই মনে হয়েছে, তিনি ছন্দ হারাচ্ছেন। এর মধ্যে ভালো ভাবে ১০০ পেরিয়ে গেল দল। কিন্তু তার পর থেকেই হঠাৎ করে ছন্দপতন।

কিউয়ি ব্যাটিংয়ের দুই স্তম্ভকে ভাঙার দায়িত্ব দিলেন প্লাঙ্কেট। উইলিয়ামসন এবং অর্ধশতরান করে আরও জাঁকিয়ে বসা নিকোল্‌স ফিরলেন তাঁরই দৌলতে। একটু পরেই ফিরলেন রস টেলরও। যদিও তাঁর আউট নিয়েও যথেষ্ট প্রশ্নচিহ্ন থেকে যায়। এই যে ধাক্কাটা নিউজিল্যান্ড খেল, আর সে ভাবে সেখান থেকে বেরোতে পারল না।

প্লাঙ্কেট-ওক্স-আর্চার-উড সমৃদ্ধ ইংল্যান্ডের পেস ব্যাটারি নিউজিল্যান্ডের মারকাটারি ব্যাটসম্যানদেরও চাপে রেখে দিল। একমাত্র টম ল্যাথাম রানের গতি বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তাতেও বিশেষ লাভ হয়নি। শেষমেশ নিউজিল্যান্ড যে স্কোরটায় পৌঁছোল, সেটাও ফাইনালের পক্ষে যথেষ্ট ভালোই বলে মত প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞরা।

ভারতের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে ঠিক যে ভাবে বোলিং শুরু করেছিল কিউয়িরা, ফাইনালে তার অনেকটা পুনরাবৃত্তিই দেখা গেল। চাপা বোলিংয়ের জেরে এক দিকে যেমন ইংল্যান্ডের টপ অর্ডারকে হাত খুলতে দেননি বোল্ট-হনরিরা, তেমনই উইকেটও তুলেছেন পটাপট। প্রথমেই ফিরে যান এই বিশ্বকাপে চূড়ান্ত ফর্মে থাকা জেসন রয়। তিন নম্বরে নামা জো রুট, যিনি ইংল্যান্ডের হয়ে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান করেছেন, তাঁকেই আটকে রেখেছিলেন কিউয়ি বোলাররা। ফলে কার্যত ধৈর্যচ্যুতি ঘটে তাঁর এবং উইকেটটি নিউজিল্যান্ডকে দিয়ে আসেন।

আরও পড়ুন এই প্রথমবার একক ভাবে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আয়োজক হতে চলেছে ভারত

এর পর পালা ছিল জনি বেয়ারস্টোর, টুর্নামেন্টে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানসংগ্রহকারী। ১৫ ওভারের মধ্যে তিনিও ফিরলেন। এর বেশ কিছু ওভার পর যখন প্যাভিলিয়নের পথ দেখলেন ওইন মর্গ্যানও, তখন ম্যাচের একটাই ভবিতব্য! তা হল নিউজিল্যান্ডের হাতে ট্রফি।

এর পর যে কাণ্ডটি ঘটবে, সেটা অতি বড়ো ইংল্যান্ড ভক্তও আন্দাজ করতে পারেননি। দুর্দান্ত জুটি তৈরি করে ম্যাচের মোড় পুরোপুরি ঘুরিয়ে দিলেন বেন স্টোক্স এবং জস বাটলার। দাঁত কামড়ে পড়ে থাকলেন ব্যাটিংয়ের পক্ষে কঠিন হয়ে আসা পিচে। সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে বাড়ালেন রানের গতিও।

গত দেড় বছর, খুব অসহায় পরিস্থিতি গিয়েছে স্টোক্সের। ক্রিকেটের বাইরে নানা ঝামেলায় জড়িয়ে কোর্ট-কাছারি-হাজতবাস, কত কিছুই না করতে হয়েছে তাঁকে। নিজের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে দরকার ছিল এমনই এক মঞ্চ। সেই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেই নিজের জাত চেনালেন, এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। আর অন্য দিকে বাটলারও সহজাত দক্ষতায় নিজেদের ইনিংসকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন ঢুকতে শুরু করল ইংল্যান্ডের মধ্যে।

তবুও কিউয়ি ভক্তরা আশা ছাড়েননি। নিজেদের দলের লড়াকু মানসিকতার প্রতি তাঁদের পুরো আস্থা ছিল। ভরসা ছিল শেষ মুহূর্তে আবার নাটকীয় কিছু হবেই। এবং হলও। মোক্ষম সময়ে বাটলারকে ফিরিয়ে দিলেন লকি ফার্গুসন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওক্সের উইকেটও তুলে নিলেন তিনি।

শেষ তিন ওভারে দরকার ৩৪। ক্রিজে তখন স্টোক্স। ইংল্যান্ডের যাবতীয় আশা এবং ভরসা তিনিই। শেষ দু’ওভারে প্রয়োজনীয় রান দাঁড়াল ২৪। প্লাঙ্কেটকে সঙ্গে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাচ্ছেন স্টোক্স। শেষ ওভারে হিসেব গিয়ে দাঁড়াল ১৫। আবার একটা বিশ্বকাপের শেষ ওভার আবার স্টোক্স। ২০১৬ সালে বল হাতে ১৯ রান বাঁচাতে পারেননি, এ বার কি পারবেন ১৫ রান করতে!

শেষ ওভারেই কামাল করলেন স্টোক্স। একটি ছয় এবং ভাগ্যের সাহায্য পেয়ে শেষ ২ বলে হিসেব কমে দাঁড়াল ৩ রানে। আবার ম্যাচের মোড় ঘুরে গেল। শেষ বলে দরকার ছিল ২। স্ট্রাইকে তখন স্টোক্স। বোল্টের বলে এক রান করলেন কিন্তু দ্বিতীয় রান নেওয়ার সঙ্গে বিপরীত ব্যাটসম্যানটি রান আউট হতেই সুপার ওভারে ঢুকে গেল ম্যাচ।

সুপার ওভারে প্রথমে ব্যাট করে ইংল্যান্ড তুলল ১৫। এর পর ইংল্যান্ডের যাবতীয় ভরসা ছিলেন জোফরা আর্চার। বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার কয়েক মাস আগেই যিনি ইংল্যান্ড দলে সুযোগ পেয়েছিলেন।

সাম্প্রতিক ইতিহাসে এমন জমাটি বিশ্বকাপ ফাইনাল হয়নি। সব ম্যাচই হয়েছে একপেশে। এ বারের ফাইনাল যে সে অর্থে অনন্য এবং মানুষের মধ্যে ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ আরও বাড়িয়ে তুলবে তা বলাই বাহুল্য। আর বিশ্বকাপের সেরা মঞ্চে দাঁড়িয়ে ক্রিকেটে সেরা ট্রফিটি তুলে ইতিহাসে ঢুকে পড়লেন ওইন মর্গ্যান। অন্য দিকে ট্র্যাজিক হিরো হিসেবেই থেকে গেলেন কেন উইলিয়ামসন। আবার অপেক্ষা চার বছরের।

বিজ্ঞাপন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.