লর্ডসে কাইল ভিরাইনি জয়সূচক শটটা মারতেই ক্যামেরা তাক করল ব্যালকনিতে বসে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক টেম্বা বাভুমার দিকে। না, বাড়তি কোনো উচ্ছ্বাস নেই তাঁর, অসম্ভব শান্ত মনে বসে আছেন তিনি। গত তিন-চার বছর অযৌক্তিক ভাবে যে একের পর এক টিটকিরি তাঁর দিকে ধেয়ে এসেছে, সে সবের জবাব দেওয়ার সময় তাঁকে এই পরিমাণ শান্ত দেখে খুব অবাক লাগছিল। আজই তো তাঁর দিন, গোটা বিশ্বকে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন।
অবশ্য টেম্বা বাভুমা হয়তো এমনই। বাড়তি উচ্ছ্বাস তিনি দেখান না। চাপের মুখে অসম্ভব শান্ত থাকতে পারেন তিনি।
গত কয়েক বছরে টেম্বা বাভুমাকে বারবার শুনতে হয়েছে তিনি কোটার প্লেয়ার। দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটে কোটাব্যবস্থা রয়ে গিয়েছে বলেই তিনি খেলে চলেছেন! এমনকি তাঁকে এ-ও শুনতে হয়েছে যে, শুধুমাত্র দুর্বল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে খেলার সুযোগ এসেছিল বলেই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে খেলছে দক্ষিণ আফ্রিকা।
একে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ, তার উপর তাঁর উচ্চতা ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি! এই দুইয়ের কারণেই যে তিনি টিটকিরির শিকার, সে তো বলাই বাহুল্য। গত ক্রিকেট বিশ্বকাপে তাঁর ব্যাটে রানের খরার কারণে উপমহাদেশীয় ক্রিকেটভক্তদের টিটকিরির মুখে পড়েন তিনি।
আমরা মুখে যা-ই বলি না কেন, মনের ভেতরে কিন্তু বর্ণবিদ্বেষ পুষে রাখি। তাই তো বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে তোলা টেম্বার বিরুদ্ধে বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য করে গিয়েছি। মার্কো জ্যানসেনের পাশে দাঁড় করিয়ে তাঁর উচ্চতা নিয়ে খিল্লি করেছি। দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক টেম্বা সেবার বিশ্বকাপে রান পাননি। কিন্তু একই ভাবে রান পাননি ইংল্যান্ডের অধিনায়ক জস বাটলারও। অথচ বাটলারের বিরুদ্ধে একটা কথাও বলতে শোনা যায়নি কাউকে।
ওই একই বিশ্বকাপের সূচনাকালে অধিনায়কদের বৈঠকে তাঁর ঘুমিয়ে পড়ার ছবি মিডিয়ায় ছড়াতেই হইচই পড়ে যায়। সেই নিয়ে কম কথা শুনতে হয়নি টেম্বাকে। পরে জানা যায়, তিনি আদৌ ঘুমোননি, মাথা নিচু করে বাকি অধিনায়কদের কথা শুনছিলেন। হলফ করে বলতে পারি, ওখানে টেম্বার বদলে অন্য কোনো অধিনায়ক থাকলে তাঁকে নিয়ে কথাই হত না।
Father's Day came early for Temba Bavuma 🥹🫶#SAvAUS #WTC25 pic.twitter.com/5hy5LBEUIN
— ICC (@ICC) June 14, 2025
অথচ টেম্বার সাফল্যের খতিয়ান আমরা এড়িয়ে গিয়েছি। ২০২৩ বিশ্বকাপের ঠিক আগের সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তাঁর দুর্ধর্ষ ফর্ম নিয়ে কোনো কথা হয়নি অথবা এই বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে তাঁর ধারাবাহিক ভাবে রান পাওয়া নিয়েও কথা হয়নি কোনো। হয়তো আমরা ইচ্ছাকৃত ভাবে সে-ই নিয়ে আলোচনা করিনি, কিংবা আমরা মরশুমি দর্শক, তাই এই সাফল্যগুলো আমাদের চোখে পড়েনি।
টেম্বা আর কী করেছেন জানেন? বর্ণবিদ্বেষের তর্কে সবসময় দ্বিধাবিভক্ত একটা দেশকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছেন। ২০২১ সালে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ প্রতিবাদে যোগ না নিয়ে আচমকা একটা ম্যাচ না খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটার কুইন্টন ডি কক। টেম্বা সেই ডি ককের সঙ্গে কথা বলে তাঁকে দলে ফিরিয়ে এনেছিলেন। টেম্বার কাছে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ বিভাজন কোনো বিষয় নয়। দলের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে তিনি সেরা দলই নামাবেন।
তাই তো টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি কৃষ্ণাঙ্গ টনি দে জর্জিকে দলের বাইরে বসিয়ে রেখেছেন, পরিবর্তে খেলিয়েছেন শ্বেতাঙ্গ রায়ান রিকেলটন, ডেভিড বেনিংহ্যাম, ট্রিস্টান স্টাবসদের।
শুধু শ্বেতাঙ্গদের খেলানোই নয়, সামনে থেকে কী ভাবে নেতৃত্ব দিতে হয় সেটা দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি। হ্যামস্ট্রিং-এ টান উপেক্ষা করেই চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করে গিয়েছেন তিনি। এইডেন মার্করামের সঙ্গে বিশাল পার্টনারশিপ গড়ে দক্ষিণ আফ্রিকার জয়ের ভিত গড়ে দিয়েছেন তিনি।
তিনি এমন এক অধিনায়ক, যাঁর জন্য গোটা দল জান লড়িয়ে দিয়েছেন। তাই তো ম্যাচের সেরা পুরস্কার নিতে এসে মার্করাম অবলীলায় বলে দেন, “উই ডিড ইট ফর টেম্বা!”
দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের পরিস্থিতি আজও পুরোপুরি বদলায়নি। দেশের কৃষ্ণাঙ্গদের ৬৪ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করেন, যেখানে মাত্র ১ শতাংশ শ্বেতাঙ্গর দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস। কেপটাউনের মতো শহরে আজও অধিকাংশ কৃষ্ণাঙ্গকে থাকতে হয় বস্তি অঞ্চলে, যেখানে শ্বেতাঙ্গরা থাকেন বড়ো বড়ো অট্টালিকায়। এখনও মার্ক বাউচার আর জাক কালিসদের বিরুদ্ধে বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য করার অভিযোগ ওঠে।
এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে টেম্বা বাভুমা শুধুই কোনো ক্রিকেটার হিসেবে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন না, তিনি শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে শোষিত শ্রেণির লড়াইয়ের প্রতীক, তিনি দুনিয়ার যে কোনো প্রান্তে যে কোনো ধরনের সংখ্যালঘুর লড়াইয়ের প্রতীক। তিনি ‘অধিকার রক্ষার প্রখর দাবি’র প্রতীক।
টেম্বা আপনাকে অভিনন্দন। আপনার বিরুদ্ধে কথা বলা সবার মুখ আপনি বন্ধ করে দিয়েছেন। তবুও নিশ্চিত নই সব কথাবার্তা পুরোপুরি বন্ধ হল কি না!
কারণ ওই যে বললাম, আমরা মনের ভেতর বর্ণবিদ্বেষ পুষে রাখি। আপনার একটা ব্যর্থতা আসুক, আবার আমরা আপনার পেছনে লাগতে শুরু করব।
তবে আমি নিশ্চিত, আমরা যতবারই আপনার পেছনে লাগব, আপনি ততবারই সেগুলো হুক করে বাউন্ডারি লাইনের বাইরে পাঠিয়ে দেবেন।