
অরুণাভ গুপ্ত
ঘটনা-প্রবাহ, আদি-অন্ত
নিউজ। নর্থ, ইস্ট, ওয়েস্ট, সাউথ। সব দিক সবখানে শুধু তুমি, শুধু তুমি। আজ তোমার শোনার দিন, কত ভাবে যে সাজবে, কত ভাবে যে সাজাবে যতনে, ইয়ত্তা নেই। তবে আমরা ভারতীয়রা জনে জনে তুমি ও তোমার দেশ ব্রাজিলের নেশায় নেশাগ্রস্ত, মাতাল — ব্রাজিল বলে হাঁক পাড়লেই হাওয়ায় উত্তর ভেসে আসে – এই যে হেথায়, মাঠে-ময়দানে ফুটবল আর ফুটবল, আমরা বাঙালিরা ওই একই আবেগে রক্তাক্ত। জল, কাদা, ঘাম, হাসি-কান্নার ‘পেলে’ আমাদেরও, খেলাতেও, না-খেলাতেও। ‘হয়তো তোমারই জন্য, হয়েছি প্রেমে যে বন্য, শুরু থেকে শেষ প্রান্তে ছুটে ছুটে গেছি তাই…’। আসলে পেলে নামেই যে খোদাই করা রয়েছে ‘আমি যে দুরন্ত, দু’চোখে অনন্ত…’।
২৩ অক্টোবর ১৯৪০, কুচকুচে কালো ছেলে জন্মালো। বাড়িতে আনন্দের ঢেউ, কিন্তু সব আনন্দকে ছাপিয়ে গেল বাবা ডোনডিনহো-র বল্গাছেঁড়া আনন্দ। চোখের সামনে একের পর এক অতীতের বিবর্ণ ছবি স্লাইড হয়ে চলে যাচ্ছে। যেখানে ডোনডিনহো নিজেই জাতীয় দলের জার্সি গায়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন, স্বপ্নে বিভোর থাকতেন, অথচ চোটের কারণে স্বপ্ন অধরা থেকে গেছে, সেই তিনি ছেলে জন্মাতেই বাসি স্বপ্নটাকে ফের সজীব ও বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য সেই মুহূর্তেই মনস্থির করে ফেললেন। যার নায়ক তাঁর চোখের সামনে হাত-পা ছুড়ে মাথা নাড়াচ্ছে। ইয়েস, নিজের অপূর্ণ সাধ ছেলেকে দিয়েই পূরণ করতে হবে। পৃথিবীর সব কোনায় ছেলের নাম উচ্চারিত হবে।
পায়ে পায়ে-১
পেল্লায় নাম এডসন অ্যারেন্টস ডু নাসিমেন্টো। নাম বলতে দু’-চারটে দাঁত খসে যাওয়ার জোগাড়। তাই এক দল ডাকে ডিকো তো অন্য দল সাসি। খেলার সঙ্গী বলতে বাবা, তাও হাতে গোনা ছুটিছাটার দিন। ওতে কি আর মন ভরে। তবে ছোট্টখাট্টো আয়তনের শহর টেসকোরাস ব্রাজিলের অন্য সব সাইজের শহরের মতন ফুটবল টেম্পারেচর টংয়ে, তাই ফুটবলের বন্ধু পাবে না হয় না কি!
ডিকোর রবারের বলই একমাত্র সম্বল। কিছু করার নেই যেখানে বাস সেখানকার বেশির ভাগ মানুষের আর্থিক অবস্থা নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, তাতে অবশ্য ফুটবল উৎসাহে বা চিল্লানোয় কমতি নেই, থেকে থেকেই ডিকোর উদ্দেশে গলা ফাটানো- ‘দোনো দা, বোলাপারা এ নোসসা পেলেদা…’ পর্তুগিজ আমদানি হলেও ব্রাজিল লুফে নিয়েছে। যার অর্থ হলো, আমাদের বলের মালিক, খেলার মালিক। ডিকো ওদের কাছে পরিচিত হল দোনো দো, পেলেদা নামে।
চাকরির সুবাদে ডোনডিনহো এলেন বাউরু শহরে। সেখানকার স্কুলে মাথা গলাল ডিকো। কিন্তু লেখাপড়ায় ডিকোর নামমাত্র আগ্রহ নেই। ওর কাছে অঙ্ক যেন বিভীষিকা, মোদ্দা পড়াটড়াতে ডিকোর বেজায় অ্যালার্জি। এর জন্য মাশুল দিতে হল, স্কুলের গেট ডিকোর সামনে বন্ধ হল। তাতে ভারী বয়েই গেল ডিকোর, বরং চুটিয়ে ফুটবল খেলা চলল। বাবা চটলেও উপায়হীন। এ বার ডিকোর টার্গেট চামড়ার বল, কিন্তু ট্যাঁক যেখানে গড়ের মাঠ টাকা মিলবে কেমন করে, অবস্থা সব পরিবারে ডাইনে আনতে বাঁয়ে কুলোয় না। তা হলে উপায়?
বেপরোয়া ডানপিটে ডিকো বছর সাত বয়সেই ফুটবলের জন্য সব ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। যেমন ভাবা তেমন কাজ। অন্ধকার রাত, ডিকো চলে যেত স্টেশনে, সেখানে সাইডিংয়ে রাখা মালগাড়ি থেকে নি:শব্দে বাদাম সরানোর কাজ শুরু হল। বেশ ক’ দিনের অভিযান কেল্লা ফতে, বাদাম বিক্রির টাকায় চলে এল ডিকোর সাধের চামড়ার ফুটবল।
পায়ে পায়ে-২
দিন থেমে থাকে না, চলমান। ছেলের ফুটবলে দুরন্ত গতি, চোখের নিমেষে কামান দাগা শট, সাবলীল ড্রিবলিং বাবাকে নাড়িয়ে দেয়। তিনি সোজা ছেলেকে বগলদাবা করে হাজির হলেন তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু কাম নামকরা ফুটবলার ওয়ালডেমার ডি ব্রিটোর বাড়ির দরজায়। আরম্ভ হল ব্রিটোর দেখভালে ডিকোর তালিম নেওয়া। ব্রিটো স্তম্ভিত, নট নড়নচড়ন, দশ বছরের ছেলের কি অবিশ্বাস্য ফুটবল খেলা। না, ছেলেটার মধ্যে ঈশ্বর মজুত না থাকলে এমন প্রতিভা পাওয়া অসম্ভব। আপসে সুযোগ এল, ডিকো খেলল নরওয়েস্ট ক্লাবের হয়ে, ডিকো পর পর গোল করল, গোলে-গোলে ছয়লাপ ম্যাচে নরওয়েস্ট জিতল ১১ গোলে, যার মধ্যে ডিকোর ন’খানা।
স্যান্টোস ক্লাব ব্রাজিলের সেরা ক্লাব। বন্দর নগর স্যান্টোসের নামে স্যান্টোস ক্লাব। ব্রিটোর অভ্যর্থনায় স্যান্টোস ক্লাবের সভাপতি, সঙ্গে ক্লাবের অন্য়ান্য কেষ্টবিষ্টু। ডিকো যথারীতি খেলছে ব্রিটোর ক্লাব বাউরুতে। সভাপতি-সহ ক্লাবের সাঙ্গোপাঙ্গদের ডিকোর খেলা দেখে চোখ ছানাবড়া। এ তো দেখছি ছেলেটার পায়ে বল পড়লেই যা চায় তা-ই হয়। আর তর সইল না স্যান্টোস ক্লাবের কর্মকর্তাদের, একে ফেলে রাখা মানেই পরে কপাল চাপড়াতে হবে।
সকলে দনাদ্দন হ্যান্ডশেক করে ডিকোকে বলেন, তুমি চলো আমাদের ক্লাবে। ডিকো এত বড়ো অকল্পনীয় সুযোগ পেয়ে অভিভূত হলেও বলল, আমি খেলা শিখিনি, আরও প্রচুর শিখতে হবে। কথা দিচ্ছি বছর দুই বাদে আমি আপানাদের ক্লাবে নাম লেখাব।
ব্রিটো আহ্লাদে আটখানা, এই না হলে শিষ্য। পনেরোতে পা দেওয়া ডিকো তখন রীতিমতো পরিণত। ফুটবল এখন ওর পায়ে কথা বলে। ডিকো-সহ ব্রিটো এলেন বন্ধু ডোনডিনহোর কাছে, বললেন – ছেলেক এ বার কাছছাড়া করতে হবে। বাউরুতে এ বার ফুলস্টপ, ডিকো এ বার যাবে বন্দর শহর স্যান্টোসে। যে শহরকে বলা হয় ব্রাজিলের ফুটবল খেলার পীঠস্থান।
পায়ে পায়ে -৩
মাত্র ষোলো-তে ডিকো পেল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রথম খেলার সুযোগ। ব্রাজিলের জার্সি গায়ে দিয়ে ডিকো নামল আর্জেন্তিনার বিপক্ষে খেলতে। স্বভাবজাত দক্ষতায় ডিকো খেলল সুনাম অনুযায়ী। তার ঠিক এক বছর বাদে, ১৯৫৮ বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতার আসরে ব্রাজিল দলে কি ডিকো সুযোগ পাবে?
কথাটা সকলের মুখেই ঘুরছে-ফিরছে। ডিকো নিজেও প্রচণ্ড উত্তেজিত ভিতর-ভিতর। আর্জেন্তিনার বিপক্ষে সব কাগজেই তার খেলার ভূয়সী প্রশংসা হয়েছিল। ফলে আশায় বসে উৎকণ্ঠায় ডিকো। ইয়েস, ব্রাজিল টিমে ডিকো আছে। রেডিও, খবরের কাগজে বড়ো বড়ো হরফে তার নাম। অপরিসীম আনন্দ…আনন্দ আর আনন্দ।
১৯৫৮, মূল পর্বের খেলা, সুইডেনের মাটিতে। ব্রাজিলের কোচ ফেয়োলার ভরসা রাখলেন দুই সদ্য উঠতি তরতাজা কিশোরের উপর। তাদের অন্যতম ডিকো। ফেয়োলার হাসি চওড়া হল। ডিকোর পায়ে তাজা ঘোড়ার দুরন্ত স্পিড, সাবলীল ড্রিবলিং, ঠিকানা লেখা পাস সতীর্থদের উদ্দেশে, বল আঠার মতন পায়ে সেঁটে আছে, আর চকিতে গোলে গোলার মতন শট নেওয়ার দক্ষতা। ভোলা যায় না, চোখের পাতা পড়ছে না, ওর পাশে নামীরা পর্যন্ত ম্লান, নিষ্প্রভ।
ও কে গো, ও কে গো? না-না অত বড়ো নাম চাই না, স্টেডিয়ামে হাজির ছিল ডিকোর ছোটোবেলার বন্ধু, সে উল্লাসে বলে উঠল, আরে দাদা শুনুন, শুনুন, ও হচ্ছে আমাদের দোনো দা পেলেদা, আমাদের বলের ওই তো মালিক। সকলকে নাচিয়ে দিচ্ছে, জিও পেলেদা জিও…, মাই গড, ইউরেকা, এখন থেকে ওর নাম পেলে, ছোট্ট ছেলের এর চেয়ে জুতসই নাম আর হয় না। পেলে…পেলে…পেলে।
ফাইনাল ব্রাজিল বনাম সুইডেন। ঘরের মাঠে খেলা ঘরের ছেলেরা বাড়তি উৎসাহ পাচ্ছে। পেলের উপর কড়া নজর। পেলে কিন্তু ঘুরে বেড়াচ্ছেন যেন পার্কে ঘুরছেন, নো উত্তেজনা, জাস্ট এনজয় ফুটবল।
প্রতিপক্ষ হতাশ, যা: বাবা এ তো দেখছি দিব্যি মৌতাতে আছে, একে আর কী নজরে রাখব।…
অনেক উঁচুতে বল উঠেছে, ব্রাজিল-সুইডেন বলের নামার অপেক্ষায়। নামছে বল, পেলে সরছেন আস্তে আস্তে, কেউ বুঝে ওঠার আগেই চোখের পলকে পেলে বল নিলেন ডান পায়ের উরুতে, সে বল চলে গেল মাথায়, এর পর ব্যাক হেড দিয়েই শরীর ঘুরল রিভলভিং চেয়ারের মতন, বল মাটি ছোঁয়ার আগেই ভলি…বল ঢুকলো গোলে…স্তব্ধ স্টেডিয়াম, পর মুহূর্তেই সমুদ্র গর্জন। ব্রাজিল জিতল ৫-২ গোলের ব্যবধানে। স্বপ্ন বাস্তবে। ফুটবলের সোনার পরী জুলে রিমে কাপ ব্রাজিল সিন্দুকে। মাত্র চারটি খেলায় অংশ নিয়ে পেলে পেলেন সেরা ফুটবলের শিরোপা। ডিকো ফিরছেন দেশে, এখন তাঁর নয়া নাম পেলে। পেলে…জনগণের পেলে।
এ বার কোথায়
সেই পেলের এ বার অন্তিম যাত্রা। আচ্ছা, ওদের দেশের ব্যান্ডে কী বাজছে, ওই যে গো ওই প্রথম সুর? ‘ওই খেপেছে পাগ্লি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই, অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্সে সামাল সামাল তাই, কামাল তুণে! কামাল কিয়া ভাই’।…’ঘুমোও পিঠে, ঘুমোও বুকে, ভাইটি আমার, আহা। বুক যে ভরে হাহাকারে যতই তোরে সাব্বাস্ দিই, যতই বলি বাহা’!
আমরা বলি, আমাদের প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ থাকুন তোমার সঙ্গে। পড়বে কিন্তু।- ‘কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি। সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি…আসব যাব চিরদিনের সেই আমি’।
লেখক: প্রবীণ ক্রীড়া সাংবাদিক
আরও পড়ুন: প্রয়াত পেলে, বয়স হয়েছিল ৮২ বছর