শ্রয়ণ সেন ঋভু
একটা দল প্রথম ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরে কিছুটা হলেও ম্রিয়মাণ। আর একটি দল বাংলাদেশকে দুরমুশ করে রীতিমতো উজ্জীবিত। সেই ভারত আর পাকিস্তানের মহারণ এ বার ইডেনে। নাগপুরে ভারতের হার এবং ইডেনে পাকিস্তানের জয়ের পর পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, শনিবারের ম্যাচ ধোনিদের কাছে প্রায় নকআউটের মতো। হেরে গেলে ভারতের ফাইনালে ওঠা খুব কঠিন হয়ে যাবে। এমনিতেই ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ নিয়ে বরাবরই উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে থাকে, তার ওপর এই ম্যাচ ভারতের কাছে মরণবাঁচন লড়াই। তাই শনিবারের ম্যাচ ফাইনালের আগে ফাইনাল। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য তা মানেন না। তাঁর মতে, “ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনাল ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনাল। অন্য কিছুর সঙ্গে তার তুলনা হয় না।” সৌরভ যা-ই বলুন, জনমত সে কথায় সায় দেয় না।
রাজনৈতিক সম্পর্ক ভারত-পাক ক্রিকেটে বারবার প্রভাব ফেলেছে। কখনও যুদ্ধ, কখনও কাশ্মীর নিয়ে দু’দেশের চাপানউতোর, আবার কখনও জঙ্গি হামলা দু’দেশের সম্পর্ককে একেবারে তলানিতে নিয়ে গেছে। এর বলি হয়েছে ক্রিকেট। আবার যখনই রাজনৈতিক সম্পর্কে বরফ গলেছে, ক্রিকেটও তার জায়গা ফিরে পেয়েছে। কার্গিল যুদ্ধের জেরে পাঁচ বছর ক্রিকেট বন্ধ থাকার পর দু’ দেশের রাজনীতিকদেরই উদ্যোগে ২০০৪-এ আবার শুরু হয় ভারত-পাক ক্রিকেট। ২০০৮-এ পাকিস্তানি জঙ্গিদের মুম্বই হামলার পর থেকে আবার ক্রিকেট বন্ধ। মাঝে ২০১৩-এ পাকিস্তান ভারতে সিরিজ খেলতে এলেও, জঙ্গি হামলাই দু’দেশের ক্রিকেটের মধ্যে মূল বাধা। যখনই ভারত আর পাকিস্তান তাঁদের সম্পর্ককে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছে, বাধ সেধেছে জঙ্গিরা। এই জন্যই দু’দেশ যখনই ক্রিকেট ময়দানে মিলিত হয়, উত্তেজনার পারদ চরমে পৌঁছয়। বিশ্বকাপের এই ম্যাচ নিয়েও কম উত্তেজনা হয়নি। ম্যাচটি প্রথমে ধর্মশালায় হওয়ার কথা থাকলেও, হিমাচলের মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তিতে ম্যাচ সরানো হয়। মুখ্যমন্ত্রীর যুক্তি ছিল, পাঠানকোটে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে হিমাচলে এখন পাকিস্তান-বিরোধী মনোভাব রয়েছে। এই আবহে ম্যাচ হওয়া উচিত নয়। এর ফলে হাতে চাঁদ পায় কলকাতা। ম্যাচ সরিয়ে আনা হয় ইডেন গার্ডেন্সে, ঐতিহাসিক অনেক ম্যাচের সাক্ষী যে মাঠ।
তবে যখনই ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট হয়েছে, তখনই কিছু মুহূর্ত আমাদের স্মৃতিতে গেঁথে গেছে। চেতন শর্মার বলে মিয়াঁদাদের ছক্কা, শারজায় ইমরানের আগুনে স্পেল, টরোন্টোয় সৌরভের সুইং-এ বিপক্ষ ঘায়েল, সেঞ্চুরিয়ানে সচিনের একা হাতে পাকিস্তান নিধন এবং হালফিলের বিরাট কোহলি বনাম মহম্মদ আমির ডুয়েল। ইডেনে যখন ভারত-পাকিস্তান আবার মুখোমুখি হবে এটা বলাই যায় যে আরও কিছু হৃদয়স্পর্শী মুহূর্ত দর্শকের জন্য অপেক্ষা করে থাকবে।
পাকিস্তান দল গত ১২ মার্চ থেকে কলকাতায় রয়েছে। তাঁদের খেলোয়াড়দের মনোভাবে মনে হয়েছে, এই শহরে তাঁরা নিজেদের যথেষ্ট নিরাপদ মনে করছেন। এখানে ম্যাচ হওয়া নিয়ে খুশি পাকিস্তানের প্রাক্তন কিংবদন্তিরাও। মিয়াঁদাদ বলেন, কলকাতায় সবাই খেলা-পাগল, এখানে সব সময়ে নিজেকে সুরক্ষিত মনে হয়েছে তাঁর। পাকিস্তানের কাছে এই মাঠ লাকি। সীমিত ওভারের কোনও ম্যাচে আজ পর্যন্ত পাকিস্তান এখানে ভারতের কাছে হারেনি। অন্য রেকর্ড বলছে, ৫০ আর ২০ ওভারের বিশ্বকাপে পাকিস্তান কখনও ভারতকে হারাতে পারেনি। ইডেনে শনিবারের ম্যাচের পর এই দু’টো রেকর্ডের একটা ভাঙতে চলেছে।
এই ম্যাচ যেন কলকাতার কাছে ‘মধুর প্রতিশোধ’ হয়ে ফিরে এসেছে। ২০১১ সালের বিশ্বকাপে ভারতের একমাত্র ম্যাচ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ইডেন থেকে। পাঁচ বছর পর যেন সেই অন্যায়েরই বিচার পেল এ শহর। এই ম্যাচ সিএবি প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের পরীক্ষাও। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তাঁর নেতৃত্বে প্রথম বড় ম্যাচ সংগঠন করতে চলেছে ইডেন। গত বছর অক্টোবরে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে একটি টি-২০ ম্যাচ বাতিল করতে হয়েছিল মাঠের খারাপ নিকাশি ব্যবস্থার জন্য। এর পরই ঢেলে সাজা হয় নিকাশি ব্যবস্থা। ইংল্যান্ড থেকে আনা হয় অত্যাধুনিক পিচ কভার। উল্লেখ্য, ম্যাচের দিন বিকেলে শহরে অল্পস্বল্প বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। তবে পূর্বাভাস, ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে তা থেমে যাবে। এই ম্যাচ স্মরণীয় করে রাখতে সৌরভ নিজের উদ্যোগে বেশ জাঁকজমকের ব্যবস্থা করেছেন। ম্যাচের আগে সম্মানিত করা হবে দু’দেশের বহু স্মরণীয় মুহূর্তের সাক্ষী ইমরান খান, ওয়াসিম আক্রম, ওয়াকার ইউনিস, ইনজামাম, গাওস্কর, সচিন আর সহবাগকে। থাকছেন অমিতাভ বচ্চন। ম্যাচ শুরুর পাঁচ মিনিট আগে তাঁর কণ্ঠে ভেসে উঠবে ‘জন গণ মন’। পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত ‘পাক সরজামিন’ গাওয়ার জন্য থাকছেন সে দেশের বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী শফকত আমানত আলি।
শেষে একটা কথা বলতে হয়। ২০০৪-এ যাঁর নেতৃত্বে পাকিস্তান থেকে টেস্ট আর এক দিনের সিরিজ জিতে ফিরেছিল ভারত, সেই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এখন সমগ্র বঙ্গ ক্রিকেটের অধিনায়ক। ইতিহাসে বহু স্মরণীয় ম্যাচের সাক্ষী কল্লোলিনী কলকাতা সৌরভের প্রশাসনিক নেতৃত্বে সাক্ষী থাকুক আরও এক জমজমাট ম্যাচের।
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।