মুম্বই: ৬ নভেম্বর ২০১৩, বেলা ১২টা। কিছুক্ষণ আগেই শেষ হয়েছে তাঁর ২৪ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কেরিয়ার। অভূতপূর্ব এবং চলন্ত ‘গার্ড অব অনার’ দিয়ে তাঁকে ক্রিকেট পিচ থেকে ড্রেসিং রুমে নিয়ে আসছে গোটা টিম ইন্ডিয়া।
আচমকা সেই বলয় ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। আবার ছুটলেন মাঠের দিকে। চোখের কোণায় জল। পৌঁছে গেলেন একদম মাঝখানে, প্রণাম করলেন পিচকে। গোটা ক্রিকেট বিশ্ব দেখল, এত দিন যাঁকে ঈশ্বর বলে অভিহিত করা হয়েছে, সেই ঈশ্বরই আজ অন্য কিছুকে প্রণাম করছেন!
তিনি সচিন তেন্ডুলকর। ক্রিকেট বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের কাছে তিনি ঈশ্বর, কঠিন অধ্যাবসায়ের এক জলন্ত উদাহরণ, যে মুম্বইয়ের খুব সাদামাটা পরিবার থেকে উঠে এসে গোটা ক্রিকেট বিশ্বকে নিজের বশে এনে ফেলে।

অধিনায়ক সৌরভের সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠিই তো ছিলেন ব্যাটসম্যান সচিন। মোক্ষম সময় তাঁর ব্যাট না চললে সৌরভের অধিনায়ক জীবন এতটা সফল হত না। এই যেমন ২০০৪-এর জানুয়ারির সিডনি টেস্ট। সচিনের সেই মহাকাব্যিক ২৪১ রানের ইনিংসটা না থাকলে ওই টেস্টে ভারতের ফল কী হত বলা কঠিন।
ওই ইনিংসের হাত ধরেই ভারত অস্ট্রেলিয়াকে নাকানিচোবানি খাওয়ালো। সিডনি টেস্ট অল্পের জন্য ভারত জিততে পারল না, ড্র হল। কিন্তু এর ফলে অস্ট্রেলিয়া থেকে বর্ডার-গাওস্কর ট্রফি ছিনিয়ে নিয়ে এল সৌরভের ভারত। তখনকার দিনে অস্ট্রেলিয়ার মাটি থেকে কোনো বিদেশি দল টেস্ট সিরিজের ট্রফি নিয়ে ফিরছে, এটা ভাবাই যেত না।
সচিনের কঠিন অধ্যাবসায়ের আরও একটা উদাহরণ যদি দিতে হয় তা হলে এই সিডনি টেস্ট। এই টেস্টের আগে সিরিজের বাকি তিনটে টেস্টে একদমই রান পাননি তিনি। ফর্ম হাতড়াচ্ছেন। কিছু একটা করে তাঁকে রানে ফিরতেই হবে।
সচিন খেয়াল করলেন যে ওই টেস্টগুলোতে তিনি আউট হয়েছেন কভার ড্রাইভ মারতে গিয়ে। নিজেকে শুধরোলেন সচিন। ঠিক করলেন সিডনিতে কোনো ভাবেই কভার ড্রাইভ মারবেন না। একজন ক্রিকেটারের কাছে এই প্রতিজ্ঞা পালন করা খুবই কষ্টের।

কিন্তু সচিন সেটা করে দেখালেন। ৬১৩ মিনিট, ৪৩৬ বলের এই মহাকাব্যিক ইনিংসে একবারের জন্য একটাও কভার ড্রাইভ খেলেননি তিনি। কঠোর পরিশ্রম ছাড়া কি এই প্রতিজ্ঞা রাখা সম্ভব?
সচিন কিন্তু ভারতীয় দল থেকে বাদও পড়েছেন। ২০০৭ বিশ্বকাপের ঠিক পরে, বাংলাদেশ সফরের সময় একদিনের সিরিজের দল থেকে। খাতায় কলমে লেখা হল যে ‘বিশ্রাম দেওয়া হয়েছে সচিন-সৌরভকে’। কিন্তু আদতে দু’ জনকেই বাদ দেওয়া হয়েছিল, তিরিশ বছর বয়সি দীনেশ মোঙ্গিয়া নামক এক ‘তরুণকে’ জায়গা করে দেওয়ার জন্য।
কিন্তু সচিন তো সচিন! ক্রিকেট কেরিয়ারের প্রায় সায়াহ্নে এসেও যাঁর ব্যাট ছেড়ে কথা বলেনি। ২০০৯-২০১০ এই সময়টায় সচিনের কেরিয়ার-গ্রাফ একদম চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে যায়। ক্রিকেট বিশ্ব লক্ষ করে আচমকা যেন জীবনের সেরা ফর্ম খুঁজে পেয়েছেন তিনি।
৩৭-৩৮ বছরের সচিন ওই দু’টো বছরে একদিনের ক্রিকেটে দুর্ধর্ষ কিছু ইনিংস খেললেন, প্রথম ভারতীয় হিসেবে একদিনের ক্রিকেটে দ্বিশতরান করে ফেলার অনন্য রেকর্ড করলেন।
আবার টেস্টেও সেই ফর্ম অব্যাহত রাখলেন। মাত্র চারটে টেস্টের ব্যবধানে দু’টো দ্বিশতরান এল তাঁর ব্যাট থেকে। ২০১০-এ টেস্টে ১৫৬২ রান করেন তিনি, যা সচিনের কেরিয়ারে কোনো একটা বছরে সর্বোচ্চ। কত কঠিন পরিশ্রম করলে আটত্রিশের একজন ‘বুড়ো’ এত কিছু করতে পারেন। ওই বছরই সচিন আইসিসির বিচারে ‘বছরের শ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার’-এর সম্মান পান।

২০১১-এর বিশ্বকাপের পর থেকে পরের আড়াই বছরে তাঁর ব্যাটে সাফল্যের থেকে বেশি ব্যর্থতাই এসেছে। ঠিক সেই এবং সংগত কারণেই ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন সচিন।
যারা নব্বইয়ের দশকে জন্মেছে তাদের কাছে সচিন মানে, ছোটোবেলাগুলোকে স্মরণীয় এবং আকর্ষণীয় করে রাখার এক মুখ্য কারিগর। তাদের কাছে সচিন মানে, ‘পেট ব্যথা করছে’ বলে মর্নিং স্কুল ডুব মেরে বাড়িতে বসে খেলার দেখার প্রধান কারণ।