লেখাটা যখন লিখতে বসেছি তখন অনেকটা রাত হয়ে গেছে। সন্ধ্যের ঝোড়ো হাওয়াটাও বন্ধ হয়েছে অনেকক্ষণ। চারদিকের পরিবেশটা ভীষণ শান্ত, খানিকটা থমথমে। বছরের এই সময়টা প্রতিবছরই আমার এরকমই মনে হয়। কেন বলুন দেখি? ঠিক ধরেছেন, ফুটবলের ক্যালেন্ডার-ইয়ার শেষের সময় তো এটাই। আর বছরের শেষ মানেই ইয়ারএন্ডিং-এর চাপ। এ পাড়ার হাবুল যখন মনে মনে কাতরাচ্ছে এবছরও আইলিগ ফসকে যাওয়ার দুঃখে, ওপাড়াতেও ক্যাবলা বা প্যালারামের মনেও তখন চ্যাম্পিয়নশিপ ফসকানোর ভয়।
অনেক ভনিতা করেছি, আর পারছি না। এবার মূল বিষয়ে আসি। আজ একটু আলোচনা করব ইউরোপীয় লিগগুলোর অবস্থা নিয়ে। আর সঙ্গে আমাদের ঘরের আই লিগ তো আছেই।
আই লিগ নিয়ে কি বলি বলুন তো। আইজল এফসি বর্তমান পরিস্থিতিতে অঘোষিত চ্যাম্পিয়ন। মোহনবাগানকে মিজোরামের মাঠে হারিয়ে তারা এখন শুধু প্রতীক্ষায় থাকবে আই লিগের শেষ বাঁশি বাজবার। মোহনবাগানের কি চান্স নেই ভাবছেন। আছে মশাই। কিন্তু সেই অঙ্ক হ-য-ব-র-ল-এর গেছোদাদাকে পাকড়াও করার মতোই সরল। আইজলকে শেষ ম্যাচে হারতে হবে লাজং এফসির কাছে। সঙ্গে মোহনবাগানকেও জিততে হবে আগামী ম্যাচ। কিন্তু বিশ্বাস করুন, মন চাইছে আইজল জিতে যাক। ভারতের লেস্টার সিটি নয়, প্রথম আইজল এফসি হিসেবেই নাম লিখিয়ে ফেলুক ইতিহাসের পাতায়। গতবছর এআইএফএফের সৃষ্ট আইনের চাপে যে দলটি অবনমনের আওতায় গিয়ে পড়েছিল, সেই দলের বছর ফিরতেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে ওঠা তো সিনেমার পর্দা আর রূপকথাতেই সম্ভব। এই জয় শুধুই একটা ফুটবল দলের জয় বলে দেখলে কিন্তু আপনিও ভুল করছেন। এটা কোথাও একটা কর্পোরেট সোসাইটির বিরুদ্ধে সাধারণ ক্রীড়াপ্রেমী মানুষের জয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডিএসকে শিবাজিয়ান্স যেখানে গতবার পয়েন্ট টেবিলের শেষে থেকেও কর্পোরেট বদান্যতায় ৩ বছরের জন্যে অবনমন বাঁচিয়ে যায়, সেখানে আইজল গতবার তাঁদের উপরে থেকেও অবনমনের শিকার। সালগাওকার ও স্পোর্টিং ক্লাব দি গোয়া টিম তুলে না নিলে হয়তো এবার আইজলের শীর্ষ ডিভিসন আই লিগ খেলাই হতো না। তাই যোমিংলিয়ানে রালতে, জায়েশ রানে, মাহমুদ আমনাহ, কিংসলে, আলফ্রেড, ব্রেন্ডন, আশুতোষ মেহেতাদের এই লড়াইটা আর সব কটা দলের থেকে আলাদা। কোথাও যেন অনেক বেশি সাধারণ মিজোরামবাসী মানুষের লড়াই হয়ে গেছে এটা। আই লিগের হাত ধরেই মিজোরাম তথা উত্তরপূর্ব ভারতের মানুষগুলো বাকি দেশবাসীর কাছে চ্যালেঞ্জ এবং একরাশ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো। লিগের বাকিটা তো মোটামুটি নিশ্চিত। খুব বিস্ময়কর কিছু না ঘটলে দ্বিতীয় হয়ে লিগ শেষ করবে মোহনবাগান। তৃতীয় স্থানে ইস্টবেঙ্গল। যদিও পয়েন্ট তালিকায় বেঙ্গালুরুও সমান পয়েন্ট পেয়েছে, তাও ইস্টবেঙ্গলের হাতে এখনও দুটো তুলনামুলক সহজ ম্যাচ।
আইজলের কথা বলতে গিয়ে লেস্টারের কথা বলছিলাম না? তাদের অবস্থা কিন্তু এবার বেশ শোচনীয়। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শীর্ষে আছে চেলসি, এবং এফএ কাপ সেমিতে টটেনহামকে ৪-২ এ ধুলিসাৎ করে বেশ টগবগে মেজাজেই আছে দলটি। আন্তেনিও কোন্তের হাতে রয়েছে এডেন হ্যাজার, উইলিয়ান, কান্তে, মাতিচের মত দুরন্ত প্লেয়ার যারা এই মুহূর্তে দারুণ ফুটবল খেলছে। এদের চ্যাম্পিয়ন হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। টটেনহাম হয়তো লিগ শেষ করবে দ্বিতীয় স্থানে। ম্যানচেস্টার সিটি তৃতীয়। লিভারপুল চতুর্থ। যদিও এই মুহূর্তে লিভারপুল তিন নম্বরে আছে কিন্তু তাদের সঙ্গে সিটির ব্যবধান মাত্র ২ পয়েন্ট। তার ওপর সিটি একটি ম্যাচ কম খেলেছে। তাই এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ অনেকটাই বেশি ম্যানচেস্টারের এই দলটির। ম্যানচেস্টারের আরেক দল, রেড ডেভিল তথা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অবস্থা লিগে খুব সুবিধের জায়গায় না থাকলেও সম্ভবত ৫ নম্বরে শেষ করবে দলটি। সাথে থাকবে ইউরোপা লিগ জেতার সুযোগ। যদিও যলাতান ইব্রাহিমোভিচ ও মার্কাস রোহোর চোটের ধাক্কা ম্যানেজার হোসে মরিনহো কিভাবে কাটিয়ে ওঠেন সেটা দেখার বিষয়। শেষ কয়েক বছরের ধরে থেকে যাওয়া ৪ নম্বর জায়গাটা আর্সেনাল হয়তো এবার খোয়াতে চলেছে। তাদের সম্ভাব্য সুযোগ ৬এ লিগ শেষ করার। ম্যানেজার আর্সেনে ওয়েঙ্গার এই ব্যর্থতা কী ভাবে ঢাকেন সেটা দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে আছেন ভক্তকুল এবং মিডিয়া।
ইংল্যান্ডের পরিস্থিতি যখন এরকম টালমাটাল, তখন ইতালিতে কিন্তু একদম বিপরীত ছবি। জুভেন্তাস লিগের দ্বিতীয় স্থানাধিকারি রোমার থেকে ৮ পয়েন্টের ব্যবধানে এগিয়ে। তালিকায় রোমার নিচেই আছে নাপোলি। যদিও এদের ব্যবধান মাত্র ২ পয়েন্ট তাও নাপোলির ধারাবাহিকতার অভাব এই ব্যবধান মুছে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা বলেই আমার ধারণা। এই লিগে লড়াইটা আসলে এরপরের ৩টি স্থান নিয়ে। সেখানে লড়াই চলছে মিলানের দুই ক্লান ইন্টার ও এসি মিলানের সঙ্গে আটলান্টা ও লাৎজিও-র। আগামী ম্যাচের শিডিউল ও দলগুলোর বর্তমান পরিস্থিতির হিসেবে ধারণা করছি এসি মিলান ৪-এ শেষ করবে। লাৎজিও ও ইন্টার সম্ভাব্য ৫ ও ৬। এর সাথে যোগ করি জুভেন্তাসের ইউসিএল জেতার সম্ভাবনার কথা। সেমিফাইনালের প্রতিপক্ষ মোনাকো যদিও লিগে এবং চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে দারুণ ফুটবল খেলে আসছে কিন্তু ধারে ও ভারে ইতালির দলটি অনেক এগিয়ে। তাই ফাইনালে যাওয়ার সম্ভাবনাও খানিক বেশি এবং শেষবারের মত ভুল হয়তো জুভেন্তাস এবার আর করবে না।
মোনাকোর কথাই যখন এলো, তখন একটু ফরাসি লিগা ওয়ানের দিকেও দেখে নেওয়া যাক। বর্তমান পরিস্থিতিতে এক ম্যাচ বেশি খেলা পিএসজি আর মোনাকোর পয়েন্ট সমান হলেও আগামী কিছুদিনে মোনাকোকে সামলাতে হবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল। উলটো দিকে প্যারিসের দলটি বার্সেলোনার কাছে অবিশ্বাস্য একটি ম্যাচ হেরে টুর্নামেন্ট থেকেই ছিটকে গেছে। ফলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবার আশায় তাঁরা সম্পূর্ণ শক্তি নিয়ে ঝাঁপাবে এটা সহজেই অনুমেয়। এই লিগের পরের জায়গাগুলো তুলনামূলকভাবে সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে। তৃতীয় স্থানে নিস এবং চতুর্থ স্থানটির সম্ভাব্য দাবিদার লিওন। যদিও মার্সেই এবং বোর্দো ঘাড়ের কাছেই নিঃশ্বাস ফেলছে। কিন্তু বাকি খেলাগুলো এবং দলগুলোর বর্তমান অবস্থা দেখে এটাই মনে হচ্ছে যে লিগ টেবিলে বিশেষ কিছু পরিবর্তন হবার নয়।
ওদিকে জার্মানিতে শেষ কয়েক বছরের মত এবছরও বায়ার্ন মিউনিখ পয়েন্ট তালিকার শীর্ষে। বুন্দেশলিগার দ্বিতীয় দল আরবি লিপজেগের সাথে ব্যবধান ৮ পয়েন্টের। যদিও এখনও ৮-৯ রাউন্ড খেলা বাকি কিন্তু বায়ার্ন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে ছিটকে যাওয়ার ফলে আর কোনো দিকে মনোনিবেশ করতে হবে না তাদের। ফলে, এই ব্যবধান আগামী দিনে আরও বাড়বে বই কমবে না। তৃতীয় স্থানটি বর্তমানে হফেনহেইমের দখলে থাকলেও বুরুসিয়া ডর্টমুন্ড সেটি ছিনিয়ে নেবে বলেই বিশ্বাস।
বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে বলা যায়, হয় তারা মেসিভক্ত, নাহলে রোনাল্ডোভক্ত। এই দুইয়ের বাইরে হলে তারা নির্ঘাত ফুটবল সম্পর্কেই আগ্রহী নয়। ফিফার দুই পোস্টারবয় মেসি আর রোনাল্ডো রবিবার রাতেই মুখোমুখি হচ্ছে তাদের লিগের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে। হ্যাঁ, আমি এল ক্লাসিকোর কথা বলছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে রিয়াল মাদ্রিদ সামান্য এগিয়ে থাকলেও বার্সেলোনা কিন্তু এই মুহূর্তে খোঁচা খাওয়া বাঘ। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে জুভেন্তাসের কাছে বিপর্যস্ত হবার পরে তাদের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনার এটাই শেষ সুযোগ। ম্যাচ যে দল জিতবে বলা যায় লা লিগার ট্রফিতে তাদের অধিকার একটু হলেও বেশি হয়ে যাবে। উলটোদিকে রিয়ালের হাতে রয়েছে লিগের সঙ্গে সঙ্গে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার মোক্ষম সুযোগ। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে নিজের শততম গোল করা রোনাল্ডো নিশ্চয়ই রিয়ালের একডজন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গল্প লিখতে চাইবে। এই লিগের তৃতীয় স্থানে আছে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। যদিও ব্যবধান বেশ বড়। তাই প্রথম দুই-এ ঢোকার সুযোগ সম্ভবত এই বছর তারা পাবেনা। বরং চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদকে বেকায়দায় ফেলতে পারে ফারনান্দো টরেস, আন্তোনিয়ও গ্রিজম্যানরা। দিয়াগো সিমিওনের তত্ত্বাবধানে অ্যাটলেটিকো জিনেদিন জিদানের রিয়ালকে কতটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারে সেটাই দেখার রইল। এই লিগের চতুর্থ স্থান পেতে পারে সেভিল। যদিও অঙ্কের বিচারে সেভিল আর অ্যাটলেটিকো সমান। কিন্তু একটা ম্যাচ কম খেলার সুবিধা রয়েছে অ্যাটলেটিকোর। কিন্তু সব শেষে আবার বলতেই হচ্ছে এই লিগের ভবিষ্যৎ লেখা রয়েছে মেসি, নেইমার, রোনাল্ডো, ক্রুসদের পায়েই। তাই আইপিএলে কেকেআর এবং রয়াল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের খেলা শেষ হতেই অবশ্যই চোখ রাখতে হবে ফুটবল মহাযুদ্ধে।
এটা তো হল আমার ব্যক্তিগত অনুমানের নিরিখে, কিন্তু সত্যি এর কতটা মিলছে তা কেবল মাত্র সময়ই বলবে। তখন না হয় আরেকবার আমি আপনি মিলে বসে এই হিসেবগুলো মিলিয়ে নেব।