ঢাকা থেকে ফারুক ভূঁইয়া রবিন
পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা দুই দলের মাথায়ই উঠেছে ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি চ্যাম্পিয়নের মুকুট, এর মধ্যে শ্রীলঙ্কা তো ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন। দুই দলের গায়ে সেঁটে আছে টি টোয়েন্টির সেরা দলের তকমা, দুই দলই ভারতে অনুষ্ঠেয় ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির অন্যতম ফেভারিট। অথচ এই দুই দলই যখন এশিয়া কাপ টি টোয়েন্টির গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে মাঠে নামে, তখন তাদের ম্যাচই কিনা ছিল টুর্নামেন্টের গুরুত্বহীন, শুধুই নিয়মরক্ষার। আর এর কারণটা নিশ্চয় এখন আর কারও অজানা নয়। টি টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ দলের নব সূচনার সৌজন্যেই এমনটা হয়েছে। বাংলাদেশ জানিয়ে দিল, এখন শুধু আর ক্রিকেটে নয়। মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বে টি টোয়েন্টি ফরম্যাটেও বাঘের হুংকারে কাঁপবে বিশ্ব।
যদিও এশিয়া কাপের এ বারের আসর বসার আগে বাংলাদেশকে নিয়ে কারও তেমন উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। আর থাকবেই কী করে ? ওয়ানডে ফরম্যাটে বাংলাদেশের সামর্থ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যে যুক্তিহীন, তা মাঠেই সাম্প্রতিক সময় বারবার দেখিয়েছেন টাইগাররা। কিন্তু টাইগারদের অতি আশাবাদী সমর্থকও এশিয়া কাপ শুরুর আগে টি টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের পক্ষে বড় ধরনের বাজি ধরতে কয়েক বার ভাবতেন। ক্রিকেটবোদ্ধাদের ভাবনায়ও ছিল, টি টোয়েন্টিতে উন্নতির জন্য বাংলাদেশকে আরও অনেক পথ হাঁটতে হবে। টি টোয়েন্টি র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১০ নম্বরে। আর ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে টি টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের সুখস্মৃতি শুধু পাকিস্তানের বিপক্ষে একমাত্র জয়। তাই পেছনে এমন পরিসংখ্যান থাকায় বাংলাদেশকে নিয়ে বড় ধরনের আশা করতে অনেকেই দ্বিধায় ছিলেন।
তবুও এশিয়া কাপের উদ্বোধনী ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশকে নিয়ে আশায় বুক বেঁধেছিলেন সমর্থকরা। আজ যদি কিছু হয়ে যায়! টি টোয়েন্টিতে ভারত শক্তিশালী বটে, কিন্তু ওয়ানডেতে তো ওরা টাইগারদের কাছে এই সে দিনই সিরিজ খুইয়েছে। হোক না ফরম্যাট ভিন্ন! কিন্তু আশাবাদী হতে বাধা কোথায় ? সে দিন ভারতের বিপক্ষে দারুণ সূচনাও করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু এখনও অনেকেই মনে করেন, সাকিবের হাত থেকে ফসকে যাওয়া রোহিত শর্মার সেই ক্যাচটিই ম্যাচ থেকে ছিটকে দিয়েছিল বাংলাদেশকে।
দ্বিতীয় ম্যাচ সংযুক্ত আরব আমিরশাহির বিপক্ষে বাংলাদেশ জয়ই প্রত্যাশিতই ছিল সবার কাছে, এবং তাই হল। তবে তৃতীয় ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দারুণ জয়ে ফাইনালের আশা জাগিয়ে তোলে টাইগাররা। আর এই জয়ই পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের আগে দারুণ ভাবে রোমাঞ্চিত করে বাংলাদেশের সমর্থকদের। এই ম্যাচ জিতলেই কোনও ধরনের হিসেবনিকেশ ছাড়াই দ্বিতীয় বারের মতো এশিয়া কাপের ফাইনালে চলে যাবে বাংলাদেশ।
সে দিন গোটা বাংলাদেশই হয়ে গেছিল মিরপুর শের-এ-বাংলা স্টেডিয়াম। আবেগে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে প্রতিটি ক্রিকেটপ্রেমী। এক দিকে ফাইনালে ওঠার হাতছানি, অন্য দিকে ২ মার্চ ছিল ঐতিহাসিক পতাকা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র সমাবেশে উত্তোলন করা হয়েছিল বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত লাল সবুজের পতাকা। এমন ঐতিহাসিক দিনে পাকিস্তানকে হারিয়ে ফাইনালে নিশ্চিত করে নতুন ইতিহাস রচনা নিশ্চয় বড় অর্জন।
ওই ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে শুরু থেকে দাপটের সঙ্গে খেলতে থাকে টাইগাররা। আর এতেই উদ্বেলিত হয়ে যায় পুরো বাংলাদেশ, মিরপুর শের-এ-বাংলা স্টেডিয়াম ছিল যার প্রতীকী রূপ। পাকিস্তানের টপাটপ উইকেট পতন কিংবা বাংলাদেশের পক্ষে সৌম্য সরকারের দাপুটে ব্যাটিং — প্রতি মুহূর্তে মিরপুর শের-এ-বাংলা স্টেডিয়ামের গর্জনের সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিয়েছে শাহবাগের বিশাল জায়ান্ট স্ক্রিনের সামনের সমাগম, কিংবা কোনও গলিতে কোনও দোকানের টিভিকে ঘিরে ক্ষণিকের ‘গ্যালারি’। এমনকী একাকী ঘরে বসে যে তরুণ খেলা দেখছিল, তার চিৎকারও কি শের-এ-বাংলার শব্দব্রহ্মের সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দেয়নি!
আবার যখন মুশফিক-সাকিবের উইকেট পরপর হারিয়ে বাংলাদেশ চাপে পড়ে যায়, তখন টিভি পর্দায় দেখা গেছে শুধু শের-এ-বাংলা স্টেডিয়ামের চিত্র। কিন্তু গোটা বাংলাদেশ তার চেয়ে ভিন্ন কিছু ছিল না। একাকী ঘরে বসে খেলা দেখা তরুণের ঘরে যেমন তখন ছিল শুধুই নিস্তব্ধতা, তেমনি গলির দোকানের টিভির সামনে জটলায়ও ছিল সমান নীরবতা, মিরপুর শের-এ-বাংলা স্টেডিয়ামে পিন পতনের শব্দও শোনার উপক্রম, আর সদা কোলাহলের শাহবাগের সঙ্গী শুধু শব্দহীনতা। সবার মনেই ভয়, আবার আসবে না তো ফিরে সেই ২০১২। যখন পাকিস্তানের কাছে মাত্র দু’ রানে হেরে এশিয়ার সেরা দল হওয়ার স্বপ্ন মিলিয়ে যায়।
কিন্তু না। সে বারের বাংলাদেশ দলের ছিল বড় মঞ্চে খেলায় অভিজ্ঞতার অভাব। কিন্তু এ বারের বাংলাদেশ ভিন্ন, অনেক অভিজ্ঞ। বিশ্বের তাবড় তাবড় টিমকে নিয়মিত হারাচ্ছে এই দল। আর যে দলের ক্যাপ্টেন সাহসিকতার মূর্ত প্রতীক, তার দল তো ভয়কে জয় করবেই। আর শেষাবধি তাই হল। আমিরকে পরপর দুটি চার মারার মধ্য দিয়ে নীরবতা ভাঙিয়ে সেই যে গোটা বাংলাদেশকে জাগিয়েছিল মাশরাফি, এর পর আর মিরপুর শের-এ-বাংলা স্টেডিয়াম এবং গোটা বাংলাদেশের আওয়াজ শুধু বেড়েছেই। আর মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের উইনিং শটের সঙ্গে সঙ্গে গোটা বাংলাদেশ ফেটে পড়ে বাঁধভাঙা উল্লাসে। বিজয়ের স্লোগানে-মিছিলে কেঁপে উঠে গোটা স্টেডিয়াম, গোটা শহর, গ্রাম-গঞ্জ, গোটা বাংলাদেশ। বিজয়ের আনন্দে কেউ একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে, কেউ আনন্দে কেঁদে ফেলে। এর থেকে ব্যতিক্রম ছিলেন না দেশের প্রধানমন্ত্রীও। তাঁরও চোখ ভিজে যায় আনন্দাশ্রুতে।
আর ম্যাচের দিন থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ম্যাচ নিয়ে কথাবার্তা ছিল বটে! কিন্তু ম্যাচের পর দিন গোটা বৃহস্পতিবার জুড়েও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজয়ের হ্যাংওভার কাটাতে পারেনি বাংলাদেশের ক্রিকেটমোদীরা। ম্যাচকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেমন চিত্র ছিল, তা বোঝার জন্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শিমূল ইউসুফের একটি স্ট্যাটাসই যথেষ্ট। যিনি মাশরাফির মধ্যে খুঁজে বেড়ান মুক্তিযুদ্ধে শহিদ ক্রিকেটার জুয়েলকে। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, “মাশরাফি, তোমার কি পূর্ব জন্মের কথা কিছু মনে পড়ে ? এক বার ভেবে দেখো তো তুমিই জুয়েল ভাই কিনা ? সেই যে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দিতে গিয়ে তিনটি আঙুল পাকিস্তানি মিলিটারির বুলেটের আঘাতে উড়ে গিয়েছিল!!! আর্মিরা ধরে নিয়ে যাওয়ার পর সেই ক্ষত স্থানেই বুট দিয়ে পিষত। তবে কি জুয়েল ভাই তোমার মাঝে ফিরে এসেছে ৭১-এর প্রতিশোধ নিতে!!!বেঁচে থাকো মাশরাফি, দীর্ঘজীবি হও, আর এ ভাবেই পাকিস্তানিদের বার বার পরাজিত করো যে ভাবে মুক্তিযোদ্ধারা পরাজিত করেছিল ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে।।।”
এ বার বাংলাদেশের সামনে নতুন স্বপ্নের হাতছানি। রবিবার ধোনিদের হারাতে পারলেই প্রথম বারের মতো বড় কোনও টুর্নামেন্ট জেতার গৌরব অর্জন করতে পারবে টাইগাররা। এশিয়া কাপ বাংলাদেশকে অনেক কিছু দিয়েছে। এই এশিয়া কাপের মধ্য দিয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের পা রাখা। এই এশিয়া কাপই বাংলাদেশের প্রথম কোনও টুর্নামেন্ট আয়োজন। আর এশিয়া কাপ দিয়েই বড় কোনও টুর্নামেন্টের ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। এ বার সেই এশিয়া কাপই আবার ভিত্তি গড়ে দিল বড় টুর্নামেন্টের ট্রফি জেতার স্বপ্ন। তবে মাশরাফি কিন্তু পা মাটিতেই রাখছেন না। ফাইনালকে ঘিরে দর্শকদের প্রত্যাশা যা-ই থাকুক না কেন, টাইগার দলপতি কিন্তু বাড়তি চাপ চাপিয়ে দিচ্ছেন না সতীর্থদের ঘাড়ে। তার মুখে শোনা যাচ্ছে শুধু ফাইনাল উপভোগের মন্ত্র।
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।
Visitor Rating: 5 Stars