
উতরে গেল রাশা বিশ্বকাপ। অপ্রত্যাশিত কোনো ঘটনা না ঘটলেও ফলাফল হয়েছে খেলার গতির সঙ্গে সাজুয্য রেখেই। সব দিক থেকে এগিয়ে থাকা টিম বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হল। রেফারিং জঘন্য মানের, ভাগ্য বিরূপ গোছের যুক্তি জড়ো করেও ধোঁপে টিকছে না বা বাজার গরম করে লাভ নেই। আজীবন তথ্য বলবে – ফ্রান্স ৪, ক্রোয়েশিয়া ২। তার থেকে যা পাওয়া গেল তাতে খুশ থাকা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো, কেন না কোনো দিন হিসেব মেলেনি, মিলবেও না। যেমন প্রতিটি দেশের অধিবাসীই চাইবেন,তাঁর দেশ জিতুক। আবার দেশের বাইরে যে বিরাট সংখ্যক ফুটবল অনুরাগী আবেগ ভাসেন, তাঁরাও নিজেদের পছন্দের টিমের জন্য গলা ফাটান। হাতে গরম কলকাতার কথা ধরলে থরে থরে প্রমাণ মিলেছে। এক-একটা গলিতে এক-এক দলের সমর্থকরা নিজেদের পছন্দের টিমের কল্যাণ কামনায় যাগযজ্ঞ করেছেন, বেশির ভাগটাই মুষড়ে পড়েছে, যাদের মিলেছে তাদের আর পায় কে।
একটা মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন মাথায় আসছে-যাচ্ছে, তা হল আমরা ফুটবলের কাছে কী আশা করি, মানে একটা ফুটবল ম্যাচে কী কী থাকলে দর্শকবৃন্দ আহ্লাদে আটখানা হবেন। ‘নো আনসার’- কারণ সমর্থনের বড়ি গিলে সব নেশাড়ু প্রিয় দল জিতলেই খুশি। অথচ ফুটবল উন্মাদ বোদ্ধা দর্শক এটাও চান, ফুটবল ম্যাচে থাকবে গোল, দু’টো প্রান্তের গোলপোস্টে লাগাতার আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ, গভীরতা, কুশলী পায়ের বিশেষত্ব, নাটক, জমজমাট ঘটনা এবং বিতর্ক। তবেই তো ফুটবলে মজবে তামাম বিশ্ব।
জোহান ক্রয়েফের অভিমত, বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল ম্যাচ অধিকাংশ সময় ডাহা বোরিং হয়। কারণ দু’টো টিমের কেউ ম্যাচ হারতে চায় না। ভয় পায়। দোষ দেওয়া যায় না, যে হেতু হারলে হাত দিয়ে মাথা কাটবে সকলে। কে বোঝাবে, যে হারে তার থেকে বেশি দু:খ কেউ পেতে পারে না। অত্যন্ত বাস্তব সত্য, ফুটবলাররা ফুটবলের মাধ্যমে নির্ভেজাল শান্তি, আনন্দ ও তৃপ্তি পান এবং ফুটবলকে রোমান্টিক করার জন্য তাঁরা মুখিয়ে থাকেন। কিন্তু বেহিসেবি হওয়া কখনোই চলবে না। কোচের স্ট্র্যাটেজির বাইরে যাওয়ার এক্তিয়ার কারও নেই।
ফিফা প্রচার করেছিল – ‘গো ফর গোলস’। সদ্য সমাপ্ত বিশ্বকাপে গোল সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। তবে নির্মম সত্য, পাশাপাশি আর একটা অভিযান সমান ভাবে সক্রিয় ছিল, যার স্লোগান-‘গো ফর ওন গোলস’।
ফ্রান্স বনাম ক্রোয়েশিয়ার ফাইনালে দর্শক যা চান, তার সমস্ত মালমশলাই মজুত ছিল। মোট গোল হয়েছে হাফ ডজন। চমক ছিল আত্মঘাতী, বল ছুটেছে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, ফুটবলারদের কলাকৌশল যথেষ্ট ছিল, নাটকীয়তারও ঘাটতি ছিল না, যখন দেখা গেল লঘু পাপে গুরুদণ্ড দিলেন রেফারি, তা হলে বোরিং ফুটবল কোথায়। দু’টো টিমই তো ফুটবলের কাছে যাবতীয় পাওনা-গণ্ডা মিটিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া আরও একটা বড়ো মাপের প্রাপ্তি মিলেছে। ক্রোয়েশিয়ার প্লে-মেকার লুকা মদ্রিচ। সকলকে ছাপিয়ে গিয়েছেন মাঠ কভারিংয়ে। সব থেকে বেশিক্ষণ পায়ে বল রেখেছেন এবং বিনা দ্বিধায় বলা যায় বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার ফাইনালে ওঠার ক্ষেত্রে মদ্রিচের ভূমিকা ছিল সব থেকে বেশি। অমায়িক চরিত্র বলেই টিমে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না।
পরাজয়ের গ্লানি-হতাশা তাড়া করবে বেশ কিছু দিন। কিন্তু প্রতিযোগিতায় প্রমাণিত হয়েছে মদ্রিচের পায়ের ছাপ বহু দিন চিহ্নিত হয়ে থাকবে গোটা বিশ্ব ফুটবলে। নিজের এমন সরব অস্তিত্বের পুরস্কার স্বরূপ মিলেছে গোল্ডেন বল অর্থাৎ প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট।

আর্জেন্তিনার প্রবাদপ্রতিম ফুটবলার জর্জ ভালদানো যথার্থই বলেছেন, “এই ভাবে ফুটবল খেলতে হয়, এই ভাবে ফুটবল অনুভব করতে হয়। সেখানেই তোমার তুমি প্রকাশিত। এখানে ঝকঝকে ‘লিভিং ফুটবল”।