পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
কাদায়, পাঁকে, ধুলোবালিতে, খানাখন্দের পরিচিত অপদার্থতার রাস্তায় মৃত মূল্যবোধের চিতার ছাই আর কবরের মাটিতে রক্ত জল করা, ঘামে ভেজা আটপৌরে জীবনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হয়। এটাই বাস্তব। যেখানে অত্যাচার, অন্যায়, শোষণগুলো শাসকের অমোঘ অধিকার যেন, আর হাত জোড় করে, মাথা নিচু করে মেনে নেওয়াটাই যেন সাধারণ মানুষের অভ্যাস। বঞ্চিত মানুষের পুঞ্জিত অভিমানের হোমকুণ্ডে জ্বলে ওঠে ঘুরে দাঁড়ানোর দ্বিগুণ দারুন প্রতিশোধের আগুন।
তুমি ক্ষুব্ধতায় সৃষ্টি কর গণসংগীতের ইস্তাহার – ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা/ আমার প্রতিরোধের আগুন/ দ্বিগুণ জ্বলে যেন/ দ্বিগুণ দারুণ প্রতিশোধে…’।
এই অসাম্যের পৃথিবীটাকে এক চরম তুচ্ছতাচ্ছিল্যতায় বোধহয় তুমিই একমাত্র বলতে পারো – ‘এই রোকো/ পৃথিবীর গাড়িটা থামাও/ আমি নেমে যাব/ আমার টিকিট কাটা অনেক দূরে/ এ গাড়ি যাবে না/ আমি অন্য গাড়ি নেব…’।
তোমার সৃজনশীলতায় সেই সুরের স্বরলিপির সরগম কখনও আলতো ছন্দে, কখনও দুরন্ত গতিতে চলতে থাকে গঙ্গা, যমুনা, পদ্মা, মেকং, ভল্গা, হোয়াংহো, মিসিসিপি, নীলনদ, রাইন, টাইমস, লরা নদীর পার ঘেঁষে – চলতে থাকে তোমার বিশ্ববাউল মননশীলতার সুরসন্ধান।
আবার ফল্গুধারায় সরস্বতী নদীর মজে যাওয়া বালুচরে, বাঘমুন্ডি পাহাড় থেকে রমনা ঘুরে, চুরুলিয়ার মেঠো পথ দিয়ে, ভুবনডাঙার মাঠ হয়ে তুমি চলে গেলে সেইসব ভাঙাচোরা মানুষের এবড়োখেবড়ো গ্রামে গঞ্জে, শহরতলিতে, মফস্সলের কোনায় কোনায় – যেখানে প্রাণের সুরের নাম আউল বাউল, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, ঝুমুর, গম্ভীরা, কাজরি, কাওয়ালি। আর সেখানকার মাটির হাসিকান্নার পরিচয় নিয়ে সেইসব প্রাণের নাম খেটে-খাওয়া মানুষ। আদিবাসী মানুষ। কোল ভীল মুন্ডা, সাঁওতাল, ওঁরাও, গেন্দে, নিগ্রো, জিপসি, বেদুইন, তাতার ইত্যাদি ইত্যাদি। তুমি তাদের সুরের দোসর হলে যারা চা বাগানের কর্মী, কলকারখানার শ্রমিক, ফসলের খেতের কিষান, মুটেমজুর, সর্বহারার দল।
তাদের আজও দু’বেলা পেট ভরে না ভাতে বা রুটিতে। তারা আজও পেটে খিদে নিয়ে ঘুমোয়। জংলা শাকপাতা, পিঁপড়ের ডিম, ক্ষুদকুড়ো যাদের একমাত্র খাবার। এমনও জায়গা এ দেশের মানচিত্রে পাওয়া যায়, যেখানে মানুষ জানে না নুন কী জিনিস। সেখানে তুমি তোমার মনের সুরের একতারায় জীবন থেকে সুর তুলবে বলে পরিব্রাজকের মতো ঘুরে বেড়িয়েছো। হয়তো এখনও তোমার কোনো উত্তরসূরি ঘুরে বেড়ায় তোমাকে মনে রেখে।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম আজও হাতে তুলে নেয় গিটার। তাদের কন্ঠে রবীন্দ্রনাথ, লালন ফকির, নজরুল, পল রোবসন, হ্যারি বেলাফন্টে, পিট সিগার, বব ডিলান, গদর, আর তার সাথে সাথে তোমার – মানে আমাদের সলিল চৌধুরী আর গণসংগীতের সুর।
জন্ম নেয় আন্দোলন, প্রতিবাদের ভাষা। লালিতপালিত হয় পৃথিবীর ইতিহাসে অধিকার কেড়ে নিতে হয় – এই সারসত্য কথা।
ভারতীয় সংগীতে প্রাচ্যের সুরের সাথে পশ্চিমী সুরকে একত্রিত করেছিলেন প্রথম রবীন্দ্রনাথ, তার পর কাজী নজরুল ইসলাম। আর এঁদের উত্তরসূরি হিসাবে সলিল চৌধুরী ভারতীয় সংগীতের নকশিকাঁথায় ওয়েস্টার্ন হারমোনি, কয়্যার, অর্কেস্ট্রা, ক্যাথিড্রাল ইন্টার লিউড, প্রি-লিউড, জোয়ারি এমনভাবে মিলিয়ে মিশিয়ে দিলেন যে সেটা বিদেশি মেজাজের হলেও, হয়ে উঠল এ দেশীয় গানের এবং মনপ্রাণের শ্রুতিনন্দন বন্ধুস্বজন। ভারতীয় সংগীতের আত্মায় তিনি পাশ্চাত্য সংগীতের সুরকে প্রতিষ্ঠা করলেন পরম আত্মীয়তায়। এখানে সলিল চৌধুরীর আর-এক নাম প্রমিথিউস।
যেমন বিঠোফেনের সেই ডিমিনিশড ফিফ্থ সিমফোনির মতো যেখানে শুদ্ধ ‘সা’ (সারভ), কোমল ‘গা’ (গান্ধার) আর কড়ি ‘মা’ (মধ্যম) আর শুদ্ধ ‘ধ’-এর (ধৈবত) ব্যবহার ‘পথে এবার নামো সাথী’-তে ‘মনোরথের ঠিকানায়’, এর ঠিক পরেই রয়েছে কয়ারের আরোপ। এ শুধু তুমিই পারো। সলিল চৌধুরী যেন সমস্ত বাংলা তথা সারা ভারতবর্ষের হয়ে সমগ্র এশিয়ার হয়ে অভিবাদন জানালেন সংগীতস্রষ্টা কিংবদন্তি বিঠোফেনকে।
সলিল চৌধুরী বাংলার তথা ভারতের তথা বিশ্বসংগীতের বিরাট স্বরলিপিতে একটি সাংগীতিক নাম, একটি অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি এই পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন ১৯২৫ সালের ১৯ নভেম্বর। আর মাসচারেক পরেই কিংবদন্তি সংগীতস্রষ্টার জন্মদিন ১০০ বছরে পা দেবে। তার প্রাক্কালে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদিত হল। আজও তিনি আমাদের মনে, মননে সমুজ্জ্বলভাবে উপস্থিত।
আরও পড়ুন