শ্রয়ণ সেন
ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে ঝড়খালি থেকে আমাদের লঞ্চ যখন ছাড়ল, ভাবতেও পারিনি কী অদ্ভুত সুন্দর অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরব। এই নিয়ে তৃতীয়বার সুন্দরবনে জলভ্রমণ করছি। গত এক বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বার। কিন্তু কখনোই বাঘ দেখার আশা আমি করি না। সত্যি বলতে কী বাঘ দেখার জন্য আমি সুন্দরবন আসিও না। আমার কাছে সুন্দরবন, বাঘ দেখার থেকেও আরও অনেক বেশি কিছু। এখানে আসি আমি এখানকার রূপ দেখতে, এখানকার মানুষগুলোকে দেখতে, তাঁদের রোজকার সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম হতে।
ঠিক এমনই সংগ্রাম করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আমার সুন্দরবনতুতো বোন রুবি — শেখ রুবি। ও সুন্দরবনের বাঘিনী। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে এখন ওর তৈরি ঘি-মধু-আচার ভারত ছাড়িয়ে বিশ্বের দরবারেও পৌঁছে গিয়েছে। ওর আরেকটা পরিচয় হল ও সুন্দরবনের ট্যুর অপারেটর। আর পাঁচজন ট্যুর অপারেটর যেখানে সুন্দরবন মানে শুধু খাবারের তালিকা বোঝায়, সেখানে রুবির চেষ্টা হয় ও সকলকে সুন্দরবনের অফবিট জায়গাগুলো ঘোরাবে। তাই রুবির হাত ধরে সুন্দরবন ঘোরা মানে অভিজ্ঞতা সবার থেকে আলাদা। তবে বর্ষায় অফবিট জায়গায় যাওয়া যায় না। সেই কারণে আমরা এবার ছিলাম ঝড়খালির একটা হোমস্টেতে, রুবির ব্যবস্থাপনায়।
শনিবার, ২৪ আগস্ট হোমস্টেতে পৌঁছে টুকটাক ঘোরাঘুরি করলাম। বিদ্যাধরী নদীর পাড়ে গিয়ে কাদার ওপর দিয়ে অনেকটাই হাঁটলাম। এ এক অদ্ভুত সুন্দর অভিজ্ঞতা।
রবিবার, ২৫ তারিখ সূচি অনুযায়ী আমাদের একদিনের সুন্দরবনের জঙ্গল ট্যুর ছিল। একদিনেরও নয়, বরং বলা যায় ঘণ্টাচারেকের। সেইমতো সকাল আটটায় ঝড়খালি জেটি থেকে আমাদের লঞ্চ ছাড়ল। সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে সেদিন, ইলশেগুঁড়ি যদিও। রুবির নেতৃত্বে রওনা হলাম আমরা পঁচিশ জন। সঙ্গে ছিলেন ফরেস্ট গাইড সমীরণ সর্দার।
বর্ষার সুন্দরবনে যে বেড়াতে এসেছে সেই জানে সুন্দরবনের সৌন্দর্য। এত্ত সবুজ চারিদিকে, যে বলে বোঝানো যাবে না। এসে পড়লাম পঞ্চমুখানিতে। বিশাল চওড়া এই জায়গাটা। এখান থেকে পাঁচটা মুখ বেরোচ্ছে, পাঁচ দিকে। একটা মুখ আবার যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের দিকে। গত বছর এখানেই ডলফিন দেখেছিলাম। এবারও তার অন্যথা হল না। নিশ্চিত ছিলাম যে বাঘ দেখতে পাব না। তাই ডলফিন, হরিণ, কুমির, বন্যশুয়োর – এগুলোর জন্যই নজর দিচ্ছিলাম।
আমরা প্রথমে গিয়ে দাঁড়ালাম দোবাঁকি ক্যাম্পের জেটিতে। কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠে, সবুজরঙা প্রবেশপথের ওপরে দোবাঁকি ক্যাম্প। দু’দিকে ১২ ফুট উঁচু পর্যন্ত তারের জাল দিয়ে ঘেরা, মাটি থেকে প্রায় ২০ ফুট উঁচু টানা পাঁচশো মিটার লম্বা ঝুলন্ত সেতুর ভেতর দিয়ে পায়ে হেঁটে কিছুটা এগিয়ে তিনতলা নজরমিনার। একটি মিষ্টি জলের পুকুর রয়েছে ওপাশে। এখান দিয়ে হাঁটলে অনুভূতি হবে যে আমরাই খাঁচাবন্দি। এই দোবাঁকি ক্যানোপি ওয়াকের ফাঁকে, জালির ফোকর দিয়েই হঠাৎ করে আমাদের নজরে পড়ে গেল বাঘের পায়ের ছাপ। এক্কেবারে টাটকা।
ফরেস্ট গাইড সমীরণবাবু জানালেন এ দিন ভোরে সম্ভবত এই অঞ্চল দিয়ে বাঘ গিয়েছে, সেই কারণে বাঘের পায়ের ছাপ এতটা স্পষ্ট।
দোবাঁকি দেখে লঞ্চ ছাড়ল। এবার এগোচ্ছে সুন্দরবনের ক্রমশ ভেতরে। আমরা চলেছি দেউলভরানির দিকে। গাজিখালির খাল দিয়ে এগোচ্ছে আমাদের লঞ্চ। আমাদের ডানদিকে পীরখালি ৬ নাম্বার দ্বীপ। হেতাল গাছে ভরা ওই জঙ্গল দেখতে দেখতে যাচ্ছি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হেতালপাতার রঙ আর বাঘের গায়ের রঙ এক ধরনের হয় বলে বাঘ এখানে ঘাপটি দিয়ে পড়ে থাকে অনেক সময়।
আচমকা গ্রুপের এক নবীনা সদস্যা, মৌসুমী চিৎকার করে উঠল ‘বাঘ’। ওর কথা প্রথমে বিশ্বাসই করিনি। ভেবেছি, নির্ঘাত হেতাল পাতা দেখে গুলিয়েছে। তারপর আমি মুখ তুলতেই দেখলাম, হ্যাঁ স্বয়ং দক্ষিণরায় আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে আমরা শিহরিত, তটস্থ। নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। যা দেখছি, সেটা সত্যি!
আমাদের লঞ্চ কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিল। আবার সেটাকে ঘুরিয়ে বাঘমামার সামনাসামনি নিয়ে আসা হল। তারপরের মিনিট পনেরো-কুড়ি যা দেখলাম, আজীবন মনে থাকবে। আমাদের জীবনের সেরা অনুভূতি। অনেকেই উত্তেজনা ধরে রাখতে পারছেন না, স্বাভাবিক অবশ্য। বার বার বলা হচ্ছে চুপ করতে, তবুও চুপ থাকা কি যায়? কেউ কেউ উত্তেজনাবশে হাততালি দিতে শুরু করেছেন।
প্রথমে বাঘ আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। ওর এই অবস্থান দেখে রুবি বলল, “ও সম্ভবত খালটা পেরোনোর কথা ভাবছিল। কিন্তু আমাদের লঞ্চ এসে যাওয়াতে সেটা পারেনি।” এর পর আমাদের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল বটে, কিন্তু সে চলল আমাদের প্রায় সমান্তরাল ভাবে। আমরা জলপথে এগোচ্ছি, বাঘ এগোচ্ছে ঘাট দিয়ে। তার রাজসিক চালচলন বুঝিয়ে দিচ্ছে কেন সে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। আমরা কেউ ভয় পাইনি। কিন্তু উত্তেজনায় সবার শরীর কাঁপছে। আমাদের লঞ্চচালক হরিদাও উত্তেজিত। বাঘ আমাদের সঙ্গে সঙ্গে শুধু চললই না, তার একান্ত ব্যক্তিগত কাজও আমাদের চোখের সামনেই সেরে ফেলল। সেই দেখে আবার হাসির রোল উঠল গোটা লঞ্চে।
ঠিক এই ভাবে পনেরো থেকে কুড়ি মিনিট চলার পর জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে গেল ওই বাঘটি। আমাদের বিস্ময় তখনও কাটছে না। নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। সবাই বিভোর হয়ে আছি। আনন্দে কারও কারও চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসছে।
উল্লেখ্য, যে মুহূর্তে বাঘের দেখা পাওয়া গিয়েছিল আমাদের গ্রুপের আর এক সদস্যা ত্রিদিশা দত্ত গিয়েছিলেন লঞ্চের লোয়ার ডেকে। ওখান থেকেই বেরিয়েই বাঘটিকে দেখে রীতিমতো চমকে যান তিনি। তাঁর কথায়, “আমার চোখের সামনে বাঘ! এই দেখে আমি কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কোনো রকমে সাহস জুগিয়ে ওপরে চলে আসি।”
এমন অনবদ্য অভিজ্ঞতার পর সে দিন আমাদের আর অন্য কিছু করার মন করছিল না। আমাদের আরও কিছু দেখার ছিল এই ট্যুরে। চোরাগাজির খালে যাওয়ার ছিল। কিন্তু সকলেই বললেন, আমাদের তৃপ্তির ভাণ্ডার এতটাই পূর্ণ হয়ে গিয়েছে যে আর কিছু দেখার দরকার নেই। হোমস্টেতে ফিরে গেলেই হয়।
লঞ্চ এগোলো ঝড়খালির দিকে। রবীন্দ্রসংগীত, লোকসংগীত গাইতে গাইতে এবং একরাশ ঘোর নিয়ে আমরা ফিরে চললাম।
(গত ২৫ আগস্ট সুন্দরবনের বাঘ দেখার প্রথম প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতা)