দূরে কোথাও
পরমেশ্বরের সন্ধানে কৈলাস-মানসে: পর্ব ৯/ পরিক্রমা অন্তে হোর-এ

সুব্রত গোস্বামী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
মাঝে মাঝে বরফে পা হড়কে যাচ্ছে। জুতো তো প্রায়ই বরফে ঢুকে যাচ্ছে। ফলে জুতো-মোজা ভিজে একাকার। খুব সাবধানে লাঠি গেঁথে গেঁথে দোলমা পাসের উপর উঠতে থাকি। চলার গতি স্বভাবতই অনেক কম। ছোটো ছোটো গর্ত, ওপরে কাচের মতো স্বচ্ছ বরফের আস্তরণ। লাঠি দিয়ে চাপ দিতেই বরফ ভেঙে জল বেরিয়ে পড়ছে। চারিদিকে শুধু বরফ আর বরফ। পাহাড়ের চূড়াগুলোয় পেঁজা তুলোর মতো বরফ জমে আছে।
গলা শুকিয়ে কাঠ। গরম জল শেষ। অনন্যোপায় হয়ে কয়েক টুকরো বরফ মুখে পুরলাম। পুরো পাহাড় জুড়ে বৌদ্ধদের লাল-হলুদ পতাকা উড়ছে। শ্বেতশুভ্র বরফে লাল-হলুদ পতাকার সার এক বিপুল বৈচিত্র্যময় রঙের জগৎ সৃষ্টি করেছে। ধীরে ধীরে উঠে এলাম পাসের মাথায়।

দোলমা পাস, ১৮৬০০ ফুট উচ্চতায় এক রুক্ষ প্রান্তর। নারীশক্তির আধার, ভদ্রকালী, চামুণ্ডে, মুণ্ডমালিনী। এ যেন তাঁরই রণনৃত্যভূমি। অসুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দেবতারা মহাদেবের কাছে এলেন। মহাদেব সব শুনলেন, ধ্যানস্থ হলেন। মহাদেবের তৃতীয় নয়ন থেকে সৃষ্টি হল দেবী কালিকার। জগতের মঙ্গলকামনায় অসুর নিধনের জন্য এই উপত্যকা থেকেই যাত্রা করলেন।
এই দোলমা পাসে রয়েছে বিশাল এক শিলাখণ্ড। সেই পাথরের সর্বাঙ্গে মানুষের মাথার চুলের গোছা আর মালার মতো গেঁথে টাঙানো রাশি রাশি ভাঙা দাঁত। পাথরের সারা গায়ে থকথকে সাদা মাখন। শিলাখণ্ডটি বীভৎস রূপ পেয়েছে। যেন ভয়ংকরী মহাকালী। ইনি হলেন গিরিবর্ত্মের অধিষ্ঠাত্রী দেবী দোলমা। তিব্বতিদের প্রথা, মস্তক মুণ্ডন করে এখানে চুল রেখে যাওয়া, পড়ে যাওয়া দাঁত ঝুলিয়ে রাখা। হাতজোড় করে কালীরূপী দোলমার চরণে প্রণাম নিবেদন করলাম।
এ বার নীচে নামার পালা। আরও সতর্ক হয়ে চলতে হচ্ছে। গৌরীকুণ্ড দেখা যাচ্ছে। দোলমা পাস থেকে ৪০০ ফুট নীচে। জলের রঙ সেখানে পান্নার মতো সবুজ। মা পার্বতী এই গৌরীকুণ্ডে স্নান করেন। প্রকৃতির কী অপরূপ সৃষ্টি! ১৮২০০ ফুট উচ্চতায় বরফের জলে তৈরি এই কুণ্ড। আমাদের সঙ্গী এক সাধুবাবা গৌরীকুণ্ডে নেমে পবিত্র জল এনে দিলেন।

দোলমা পাস থেকে নামার পথে পড়ল এক হিমবাহ। চারিদিকে শুধুই বরফ। তার মধ্য দিয়ে সন্তর্পণে এগিয়ে চললাম। হাতের লাঠি আর ঈশ্বরই ভরসা। চার ধারে বিশাল বিশাল নাম-না-জানা পাহাড়। শ্বেতশুভ্র বরফের পুরু চাদরে ঢাকা। সূর্যের আলোয় ওই শুভ্রতার ঔজ্জ্বল্য বহু গুণ বেড়ে গিয়েছে। নীল আকাশের বুকে ছোটো ছোটো তুলোর মতো মেঘ ভেসে চলেছে।
এই হিমবাহের উপর দিয়ে কিছুক্ষণ চলার পর শুরু হল তুষারপাত। সঙ্গে প্রচণ্ড ঠান্ডা হাওয়া। চলতে চলতে তাকিয়ে দেখি ক্রিভাস বা বরফের ফাটল। কোথাও কোথাও পায়ের তলায় জলের কুলকুল শব্দ কানে পরিষ্কার ভেসে আসছে। খুব সতর্ক হয়ে ভয়ংকর এই পথ পেরিয়ে এলাম। পিছনে ফিরে দেখলাম তুষারাবৃত পর্বতমালা গৌরীকুণ্ডকে তাদের সন্তানের মতো পরম স্নেহে আঁকড়ে রেখেছে।
আজ হাঁটার ধকল একটু বেশি। তাই কিছুটা উঠেই হাঁফ ধরে আসছে। মাঝে মাঝেই বিশ্রাম করছি, চকোলেট বা খেজুর মুখে দিয়ে আবার চলা শুরু করছি।
পাহাড়ের গা বেয়ে বোল্ডার ছড়ানো রাস্তা ধরে নীচে নেমে চলেছি। পাহাড় থেকে যখন সমতলে নামলাম, ঘড়ির কাঁটায় ঠিক ১১টা। নীচে নেমে জহরভাই আর সুরজভাইয়ের সঙ্গে দেখা হল। একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার এগিয়ে চলা। আরও ১২ কিমি যেতে হবে। আজ আমাদের রাতের আস্তানা জুনজু ফু-এ।
দুপুরের মিঠে রোদে আমরা হাঁটছি তো হাঁটছি। জনমানহীন প্রান্তর। কৈলাস পর্বতকে ডান দিকে রেখে এগিয়ে চলা। কৈলাসের বরফজল থেকে তৈরি হওয়া এক ছোট্ট নদী আমাদের পথ দেখিয়ে চলেছে। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে অসংখ্য ঝরনা, মিলছে ওই নদীর সঙ্গে। প্রায় দু’ কিমি দীর্ঘ এক চড়াই অতিক্রম করতেই চোখাচোখি হল কৈলাস পর্বতের সঙ্গে। কৈলাস তার মোহিনী রূপ নিয়ে নীল আকাশের বুকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হঠাৎ কিছু প্রাণের সাক্ষাৎ পেলাম। পাহাড়ের ঢালে ভেড়ার দল মনের আনন্দে ছোটাছুটি করছে। একটু বিশ্রাম নিতে সাধ জাগল। তন্ময় হয়ে বেশ কিছুটা সময় ধরে ওদের খেলা উপভোগ করলাম। শরীর আর মন কিছুটা চাঙ্গা হল। আবার নতুন উদ্যমে হাঁটা শুরু করলাম।

খানিকটা বৃষ্টি হল। আর বৃষ্টির পরেই ডান দিকের তুষারশৃঙ্গগুলো গলানো রুপোর মতো ঝলমল করতে লাগল। রুক্ষ প্রান্তরে একটু একটু করে সবুজ প্রাণেরও দেখা পাচ্ছি। সবুজ গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ পাহাড় জুড়ে বাড়তেই থাকল। এই উদ্ভিদের জন্যই পাহাড়ের এই ঢাল পাহাড়ি পশুর চারণভূমি। নদীর জল কখনও কখনও পা ভিজিয়ে দিচ্ছে।
এই ভাবে পথ চলতে চলতে জুনজু ফু-র অতিথিশালায় পৌঁছে গেলাম। অতিথিশালাটি সুন্দর, কিন্তু সেই এক সমস্যা। ওয়াশরুম অতিথিশালার বাইরে। এখন বেলা ৩টে। ভোররাত থেকে হাঁটা শুরু করেছি। শরীর আর দিচ্ছে না, গরম গরম স্যুপ আর নুডলস্ এখন অমৃত। সাথে কফি। আর কী চাই এই দুর্গম প্রান্তরে?
১২ আগস্ট। ভোর ৫টায় যাত্রা শুরু হল। মাথায় যথারীতি টর্চ বাঁধা। কারণ এই অঞ্চলে সূর্যের আলো ফোটে সকাল ৮টায়। আজ আমাদের গন্তব্য ১০০ কিমি দূরের কিউগু – না, হাঁটাপথে নয়, বাসবাহনে। আসলে ৫ কিমি দূরের হোর-এ আমাদের হাঁটা শেষ হবে, শেষ হবে কৈলাস পরিক্রমা। এত কাছ থেকে আর দেখতে পাব না কৈলাস পর্বতকে। ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: পরমেশ্বরের সন্ধানে কৈলাস-মানসে: পর্ব ৮/ কৈলাস-দর্শনের সিংহদুয়ারে
পাহাড়ি রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছি। অন্ধকার একটু একটু করে কাটছে। সূর্যদেব ধীরে ধীরে দেখা দিচ্ছেন। অবশেষে চতুর্দিক আলোকিত হয়ে উঠল। আমরা হোর-এ এসে পৌঁছোলাম। নৈঃশব্দ্যের স্বপ্নপুরী যেন এক লহমায় কোলাহলমুখর জনপদে পরিণত হল। নির্বিঘ্ন যাত্রাশেষের আনন্দে সহযাত্রীরা একে অপরকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। আমার দু’ চোখে জলের ধারা। এত দিনের স্বপ্ন সফল হল। পরমেশ্বরের করুণায় পায়ে হেঁটেই ঈশ্বরদর্শন করতে পারলাম। মনে মনে প্রভুর চরণে প্রণাম নিবেদন করলাম।
পোর্টার প্রেমাকে অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় জানালাম। সামান্য কিছু বকশিশ ওর হাতে গুঁজে দিলাম। ওর চোখে জল। এই দুর্গম প্রান্তরে ওই ছিল একমাত্র ভরসা, প্রতি মুহূর্তের সাথি। এরাই আমার পথপ্রদর্শক, এরাই আমার পরমেশ্বর। এরা না থাকলে এই দুর্গম পথ অতিক্রম করতে পারতাম না।
আমাদের নিতে এসেছে নীল রঙের দু’টি বাস। ‘হর হর মহাদেব’ ধ্বনি দিয়ে আমরা চললাম কিউগুর পথে। (চলবে)
ছবি: লেখক
দূরে কোথাও
পরমেশ্বরের সন্ধানে কৈলাস-মানসে: শেষ পর্ব/ দুর্যোগ কাটিয়ে ঘরে ফেরা

সুব্রত গোস্বামী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ভোরের আলো ফোটার আগেই রওনা দিলাম নাজাং-এর উদ্দেশে। সবার মুখ থমথমে। লিয়াজঁ অফিসারদের খুব চিন্তাগ্রস্ত লাগছে। কাল রাত থেকে অবিরাম বৃষ্টি চলছে, সঙ্গে কনকনে হাওয়া। চারিদিক থেকে ধসের খবর আসছে। দুর্যোগ পিছু ছাড়ছে না। বৃষ্টির মধ্যেই কালী নদীকে বাঁ হাতে রেখে পাহাড়ের ঢাল বরাবর সরু রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছি। কোথাও কোথাও রাস্তা খুবই সংকীর্ণ। পাহাড়ের ঢালে পিঠ ঘষে কোনো রকমে যাওয়া যায়। ঝুরঝুরে আলগা মাটি। একটু অসাবধান হলেই চরম বিপদ। ছোটো ছোটো পাহাড়ি ঝোরাগুলো বিশাল আকার ধারণ করেছে।
আরও পড়ুন: পরমেশ্বরের সন্ধানে কৈলাস-মানসে: পর্ব ১১/ ফেরার পথে গুনজি হয়ে বুধিতে
টানা দু’ দিনের বৃষ্টিতে পাহাড়ের চিত্র পুরো বদলে গিয়েছে। মাঝেমাঝেই পাহাড়ের ওপর থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ছে। দুর্যোগ মোকাবিলা দফতরের কর্মীরা আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছেন। কখনও নদীর পাড়, তো কখনও পাহাড়ের চুড়ো – এ ভাবেই চড়াই-উতরাই ভেঙে আমরা এগিয়ে চলেছি। বৃষ্টির জল পেয়ে কালী নদী ফুঁসছে। মনে হচ্ছে চার দিক ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর হাতছানি। ঝরনার জলে আমরা সবাই ভিজে গিয়েছি। আমাদের যাওয়ার রাস্তা অবিরাম পরিষ্কার করে চলেছে বুলডোজার, কিন্তু ধসের বিরাম নেই। এ যেন প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এক অসম লড়াই। কোনো কোনো রাস্তার কোনো চিহ্নই নেই। বৃষ্টির জন্য পা প্রতি মুহূর্তে পিছলে যাচ্ছে। পা টিপে টিপে এগিয়ে চলেছি। মুখে ঈশ্বরের নাম।

এ ভাবেই ১০টা নাগাদ মালপায় এলাম। প্রাতরাশের জন্য পথ চলার সাময়িক বিরতি এখানে। ১৯৯৮ সালের ১৭ আগস্ট শেষ রাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই মালপা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ২২১ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে ৬০ জন ছিলেন কৈলাসযাত্রী। তাঁরা ছিলেন ১৩ নম্বর ব্যাচের যাত্রী। কী অদ্ভুত সমাপতন! আজও ১৭ আগস্ট এবং আমরাও ১৩ নম্বর ব্যাচ। জানি না, পরমেশ্বর আমাদের কপালে কী রেখেছেন? পুরো যাত্রা এত সুন্দর ভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর এ কোন পরীক্ষার মধ্যে ফেললেন আমাদের তিনি?
প্রবল বৃষ্টিতে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এক হাতে লাঠি আর অন্য হাতে ছাতা, পাশে গণেশ। কোনো কোনো ঘাসের ঝাড় ধরে ঝুলে নামা। নীচে কোথায় পা দেব, বুঝে উঠতে পাচ্ছি না, এত খাড়া পাহাড়ের গা। নীচে থেকে গণেশ হাতে ধরে পা বসিয়ে দিচ্ছে। ঘাসের গোড়া বা গাছের শিকড় মুঠিতে চেপে ধরে, বুক-পেট পাহাড়ের গায়ে লাগিয়ে একটু বিশ্রাম নিই। বর্ষার পর এ পথে আমরাই প্রথম। এ ভাবেই সেই ৪৪৪৪ সিঁড়িওয়ালা পাহাড় অতিক্রম করলাম। সামনে আরও একটা বড়ো পাহাড়। সেই পাহাড় পেরিয়ে নীচে নামলেই নাজাং, যেখানে আমাদের জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছে।

পাহাড়ে উঠতে গিয়ে প্রায়ই পা পিছলে যাচ্ছে। যেখানেই থমকে যাচ্ছি, গণেশ এসে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। এরা না থাকলে এতক্ষণে আমাদের চলে যেতে হত কালী নদীতে। কালী নদীর দিকে তাকানো যাচ্ছে না, এখন তার রূপ এতটাই ভয়াল। শেষ পর্যন্ত পাহাড়ের মাথায় এসে পৌঁছোলাম।
এ বার নীচে নামার পালা। এ দিকের রাস্তা আরও খারাপ। কোনো কোনো জায়গায় সরীসৃপের মতো বুকে ভর দিয়ে নামতে হচ্ছে, আবার কোনো কোনো জায়গায় হামাগুড়ি। সারা গা কাদায় মাখামাখি। ছোটোবেলার কথা মনে পড়ছে। বৃষ্টির দিনে এ ভাবেই কাদা মেখে ফুটবল খেলতাম। আর আজ? প্রতি মুহূর্তে বাঁচার লড়াই। অক্ষত অবস্থায় বাড়ি ফেরার লড়াই। কোনো কোনো জায়গায় রাস্তার অবস্থা এতটাই খারাপ যে গণেশও হাত ধরতে পারছে না। হাত ধরতে গেলেই দু’ জনেরই খাদে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা। শরীরে আর বিন্দুমাত্র শক্তি নেই, পা আর চলছে না। ঈশ্বরের নাম জপতে জপতে একটা সময় দেখলাম নাজাং-এ এসে গিয়েছি। নীচে নেমে শুয়ে পড়ে পাহাড়কে প্রণাম করলাম।
মনে একরাশ আনন্দ। হ্যাঁ, পেরেছি – হেঁটে কৈলাস-মানস দর্শন করতে। আমার দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন সফল হয়েছে। চোখে আমার জল। তখনও কি জানতাম, সামনে আরও বড়ো বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।
নাজাং থেকে গাড়িতে ধারচুলা যাওয়ার কথা। কিন্তু ছ’ কিমি দূরে রাস্তা পুরো ধসে গিয়েছে। সব গাড়ি ওখানে আটকে। এখানে অপেক্ষা না করে লিয়াজঁ অফিসারদের নির্দেশে সামনে এগিয়ে চললাম। রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। প্রবল বৃষ্টিতে জায়গায় জায়গায় পাথর পড়ে রাস্তা বন্ধ। এই সব পাথর টপকে টপকে সন্তর্পণে এগোতে লাগলাম। এক সময় সেই ছ’ কিমি পথ শেষ হল। আর রাস্তা নেই। দু’টি বুলডোজার ব্যস্ত রাস্তা পরিষ্কারের কাজে। কিন্তু যে জায়গাটা পরিষ্কার করা হচ্ছে, মুহূর্তের মধ্যে ধস নেমে সেই জায়গা আবার অবরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। দুর্যোগ মোকাবিলার কর্মীরা এক সময়ে হাল ছেড়ে দিলেন।

আর উপায় নেই। এ বার এক এক করে এই জায়গাটা পার হতে হবে। দুর্যোগ মোকাবিলার কর্মীরা বাঁশি বাজালে এক জন করে যাত্রী ধসের জায়গাটা পার হবেন। বাঁশি বাজতেই প্রথম যাত্রী দৌড় দিলেন। কিন্তু যেই মাঝপথে পৌঁছেছেন ওপর থেকে পাথর পড়া শুরু হয়ে গেল। আমরা সবাই চিৎকার করে উঠলাম। যাত্রীভাই মাঝপথ থেকে ফিরে এলেন। আবার বাঁশি বাজল, কিন্তু প্রাণ হাতে নিয়ে কেউ এগিয়ে গেল না। সবাই ভয়ে পিছিয়ে আসছেন।
আমি দেখলাম এই ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে কোনো লাভ নেই। কতক্ষণ এ ভাবে খোলা আকাশের নীচে থাকতে হবে তার কোনো হিসেব নেই। সামনে এগোতেই হবে, ঈশ্বরের নাম নিয়ে আমিই দৌড় লাগালাম। সামনেই একটা ঝরনা। ঝরনার জল প্রবল বেগে নেমে এসে খাদ দিয়ে গড়িয়ে নীচের কালী নদীতে গিয়ে মিশছে। কোনো ভাবে পা হড়কে গেলে সোজা নদীতে। মৃত্যুকে এত কাছ থেকে আমি কখনও দেখিনি। চিরকালই আমি ডানপিটে, মৃত্যুভয় আমার নেই। যে দিন এই পৃথিবীতে এসেছিলাম, সে দিন নিজের ইচ্ছায় আসিনি। আর যে দিন এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে, সে দিনও নিজের ইচ্ছায় হবে না। তা হলে কেন এই মৃত্যুভয়?
ঝরনা অতিক্রম করে দেখি, সামনে এক বিশাল পাথর। টিকটিকির মতো বুকে ভর দিয়ে সেই পাথরও পেরিয়ে এলাম। এ বারে একটা পাথর থেকে আরেকটা পাথর লাফিয়ে এগিয়ে চললাম। পাথরগুলো পেরিয়ে এসে অন্য বিপদ। হাঁটু পর্যন্ত কাদায় পা দু’টো আটকে গেল। কোনো দৈবশক্তি জেন আমার উপর ভর করল। কে যেন আমাকে এক হাত ধরে তুলে নিল। তবে কি আমার প্রভু আমাকে এ যাত্রায় রক্ষা করলেন? সারা গায়ে কাদা মেখে এ পারে আসতেই ‘হর হর মহাদেব’ ধ্বনি দিয়ে এ প্রান্তের মানুষজন আমায় জড়িয়ে ধরল। পরে জহরভাইয়ের কাছে শুনেছিলাম, আমার দৌড় শুরু করার কয়েক সেকেন্ড পর থেকেই পাহাড় থেকে পাথর পড়া শুরু হয়্। দু’-একটা মুহূর্ত এ-দিক ও-দিক হলেই…।

এ পারে এসে দীর্ঘ প্রতীক্ষা, কখন দলের বাকি সদস্যরা আসবে? পাথর পড়া যখন দু’-তিন মিনিটের জন্য বন্ধ হচ্ছে, এক জন করে যাত্রী এ পারে আসছেন। তীব্র উৎকণ্ঠার মধ্যে সময় কাটতে লাগল। এ পারে আসতে গিয়ে গণেশ কাদার মধ্যে পড়ে গেল দেখলাম। হাঁটু থেকে রক্ত বার হচ্ছে। এক মহিলা যাত্রী কাদার মধ্যে প্রায় ঢুকে যাচ্ছিলেন। দুর্যোগ মোকাবিলার কর্মীরা ছুটে গিয়ে তাঁকে রক্ষা করলেন। অনেকক্ষণ পর জহরভাই আর সুরজভাইও পেরিয়ে এলেন। শেষ পর্যন্ত সবাই অক্ষত অবস্থায় এ পারে এলেন।
এ বার গাড়িতে করে রওনা ধারচুলা। আমাদের লাগেজ পড়ে রইল গুনজিতে। এক কাপড়ে ধারচুলা থেকে দিল্লি, তার পর কলকাতা। কলকাতায় আসার দশ দিন পর এল আমার লাগেজ। এসে পৌঁছোল কৈলাস-মানসের পবিত্র জলও। এটাই সব চেয়ে দামি আমার কাছে। (শেষ)
ছবি: লেখক
দূরে কোথাও
পরমেশ্বরের সন্ধানে কৈলাস-মানসে: পর্ব ১১/ ফেরার পথে গুনজি হয়ে বুধিতে

সুব্রত গোস্বামী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কাল প্রায় সারা রাত জেগে কেটেছে। চোখ জ্বালা করছে। কিন্তু যে দৃশ্যের সাক্ষী থেকেছি, তাতে মনে অপার শান্তি। অতিথিশালায় ফিরে এসে বাকি সময়টা বসে বসেই কাটিয়ে দিয়েছি। আজ মানসকে বিদায় জানানোর পালা।
আরেক বার গেলাম মানসের পাড়ে। দূরে উজ্জ্বল কৈলাস পর্বত। ভোররাতের ঘটনার কথা ভেবে এখনও লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে। বৌদ্ধমন্দির থেকে ভেসে আসছে ‘ওম মণি পদ্মে হুম’-এর সুর। ভেসে আসছে ড্রামের আওয়াজ। মন কিছুতেই চাইছে না এই জায়গা ছেড়ে যেতে। বাসের হর্ন শোনা যাচ্ছে। শেষ বারের মতো মানসের জল মুখে নিয়ে, পরমেশ্বরের উদ্দেশে প্রণাম জানিয়ে ছুটলাম বাসের দিকে। বাসের যাত্রীরা সবাই শিবের ভজন গাইছে। বাস এগিয়ে চলল আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল আমার স্বপ্নের মানস-কৈলাস। আমার দু’ চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। কে যেন কানে কানে বলছে – আবার আসিস।

কখন যে তাকলাকোট পৌঁছে গিয়েছি, খেয়াল করিনি। হোটেলে ফিরেও হোয়াটস অ্যাপে বাড়ির সঙ্গে কথা বললাম। কত দিন পর প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা হল। দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে শহরটা ঘুরে এলাম।
খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেল। আজ ১৫ আগস্ট। এই পুণ্য দিনে ফিরে চলেছি ভারতে। তাড়াতাড়িই প্রস্তুত হয়ে গেলাম। ৯টা নাগাদ আমাদের নিয়ে যাওয়া হল চিনা অভিবাসন দফতরে। তার পর কাস্টমস অফিসে। আমাদের মালপত্র পরীক্ষার পর তিব্বত তথা চিন ত্যাগের অনুমতি পেলাম। আধ ঘণ্টার মধ্যে বাসে করে চলে এলাম লিপুলেখ পাস সংলগ্ন ভারত-চিন সীমান্তে। চিনা অফিসারেরা আমাদের পাসপোর্ট পরীক্ষা করলেন। মিলল পাহাড়ে চড়ার অনুমতি। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি ১৫ নম্বর ব্যাচের যাত্রীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।
গণেশ যথারীতি চলে এসেছে। ওর কাছে আমার রুকস্যাক দিয়ে পাহাড়ে চড়তে শুরু করলাম। ১৫ নম্বর ব্যাচের যাত্রীরা আমাদের দেখে ‘হর হর মহাদেব’ ধ্বনি দিতে লাগলেন। আমাদের জড়িয়ে ধরলেন। আজ স্বাধীনতা দিবস। তাই মহাদেবের পাশাপাশি ভারতমাতার নামেও জয়ধ্বনি হল।

লিপুলেখ পাসের নীচেই আইটিবিপি-র ক্যাম্প। গরম কফি আর পকোড়া সহযোগে তারা আমাদের আপ্যায়ন করল। আইটিবিপি-র জওয়ানদের সঙ্গে ছবি তোলা হল।
আজ আমাদের গন্তব্য গুনজি, ২৬ কিমি। আসার সময় যে পথ তিন দিনে এসেছিলাম, সেই পথ এক দিনে পেরোব। একটু যে টেনশন হচ্ছে না, তা নয়। তবু হাঁটতে তো হবেই।
খুব জোরে হাঁটতে পারছি না। পথের সৌন্দর্যও সে ভাবে আকর্ষণ করছে না। কেবল কৈলাস-মানসের কথা মনে পড়ছে। মানস সরোবরে ভোররাতের অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ যেন চোখের সামনে ভাসছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর একটা বিশাল ঝরনার কাছে চলে এলাম। গোটা পথকে প্লাবিত করে ঝরনা প্রবল বেগে নীচে নেমে যাচ্ছে। লাঠির সাহায্যে অতি সন্তর্পণে পথটুকু অতিক্রম করলাম। চলে এলাম নাভিডাং। এখানে সেনাশিবিরে স্বল্পক্ষণের যাত্রাবিরতি। দেখলাম জওয়ানরা জাতীয় পতাকা উত্তোলনে ব্যাস্ত। ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত। এখানে প্রাতরাশ সেরে আবার হাঁটা শুরু করলাম কালাপানির উদ্দেশে।
কিছুটা হাঁটার পর বুঝতে পারছি, বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রামের প্রয়োজন। কিছুক্ষণ পাথরের উপর বসে রইলাম। শ্বাসপ্রশ্বাস অনেকটা মসৃণ হল, বেশ আরাম লাগছে। আবার হাঁটা শুরু করলাম। কিন্তু চলার ক্ষমতা যে বেশ কমছে, বুঝতে পারছি। বাঁ পায়ের হাঁটুতে একটা ব্যথা টের পাচ্ছি। জহরভাইয়েরও একই সমস্যা হয়েছিল। আমার দেওয়া ওষুধ খেয়ে কিছুটা সামলেছে। সমতলে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে না। কিন্তু চড়াই-উতরাই এলেই সমস্যা।
পথের দু’ পাশে সুউচ্চ পর্বতমালা। তার মধ্যের উপত্যকা দিয়ে একটি নদী বয়ে চলেছে। সেই নদীকে ডান হাতে রেখে আমরা এগিয়ে চলেছি। মখমলের মতো সবুজ ঘাস আর গুল্ম দিয়ে মোড়া পুরো উপত্যকা। অসংখ্য রঙিন ফুল ফুটে রয়েছে। এ যেন এক স্বপ্নলোক। এ ভাবে ২-৩ ঘণ্টা হাঁটার পর আমরা ১২টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম কালাপানির অতিথিশালায়। দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা এখানেই। আমি দুপুরের খাবার না খেয়ে এগিয়ে চললাম। কালাপানিতে পাসপোর্টে সিল মারিয়ে আবার এগিয়ে চলা। পথেই আলাপ হল আইটিবিপি-র এক জওয়ানভাইয়ের সঙ্গে। উনি আমাদের হাতে চকোলেট তুলে দিলেন। বাড়িতে ওঁর ছোটো একটা ছেলে আছে। তার বিদেশি মুদ্রা জমানোর খুব শখ। আমি ওঁর হাতে ১০০ চিনা ইউয়ানের একটি নোট তুলে দিলাম। সারা পথ ওঁদের সুখ-দুঃখের গল্প শুনতে শুনতে বিকেল নাগাদ পৌঁছে গেলাম গুনজি ক্যাম্পে। এসেই দেখি মনীশভাই আমাদের জন্য জায়গা রেখে দিয়েছেন। গুনজি ক্যাম্পে আজ খুব ভিড়। ক্যাম্পের পাশেই পাহাড়ে মেলা বসেছে। দূরদূরান্ত থেকে গ্রামবাসী আসছেন। গুনজি আইটিবিপি ক্যাম্প রাতে আমাদের জন্য ডিনার পার্টির আয়োজন করেছে। অনেক দিন পর দেশের খাবার খেলাম। জওয়ানভাইদের আন্তরিকতা মন ছুঁয়ে যায়।

পরদিন ঘুম থেকে উঠতেই চার দিক থেকে ধসের খবর আসতে লাগল। পাহাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। গতকাল রাতেও বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি হলেই পাহাড়ের রূপ বদলে যায়। ছোটো ছোটো পাহাড়ি ঝোরা বিশাল আকার ধারণ করে। এখানেও তাই। আজ গণেশ ছাড়াই পথ চলা শুরু হয়েছে। মেলার জন্য গণেশ একদিন গুনজিতে থেকে গেল। কাল সকালে বুধিতে আমার সঙ্গে দেখা করবে।
গুনজি থেকে ছায়লেক পর্যন্ত রাস্তা সমতল। তার পর পাহাড়ি সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামতে হবে। সেই পথটা খুব বিপজ্জনক। দু’-তিন ঘণ্টা একটানা হেঁটে চলেছি। ফুসফুস ক্রমশ হাপর হয়ে উঠছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। লজেন্স মুখে দিলাম। লজেন্সের মোড়ক বুকপকেটে রেখে দিলাম প্রকৃতির বুকে দূষণ এড়ানোর জন্য। কৈলাস পরিক্রমার সময় দেখেছিলাম জায়গায় জায়গায় ডাস্টবিন রাখা। আমাদের উত্তরাখণ্ডে সে সবের বালাই নেই।
আরও কিছুটা এগোনোর পর জলপতনের গর্জন শোনা গেল। যতই এগোচ্ছি, গর্জন ক্রমশ বাড়ছে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর সেই জায়গায় পৌঁছে গেলাম। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হুড়হুড় করে পড়ছে ঝরনার জল। যেন বিরাট তুলোর বস্তা। প্রচণ্ড গতিতে নেমে আসা সেই জল রাস্তা ভাসিয়ে কালী নদীতে পড়ছে। ঝরনার জল সারা গা ভিজিয়ে দিল। তবে নিজেকে নিয়ে চিন্তা নয়, চিন্তা ক্যামেরাটা নিয়ে। ক্যামেরার ছবি আমার কাছে মহা মূল্যবান, আমার সারা জীবনের সম্পদ, আমার বেঁচে থাকার অক্সিজেন। ক্যামেরা বাঁচিয়ে কোনো রকমে পেরিয়ে এলাম সেই জায়গা।
১২টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম ছায়লেকে। খাওয়ার জন্য সাময়িক বিরতি। আবার পথ চলা শুরু। এ বার নীচে নামার পালা। হালকা বৃষ্টি হচ্ছে, পথ ভয়ংকর পিছল। আশেপাশে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। পাহাড়ের বুকে আমি একা। ট্রেকিং-এ এ রকম হয়, কেউ যায় এগিয়ে, কেউ থাকে পিছিয়ে – যার যেমন চলার সামর্থ্য বা গতি।
আরও পড়ুন: পরমেশ্বরের সন্ধানে কৈলাস-মানসে: পর্ব ১০/ সেই জ্যোতিদর্শন
পাহাড় থেকে নামতে খুব কষ্ট হচ্ছে। বাঁ পায়ের হাঁটুর ব্যথা প্রচণ্ড বেড়েছে। কিন্তু থেমে গেলে চলবে না। বাধ্য হয়ে ব্যথা কমানোর ওষুধ খেলাম। অনেক নীচে বুধির ক্যাম্প দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যেই বৃষ্টির তেজ প্রচণ্ড বাড়ল। এক হাতে ছাতা, অন্য হাতে লাঠি নিয়ে, পা টিপে টিপে পরমেশ্বরের নাম করতে করতে এগিয়ে চললাম ক্যাম্পের দিকে।
ঈশ্বরকে মনেপ্রাণে ডাকছি – আর একটা দিন তুমি শক্তি দাও, এতটা রাস্তা যদি হেঁটে আসতে পারি, তা হলে শেষ বেলায় কেন এত পরীক্ষা নিচ্ছ? তোমার কৃপা না থাকলে এতটা পথ আসতে পারতাম না। হাঁটুতে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ব্যথা কমানোর মলম স্প্রে করলাম। একটু যেন স্বস্তি এল। ধীরে ধীরে নেমে চললাম। পৌঁছে গেলাম বুধি। কেএমভিএন-এর এক কর্মীভাই যথারীতি শরবত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের স্বাগত জানাতে। (চলবে)
ছবি: লেখক
দূরে কোথাও
পরমেশ্বরের সন্ধানে কৈলাস-মানসে: পর্ব ১০/ সেই জ্যোতিদর্শন

সুব্রত গোস্বামী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বেলা ১১টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম কিউগুতে। মানসের তীরে এই জনপদ। সরোবরের নীল জলরাশি সূর্যের আলোয় হিরের দ্যুতি ছড়াচ্ছে। শত সহস্র জলকণা সূর্যের আলোয় তারার মতো জ্বলজ্বল করছে। দূরে দেখা যাচ্ছে কৈলাস পর্বত। সরোবর সংলগ্ন এক অতিথিশালায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। আমাদের ঘরের জানলা দিয়ে হাত বাড়ালেই যেন মানসের জলের স্পর্শ পাওয়া যাবে। ঘরে ঢুকেই সবাই বেরিয়ে গেলাম। ছুটলাম মানসের জলে অবগাহন করতে। হিমশীতল জল। বাইরের তাপমাত্রা ৭-৮ ডিগ্রির কাছাকাছি, সঙ্গে প্রবল হাওয়া। কিন্তু আমাদের কাছে কোনো বাধাই আর বাধা নয়। মানস সরোবর যেন দু’ হাত বাড়িয়ে আমাদের ডাকছে। এই সেই মানস সরোবর। স্বয়ং দেবাদিদেব যেখানে অবগাহন করেন।

মানস সরোবরের জলে নেমে স্নান করার ব্যাপারে কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে। বালতি করে জল তুলে এনে স্নান করতে হয়। কিন্তু কে মানে সেই বিধিনিষেধ! মানসের জলে নেমে সবাই আনন্দে আত্মহারা। ‘হর হর মহাদেব’ আওয়াজে মুখরিত চারিদিক। মানসের জল আর চোখের অশ্রু মিলেমিশে তখন সব একাকার। মানসের জল তো শুধু জল নয়, এর মধ্যে আছে ঈশ্বরের ছোঁয়া। এ আমার কাছে চরণামৃত। সরোবরের জলে অবগাহন করতে করতে বললাম –
করচরণকৃতং বাক্কায়জং কর্মজং বা শ্রবণনয়নজং বা মানসং বাহপরাধম। / বিহিতমবিহিতং বা সর্বমেতত ক্ষমস্ব জয় জয় করুণাব্ধে শ্রীমহাদেব শম্ভো।।
(হে প্রভু, আমার এই জন্মে হস্তপদের দ্বারা কৃত অপরাধ, বাক্যজ, শরীরজ, কর্মজ, শ্রবণজ, নয়নজ কিংবা মানস অপরাধ, সঞ্চিত কিংবা ভবিতব্য অপরাধ, সব ক্ষমা কোরো।)
সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করলাম। হে প্রভু, তুমি না থাকলে এই পুণ্যধামে আমার আসার সুযোগ হত না। কত বাধা, কত বিঘ্ন উপস্থিত হয়েছে। তুমি সমস্ত বাধা উপেক্ষা করে আমাকে এই পুণ্যধামে নিয়ে এসেছ। এ তোমার অপার মহিমা। আমাকে তোমার চরণে স্থান দাও।
আরও পড়ুন: পরমেশ্বরের সন্ধানে কৈলাস-মানসে: পর্ব ৯/ পরিক্রমা অন্তে হোর-এ
পিতৃপুরুষদের স্মরণ করার জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা আর কিছু হতে পারে না বলে মনে হয় না। পিতৃঋণ থেকে মুক্ত হব, এ আশাও আমি করি না। যত দিন বাঁচব, পিতৃঋণ আমি সানন্দে বহন করতে চাই। এই বলে মানস সরোবরের জল নিয়ে পিতৃপুরুষদের উদ্দেশে তর্পণ শুরু করলাম। তর্পণ করার কোনো সামগ্রীই আমার কাছে ছিল না, সামান্য একটু তিল ছাড়া। সেই তিল হাতে নিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে পিতৃদেবকে স্মরণ করে বললাম –
ওঁ পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাহি পরমং তপঃ/পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্বদেবতাঃ।
কতক্ষণ জলের মধ্যে ছিলাম জানি না, জহরভাইয়ের ডাকে হুঁশ এল – তাড়াতাড়ি চলুন স্যর, হোমযজ্ঞ যে শুরু হয়ে যাবে। মানসের জলে ডুব দিয়ে কিছু পাথর সংগ্রহ করে অতিথিশালার দিকে পা বাড়ালাম।
সরোবরের পাশেই যজ্ঞের স্থান। মুম্বইনিবাসী মুকেশভাই যজ্ঞ করার দায়িত্ব নিলেন। তাঁকে সাহায্য করলেন জহরভাই। যজ্ঞের সামনে বসে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ যেন এক আলাদা অনুভূতি। সবাই মিলে হোম-যজ্ঞে পরমেশ্বরের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম। মুকেশভাই বেদির উপর মাথা ঠুকতে ঠুকতে অশ্রুসিক্ত নয়নে স্তব পাঠ করতে লাগলেন।
সব তীর্থযাত্রীর চোখে জল। আসলে এই চোখের জল তো শুধুমাত্র জল নয়, এ আনন্দাশ্রু – ঈশ্বরকে দেখার, ঈশ্বরকে কাছে পাওয়ার যে আনন্দ, তারই প্রকাশ। এই বিরল মুহূর্তটাকে ক্যামেরাবন্দি করলাম অতি দ্রুত।
যজ্ঞ শেষ হওয়ার পর অতিথিশালায় ফিরে জানলার ধারে বসে রইলাম। মানস সরোবরের এই রূপ থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। নীল জলের অপর প্রান্তে কৈলাস পর্বত এখনও ঝকঝক করছে। কখন যে চোখ লেগে গিয়েছে, টের পাইনি। জহরভাইয়ের ডাকে ঘুম ভাঙল। রাতের খাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। ভোররাতে উঠতে হবে। শুনেছি, ভোররাতেই শিব-পার্বতী মানসের জলে অবগাহন করতে আসেন। চিত্রকল্পটা মনের মধ্যে আঁকতে আঁকতে কখন যে ঘুম এসে গেল!

১৩ আগস্ট। রাত ৩টের সময় সুরজভাইয়ের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি, কয়েক জন যাত্রী মানসের পাড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাইরে এখন তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে। সঙ্গে প্রবল ঝোড়ো হাওয়া। বাইরে এসে দেখি আমাদের বন্ধুরা সবাই অধীর আগ্রহে বসে আছেন। সবার মুখে তখন ‘ওঁ নমঃ শিবায়’। ওই মন্ত্র ছাড়া কারও মুখে কোনো কথা নেই। ধীরে ধীরে পুব আকাশে সূর্যের উদয় হল। চারি দিক আলোকিত হয়ে উঠল। কিন্তু স্বপ্নপূরণ হল না। তাঁরা এলেন না। অতিথিশালায় ফিরে এলাম।
আজ আমাদের অখণ্ড অবসর। আজ শুধু মানসের চার পাশে ঘুরে বেড়ানো আর ছবি তোলা। অতিথিশালার সংলগ্ন গুম্ফায় গেলাম। চার দেওয়ালে বৌদ্ধের বাণী আর তৈলচিত্র। বুদ্ধের মূর্তির সামনে বসে এক উপাসক ড্রাম বাজাচ্ছেন। ড্রামের ডুম ডুম আওয়াজ আর ধূপের গন্ধ চারি দিকে স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বুদ্ধের মূর্তির সামনে আমিও বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলাম। লাউডস্পিকারে অতি মৃদু স্বরে ভেসে আসছে – বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি (আমি বুদ্ধের শরণ নিলাম)/ধম্মং শরণং গচ্ছামি (আমি ধর্মের শরণ নিলাম)/ সংঘং শরণং গচ্ছামি (আমি সংঘের শরণ নিলাম)। জানতে পারলাম এই গুম্ফা ৩০০ বছরের পুরোনো। ভিতরের তৈলচিত্রগুলোও সেই সময়কার। অথচ এখনও কত উজ্জ্বল।

দুপুর হতেই দল বেঁধে চললাম স্নান করতে। কেউ নিয়ম মানছেন না। আশেপাশে কোনো পাহারাদার নেই দেখে সবাই ডুব দিতে জলে নেমে পড়ল। আমিও নেমে পড়লাম মানসের জলে। কাচের মতো স্বচ্ছ জল। সরোবরের অনেক গভীর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে।
দুপুরের খাওয়ার পর মানসের জল আনতে ছুটলাম। বোতলে ভরলাম। কলকাতার অনেকেই মানসের জল আনতে বলেছেন। জানি না, এই জল শেষ পর্যন্ত ঠিকঠাক গন্তব্যে পৌঁছোবে কি না। ঘোড়ার পিঠে করে আমাদের মালপত্র যাবে নাজাং পর্যন্ত। সেখান থেকে ট্রাকে করে দিল্লি, তার পর ট্রেনে কলকাতা। তখনও জানতাম না ফেরার সময় আমাদের জন্য কী দুর্যোগ অপেক্ষা করছে।
রাতের খাওয়া শেষ করে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে দিল ঘড়ির অ্যালার্ম। হালকা বৃষ্টি পড়ছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। আকাশ মেঘলা থাকলে দৃশ্যমানতা কমে যায়। তবে কি আজও তাঁর দেখা পাব না? এক অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠল। মানস সরোবরে আজই আমাদের শেষ রাত। কাল সকালেই আমরা রওনা দেব তাকলাকোটের উদ্দেশে। হাতে ছাতা নিয়ে মানসের জেটিতে গিয়ে বসলাম। বেশ কিছু যাত্রী অনেক আগে থেকেই অধীর আগ্রহে বসে আছেন। কারও মুখে কোনো কথা নেই। কৈলাসের দিকে তাকিয়ে মনে মনে প্রভুকে ডেকে চলেছি।
ঠিক ৩.২৫ মিনিট। হঠাৎ দেখি মানসের জল স্থির হয়ে গেল। কৈলাস পর্বতের মাথায় একটা হলুদ আলো দপদপ করে জ্বলে উঠল। অনেকটা হ্যালোজেন আলোর মতো। সেই আলোর জ্যোতিতে মানস আলোকিত। আলোটা কৈলাস পর্বত থেকে নেমে এসে মানসের জলে ঘুরপাক খেতে লাগল। ৩০-৪০ সেকেন্ডের পর আলোটা জল থেকে উঠে কৈলাস পর্বতে মিলিয়ে গেল। উত্তেজনায় আমাদের শরীর কাঁপছে, আমরা মূক। কতক্ষণ যে এই ভাবে ছিলাম, জানি না। পাশের যাত্রীর ‘হর হর মহাদেব’ ধ্বনিতে সম্বিত ফিরে পেলাম। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছি না। এ আমি কী দেখলাম! পরমেশ্বর অবশেষে আমাদের দেখা দিলেন। তা হলে কি সেই কাহিনি সত্যি? সত্যিই কি শিব-পার্বতী ভোররাতে মানসের জলে অবগাহন করতে আসেন?
এই অলৌকিক ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা বিজ্ঞান আজও দিতে পারেনি। কী ভাবে এই আলোর উৎপত্তি? কেনই বা সেই আলো এসে পড়ে মানসের জলে? আমার সারা শরীর শিহরিত। গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠেছে। সহযাত্রী জহরভাইকে জড়িয়ে ধরলাম। দেখলাম জহরভাই আর সুরজভাই উত্তেজনায় কাঁপছে, মুখে শুধু ‘হর হর মহাদেব’। আমার দু’ চোখে জলের ধারা। পবিত্র মানসের জল মুখে-মাথায় দিলাম। পরমেশ্বরের এই রূপ দেখতেই তো এত কষ্ট করে, বাড়ি-ঘর-সংসার ফেলে এখানে ছুটে আসা। ধীরে ধীরে পুব আকাশে সূর্যদেব দেখা দিলেন। আমরা এখনও বিস্ময়ে বিমূঢ়। (চলবে)
ছবি: লেখক
-
হাওড়া3 days ago
বালির বিধায়ক বৈশালী ডালমিয়াকে দল থেকে বহিষ্কার করল তৃণমূল
-
বিনোদন3 days ago
বাজেটের আগে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ মাল্টিপ্লেক্স কর্তৃপক্ষের, সঙ্গে সানি দেওল
-
রাজ্য3 days ago
মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দিয়ে রাজভবনে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়
-
রাজ্য3 days ago
তৃণমূলে যোগ দিলেন ২০১৬-য় কালনার বিজেপি প্রার্থী