যাকে ভ্রমণ বলে জানে সবাই। একদমই তা নয়। নিজের তৈরি তথ্যচিত্র দেখাতে ইতালি যাওয়া, তার পর বন্ধুদের কাছে থেকে ঘুরে বেড়ানো আরও দু’টো দেশ,অস্ট্রিয়া ও চেক রিপাবলিক। মাসখানেক সময়। মৌসুমি বিলকিসের কাছে শুধু বিদেশ ভ্রমণই প্রথম নয়,উড়োজাহাজে চড়াও। সেই প্রথম অনেক কিছুর বেশ কিছুটা মৌসুমি খবর অনলাইনের পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করবেন ধারাবাহিক ভাবে । উড়ান শুরু হল।
মৌসুমি বিলকিস
প্রথম টেক অফ। ১৭ জুনের সকাল,২০১৪। যখন উড়লাম নীচের সব কিছু জ্যামিতিক নকশা। ওপর থেকে গঙ্গা, মিলানের পো নদীটিও, আফগানিস্তানের ঢেউ খেলানো দীর্ঘ প্রান্তর। কয়েক ঘণ্টায় দিন পেরিয়ে রাত, রাতদিনের সংযোগস্থলের নীলচে আলো,আবার দিনের ঝলক। কী যে ভালো লাগছিল। অরভিল এবং উইলবার রাইট-দের মনে পড়ল। ১৯০৩ সালে তাদের উড়বার প্রথম বিস্ময়কর প্রচেষ্টা। আর আজ, এক দিনেই পৌঁছে যাব রোম। হ্যাঁ, এই প্রথম বিদেশযাত্রাও। ‘ কনভেনশন দেল সিনেমা সিভিলে পায়েস্তুম’- এর ব্যবস্থাপকদের আমন্ত্রণে। রূপকলা কেন্দ্রের প্রযোজনায় তৈরি আমার তথ্যচিত্র‘ কবি’ দেখানো হবে, দক্ষিণ ইতালির পায়েস্তুমে। এয়ার ইন্ডিয়ার আধুনিকতম এয়ার বাস, বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার। দিল্লি থেকে মিলান বিমানবন্দর ছুঁয়ে রোম। চেক ইন লাগেজ গোছানোর হ্যাপা রাজা আর মনীষার। জিনিসপত্রের তালিকাও বানিয়েছে। আমি গোছালে ঠিক, জেরম ক্লাপকা জেরমের ব্যাগ গোছানোর মতো হত, টুথব্রাশ বেরোত জুতোর ভেতর থেকে!
ভয় ছিল। ঠিকঠাক সামলাতে পারব তো ? আগের রাতে সৌম্যদা বাচ্চাদের বোঝানোর মতো বুঝিয়েছে চেক ইন লাগেজ, হ্যান্ড লাগেজ, বোর্ডিং পাস ইত্যাদি বিষয়ে। ভাবছি দিল্লি থেকে আমাকে ফেলে রোমের ফ্লাইট উড়ে যাবে না তো ? উড়ানের অভিজ্ঞতা থাকায় বোন মঞ্জুরি আশ্বাস দিয়ে রেখেছে এয়ার ইন্ডিয়ার কর্মীরাই নাকি ডেকে নেবে। তা-ই হল। বাকিটা নিজেই সামলেছি। জানি না মানে জানি না-ই হয়। এই মধ্যজীবনে এসে প্রথম উড়ছি বলে লজ্জিত নই। বরং মুর্শিদাবাদের মতিউর রহমান আর রাবিয়ার মতো বাবা-মায়ের মেয়েরা আমার বয়সে পৌঁছনোর আগেই একগাদা বাচ্চাকাচ্চার জননী হয়ে প্রতি দিন হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামেগঞ্জে। তাই গ্রাম থেকে কলকাতা হয়ে ইতালি পৌঁছনো একটা দীর্ঘ অধ্যায় এবং কোথাও হয়তো এর একটা সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্বও আছে যেখানে ব্যক্তি ‘আমি’ বড় কথা নয় সম্ভবত।
পরিবারের লোকজনের উৎকন্ঠা, কলকাতা বিমানবন্দরে রাজা-মনীষা-মঞ্জুরির উদ্বিগ্ন মুখ। মাস খানেকসবাইকে ছেড়ে থাকব। দুঃখ দুঃখ ব্যাপার। কিন্তু টেক অফ করতেই মন খারাপ কেটে গেল। উফ্! কী অসহ্য সুন্দর। সাদা –ধুসর-নীলের এত শেড আছে ? মেঘের এত রূপ ? একটা স্বপ্নের ভেতর দিয়েই যাচ্ছি যেন। যেন শুনছি ভিভালডির‘ ফোর সিজনস’ যার মধ্যে মিশে আছে বুক দুরুদুরু, দুঃখ, ভয়, রোমান্স আর পাখা গজানোর অনুভূতিসকল।
মনে পড়ছে যাত্রাপথে আলাপ মিলানের রোবের্তোর সঙ্গে, যে তার সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার রোমাঞ্চকর কাহিনি শুনিয়েছিল। রসোলিনি-সোনালি কাহিনি কি ও জানে ? আর দিল্লির করণ কোহলি, যার সঙ্গে কথা হয়েছিল ‘আমোরেস পের্রস’ বিষয়ে। বিমানসেবক ও সেবিকারা, সহযাত্রীরা আমার অহেতুক নানা প্রশ্নের সমাধান করছিল হাসিমুখে।
কলকাতার ইতালিয়ান দূতাবাসের চিজারে বেল্লের ও সান্দ্র নিকোলিনি আমন্ত্রণপত্র দেখে ছ’মাসের সেনগেন ভিসাই দিয়ে দিলেন দ্রুত। আর কক্স অ্যান্ড কিংস-এর সঞ্জয়, অভিজিত, ভেঙ্কটেশ্বর আমার নানা জিজ্ঞাসার উত্তর দিয়েছে একটুও বিরক্ত না হয়ে।
এদের সবার সহযোগিতা সঙ্গী করে মধ্য রাতে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বিমানবন্দরে। ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অর্গানাইজার আলবের্তো আর স্পনসর জেনারো গাড়ি নিয়ে উপস্থিত। রোমের ইয়া বড় চাঁদ দেখতে দেখতে পায়েস্তুমের পথে। আমার ‘ভিয়াজ্জিও ইন ইতালিয়া’ শুরু।
(চলবে)
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।