শ্রয়ণ সেন ঋভু
“আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে……”
না, বনে নয়। ঋষিকুল্যার ধারে। বসে আছি হোটেলের গাড়িবারান্দায়। চাঁদ তার মায়ার খেলায় মাতিয়ে রেখেছে জনমানবশুন্য চার পাশ। আর তার আলোয় ঋষিকুল্যা যেন আরও সুন্দরী হয়ে উঠেছে।
কিন্তু এই মায়ার খেলা বেশিক্ষণ উপভোগ করা গেল না। আশপাশ থেকে হিংসুটে কিছু মেঘ এসে চাঁদকে একেবারে নিজেদের কব্জায় নিয়ে নিল। মুহূর্তের মধ্যে চার দিক অন্ধকার। আমাদের হোটেলটা বাদ দিলে শুধু পাহাড়চুড়োর মন্দিরে একটা ক্ষীণ আলো। একটু পরেই বৃষ্টি নামল ঝমঝমিয়ে।
আজ সকালেই এসে পৌঁছেছি ওড়িশার পর্যটন-মানচিত্রে স্বল্পপরিচিত, অথচ পাহাড়-নদী-মন্দির মিলিয়ে পর্যটনসম্পদে সমৃদ্ধ এই তারাতারিণীতে। তবে তার আগে বলি কী ভাবে এই জায়গার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হল।
দিনটা ছিল মহাষষ্ঠী। আর দু’দিন পরেই আমরা ওড়িশা ভ্রমণে রওনা হব। কটক, চিল্কা-পাড়ে বরকুল আর পুরীতে থাকার ব্যবস্থা হলেও, মাঝে দু’টো দিন কোথায় থাকব ভেবে পাচ্ছি না। গোপালপুরের কথা মাথায় এল। হোটেল বুকিং-এর তিন-চারটে ওয়েবসাইট খুললাম। বিধি বাম। কোনও হোটেলে ঘর নেই। তবে এর মধ্যে একটা ওয়েবসাইটই সন্ধান দিল তারাতারিণীর নিরুপমা হোটেলের। তারাতারিণী! আগে কখনও এর নামই শুনিনি। ভালো হবে তো! ‘গুগুল’-এ গেলাম। তারাতারিণী লিখে মারলাম ‘সার্চ’। ব্যস, সব সন্দেহ শেষ। একটার পর একটা সুন্দর ছবি আসতে শুরু করল। ব্রহ্মপুর থেকে ৩২ কিমি , পাহাড়ের ওপর ‘তারাতারিণী’ দেবীর মন্দির আর পাদদেশে ঋষিকুল্যা নদী-সংলগ্ন উপত্যকাকে নিয়ে এই ছোট্ট জনপদ। মন্দিরে তিন রকম ভাবে ওঠা যায়। হেঁটে, গাড়িতে আর সব চেয়ে আকর্ষণীয়, রোপওয়েতে। ফোন করলাম ‘নিরুপমা’য়। ও দিক থেকে এক জন বললেন, চলে আসুন, জায়গা আছে।
ভুবনেশ্বর থেকে সকালের ভাইজাগ ইন্টারসিটি এক্সপ্রেসে ব্রহ্মপুর এসে পৌঁছলাম সাড়ে দশটা নাগাদ। হোটেল থেকে ঠিক করে দেওয়া গাড়ি স্টেশনে ছিল। আমাদের নিয়েই ছুটল। পাঁচ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে কলকাতার দিকে ৬ কিলোমিটার এসে বাঁ দিকে ৩২ নম্বর রাজ্য সড়কে উঠলাম। অদূরে বিক্ষিপ্ত পাহাড়শ্রেণি। আধ ঘণ্টা চলার পর পেলাম তিন-রাস্তার মোড়কে নিয়ে গড়ে ওঠা একটা ছোট্ট জায়গা। ডান দিকে ঘুরলাম। আরও কিলোমিটার দুয়েক পথ। কিছুটা যেতেই বাঁ দিকে একটা পাহাড় সঙ্গী হল। তার মাথায় একটা মন্দির। ওটাই যে তারাতারিণীর মন্দির বুঝতে সময় লাগল না।
—“আসুন আসুন। নিরুপমা তারাতারিণীতে আপনাদের স্বাগত।” গাড়ি থেকে নামতেই রিসেপশন থেকে একজন ষাটোর্ধ্ব ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। “আমি অর্জুন সাহু। এখানকার ম্যানেজার”।
—“বাহঃ দারুণ বাংলা বলেন তো!”
—“গত তিরিশ বছর ধরে বিভিন্ন পান্থনিবাসের ম্যানেজার ছিলাম। রিটায়ার করার পর থেকে এখানে আছি। ওড়িশা টুরিজম তো বাঙালিদের জন্যই বেঁচে আছে। বাঙালি না এলে কি পুরী, কোনারক, গোপালপুরকে কেউ জানত?”
সাহুবাবুর মুখে বাঙালি-স্তুতি। মন ভালো করে দেওয়া একটা অভিজ্ঞতা নিয়ে হোটেলে ঢুকলাম। আশেপাশে কোনও বসতি নেই। ১ কিমি আগে মন্দিরে ওঠার জন্য রোপওয়ে স্টেশনটা পেরিয়ে এসেছি। ওখানে কিছু দোকানপাট আছে। এ দিকটা পুরো ফাঁকা। পাশের পাহাড়টাই তারাতারিণী পাহাড়। ওপরে মন্দির। আর হোটেল থেকে দু’পা হাঁটলেই ঋষিকুল্যা। সে আমাদের ডাকছে। কিন্তু দীর্ঘ যাত্রায় আমরা ক্লান্ত। তাই তার ডাক উপেক্ষা করেই ঘরে ঢুকলাম। জানলার পর্দা সরাতেই একটা অনাবিল আনন্দ ছুঁয়ে গেল আমাদের। মনে হচ্ছে এ যেন ঈশ্বরের আপন দেশ। ঋষিকুল্যা এঁকেবেকে চলেছে সমুদ্রের টানে। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে অসংখ্য অনুচ্চ পাহাড়। এত দিন তো আমরা ওড়িশা মানে সমুদ্র, জগন্নাথ, নন্দনকানন, সূর্যমন্দির, চিল্কা আর উদয়-খণ্ড-ধবলগিরি জানতাম। কিন্তু এ এক সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা, নতুন ওড়িশা।
বিকেল সাড়ে ৪টে। বাইরে পড়ন্ত রোদ। মন্দির দর্শনের এটাই সেরা সময়। আমরা রোপওয়েতেই যাব। সাহুবাবু একটা অটো ডেকে দিলেন। একশো টাকায় রোপওয়ে স্টেশন পৌঁছে দেবে, আবার ফিরিয়ে আনবে। জনপ্রতি ১৫ টাকায় ওঠা-নামার টিকিট কেটে চড়ে বসলাম রোপওয়েতে। মিনিট দশেকে এসে গেল মন্দির প্রাঙ্গণ। সমুদ্রতল থেকে প্রায় ৭০০ ফুট উপরে আমরা।
এই মন্দিরের ইতিহাস নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন মত। পুরান মতে ৫১ সতীপীঠের একটা এই মন্দির। এখানে দেবীর স্তন পড়েছিল। আবার অন্য মতটা হল বহু যুগ আগে তারা আর তারিণী নামের অলৌকিক ক্ষমতাধারী দুই সাধিকা বোন এই অঞ্চলে থাকতেন। তাঁদের নামে এই মন্দির গড়েন এই অঞ্চলেরই এক শিক্ষিত ব্রাহ্মণ বসু প্রহরাজ। তবে একটি ব্যাপারে কোনও দ্বিমত নেই, এই মন্দির ওড়িশার বহু প্রাচীন মন্দিরগুলির একটা। আমরা তারাতারিণী দর্শন করলাম। ওড়িশার মন্দির বলতেই যে ভয়টা আমরা সবচেয়ে বেশি পাই, সেই পাণ্ডাদের কোনও চিহ্নই নেই এখানে। দর্শন সেরে চাতালটায় কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। এখান থেকে নীচের উপত্যকার দৃশ্য অসাধারণ, যার অনেকটাই জুড়ে ঋষিকুল্যা। ঋষিকুল্যাই এখানকার জীবন। সে আছে বলেই এখানে মানুষ আছে।
হোটেলে ফিরে ঘরে না গিয়ে বসলাম গাড়িবারান্দায়। চায়ের কাপে তৃপ্তির চুমুক দিতে দিতে সাক্ষী থাকলাম এক অভূতপূর্ব চন্দ্রোদয়ের। আজ ত্রয়োদশী। দু’দিন পরেই কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো। তাই আকাশে প্রাক-পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদের আলো যেন নদীকে আরও মায়াবী করে তুলেছে। একটু পরেই হারিয়ে গেল চাঁদ, নামল বৃষ্টি।
সকাল হল তারাতারিণীতে। ঋষিকুল্যার ডাক আর উপেক্ষা করা গেল না। তাকে দেখার জন্যই প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম। বাতাসে হাল্কা একটা ঠান্ডার আমেজ। হয়তো আগের রাতের বৃষ্টির জন্যই। এসে গেলাম নদীর কিনারায়। হোটেল থেকে এক মিনিটের হাঁটা পথ। এই সাত সকালেই নদীতে চান করতে নেমে পড়েছেন স্থানীয় গ্রামবাসীরা। আমরা পা ভেজালাম। মিনিট দশেক নদীর ধারে বালির ওপর বসে থাকলাম।
একটু পরেই সাহুবাবুর ব্যবস্থা করে দেওয়া একটা গাড়িতে বেরিয়ে পড়লাম। তপ্তপানি, চন্দ্রগিরি আর সময় থাকলে গোপালপুর দেখে বিকেলের মধ্যেই ফিরে আসা। তারাতারিণী থেকে হিঞ্জলিকাট, পাত্তাপুর, দিগাপাহান্ডি, পুদামারি হয়ে তপ্তপানি ৮৭ কিমি। যেতে সময় লাগল ঘণ্টাদুয়েক। সমুদ্রতল থেকে ১৭০০ ফুট উচ্চতায় এই তপ্তপানি বিখ্যাত তার উষ্ণ প্রস্রবণের জন্য। তপ্তপানি ঢোকার মুখে বন দফতরের ডিয়ার পার্ক আছে। সেটা দেখে গেলাম উষ্ণ প্রস্রবণে। তবে হতাশ হলাম। অত্যন্ত অপরিচ্ছন্ন। একটা কুণ্ড আছে, তার জল বেশ গরম। কিন্তু মানুষের ধর্মবিশ্বাসের ঠেলায় তার অবস্থা বেশ কাহিল। তবে এখানকার পান্থনিবাসটা দারুণ। পাহাড়-কোলে এই পান্থনিবাস নির্জনতাপ্রেমীদের স্বর্গরাজ্য। কিছুটা সময় কাটিয়ে এগিয়ে চললাম চন্দ্রগিরির দিকে। তপ্তপানি থেকে চান্ধিফুট, আকিলি হয়ে চন্দ্রগিরি ৩০ কিমি।
চন্দ্রগিরির খ্যাতি তিব্বতিদের জন্য। ১৯৫৯-এ দলাই লামার সাথে তাঁর অগুনতি ভক্ত ভারতে শরণার্থী হয়ে চলে আসেন। তাঁদের জন্য ভারত সরকার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসের শিবিরের ব্যবস্থা করে দেয়। এই চন্দ্রগিরি হল এমনই এক তিব্বতি শরণার্থী শিবির। ১৯৬৩ সালে এর পত্তন। এখানকার পদ্মসম্ভব মহাবিহার দেখার মতো। ২০১০-এ এর উদ্বোধন করেন দলাই লামা স্বয়ং। পাহাড়ে ঘেরা এই চন্দ্রগিরি যেন হিমালয়ের বুকে এক টুকরো তিব্বতি গ্রাম।
সাড়ে ১২টা। মনাস্ট্রি বন্ধ হয়ে গেল। যে পথে এসেছি সে পথেই ফেরার পালা। তপ্তপানির পান্থনিবাসে মধ্যাহ্নভোজ সেরে আবার পথ চলা। এখনও বিকেল হতে দেরি, তাই ঠিক করলাম গোপালপুর ছুঁয়ে যাই। ৪টে নাগাদ গোপালপুর। ১৮ বছর আগে দেখা গোপালপুরের সঙ্গে আজকের গোপালপুরের আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সে দিনের জনপদ আজ একটা উন্নত, পরিচ্ছন্ন শহর। বালিয়াড়িতে হাঁটতে হাঁটতে ১৮ বছর আগের সে স্মৃতি কিছুটা রোমন্থন করা গেল। সন্ধে হয়ে আসছে। এ বার ফিরতে হবে।
“কেমন ঘোরা হল?” রিসেপশনে যেন আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন সাহুবাবু। “চলুন একটু বসা যাক”।
সাহুবাবুকে নিয়ে গাড়িবারান্দায় বসলাম। চা-পকোড়াও এসে গেল। তাঁর সাথে ওড়িশা পর্যটন নিয়ে কথা হল। আক্ষেপের সুর তাঁর গলায়। পশ্চিম ওড়িশা আর আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় পর্যটন উন্নয়নে রাজ্য সরকার তেমন কিছু করেনি। এই অমায়িক ভদ্রলোকটির সঙ্গে আড্ডায় তারাতারিণীতে আমাদের শেষ সন্ধেটা দারুণ জমল। কিন্তু আজ আর চাঁদের দেখা মিলল না। আকাশের মুখ ভার। বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া একটি সাইক্লোন ঢুকিয়ে দিয়েছে মেঘ। ঋষিকুল্যাও তাই আজ বিমর্ষ। গাঢ় অন্ধকারে তাকে দেখাও যাচ্ছে না।
—“চিন্তা করো না। তুমি ডাকলে আবার ঠিক আসব”।
মনে মনে ঋষিকুল্যাকে এই আশ্বাস দিয়ে ঘরে ঢুকে গেলাম। রাত গভীর থেকে আরও গভীর হল।
কী ভাবে যাবেন:
হাওড়া থেকে ব্রহ্মপুর যাওয়ার প্রচুর ট্রেন। তবে রাতের ১২৮৬৩ আপ হাওড়া-যশবন্তপুর এক্সপ্রেস আর ১২৮৩৯ আপ হাওড়া-চেন্নাই মেল বেশি সুবিধাজনক । সে ক্ষেত্রে পরের দিন সক্কালে ব্রহ্মপুর পৌঁছে যান। অথবা ভুবনেশ্বর থেকে ভাইজাগ ইন্টারসিটি সকাল ৭টা ১০-এ ছেড়ে পৌনে ১০টায় পৌঁছে ব্রহ্মপুর। স্টেশনে গাড়ি আর অটো পাওয়া যায়। হোটেলকে বলে রাখলে স্টেশন থেকে পিক আপ করে। স্টেশন থেকে তারাতারিণী ৩২ কিমি।
কোথায় থাকবেন:
তারাতারিণীতে থাকার একমাত্র জায়গা নিরুপমা হোটেল।
ঠিকানা: তারাতারিণী হিল, পুরুষোত্তমপুর, গঞ্জাম- ৭৬১০১৮
যোগাযোগ: +৯১-৯৪৩৭৫৮৫৯১৭ (হোটেলের রিসেপশন)
+৯১-৯৪৩৭৩২৪০২০ (অর্জুন সাহু)
ওয়েবসাইট: www.nirupamagroup.com
তারাতারিণী থেকে দ্রষ্টব্য স্থান:
তপ্তপানি- ৮৭ কিমি
চন্দ্রগিরি- ১১৭ কিমি
দারিংবাড়ি- ১১৬ কিমি
গোপালপুর- ৩৭ কিমি
টাম্পারা লেক- ৪০ কিমি
রম্ভা- ৪৫ কিমি
বরকুল- ৭০ কিমি
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।