শ্রয়ণ সেন
দাঁড়িয়ে আছি টেবল-ল্যান্ডে। অন্যান্য দিন আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে নাকি এখান থেকে ডাংস উপত্যকা খুব সুন্দর দেখায়। একটু নীচের হ্রদটা তো স্পষ্ট নজরে আসে। কিন্তু এই মুহূর্তে সবই মেঘ-কুয়াশার চাদরে ঢাকা চলছে। সঙ্গী উতাল হাওয়া আর ঝিরঝিরে বৃষ্টি।
কুম্ভ উপলক্ষে নাসিক বেড়াতে এসেছি দু’ দিন হল। নাসিক শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘোরার পাশাপাশি ঘুরে এসেছি এখান থেকে ৩৫ কিমি দূরে ত্র্যম্বকেশ্বরও। হাতে এখনও এক দিন, তাই একটু দূরে কোথাও যাওয়াই যায়। নাসিক ভ্রমণে আমাদের সারথি দিলীপ বললেন, “চলুন সাপুতারায়, ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। এখন বর্ষাকাল, দারুণ লাগবে”।

দিলীপের কথায় রাজি হয়ে সক্কালেই রওনা হয়েছি সাপুতারার উদ্দেশে। সঙ্গী হয়েছে বৃষ্টি। গত দু’ দিন দু’এক ফোঁটা বৃষ্টি হলেও অবিরাম কোনও ধারাপাত হয়নি, আজ কিন্তু প্রকৃতির মেজাজ অন্য। শহর থেকে বেরিয়ে ধরলাম নাসিক-সাপুতারা সড়ক। চারিদিকে অসাধারণ সৌন্দর্য। বৃষ্টির ফলে আশপাশ যেন আরও সবুজ হয়ে উঠেছে। সমুদ্রতল থেকে হাজার দুয়েক ফুট উচ্চতায় অবস্থিত হলেও নাসিক মোটামুটি সমতল। চার দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পাহাড়শ্রেণি। অদ্ভুত তাদের চরিত্র। বেশির ভাগ পাহাড়ের মাথাগুলো সমতল। আঁকার খাতায় পাহাড়ের যে রকম চেহারা আমরা তুলে ধরি, এখানে কোনও পাহাড়ই তেমন নয়। পাহাড়ের গায়ে মেঘ নেমে এসেছে।
বৃষ্টিভেজা রাস্তা দিয়ে স্পিড তুলেছে আমাদের গাড়ি। আমাদের প্রথম গন্তব্য অবশ্য সাপুতারা নয়, সপ্তশৃঙ্গীগড়। ঘণ্টাখানেক পথ চলার পর এসে পৌঁছলাম বানি। নাসিক থেকে ৪৫ কিমি। পথ পরিবর্তন হল। সোজা রাস্তা চলে গেল সাপুতারা। ডান দিকের পথ ধরলাম, সপ্তশৃঙ্গীগড় ২৩ কিমি। কিছুটা সমতলে চলার পর শুরু হল পাহাড় ভাঙা। গাড়ি ক্রমশ ওপরে উঠতে থাকল। মেঘের রাজ্যে প্রবেশ করলাম আমরা। মেঘ ভেদ করে কিছু দেখাই দায়, তাই খুব সন্তর্পণে গাড়ি চালাচ্ছিলেন দিলীপ। একটু পরেই শেষ হল গাড়ির রাস্তা, এসে পৌঁছলাম সপ্তশৃঙ্গীগড়। সমুদ্রতল থেকে উচ্চতা ৪০০০ ফুট।
সপ্তশৃঙ্গী অর্থাৎ সাতটি পাহাড়। গড় উচ্চতা সমুদ্রতল থেকে সাড়ে চার হাজার ফুট। পুরাণ মতে ৫১ সতী পীঠের একটি এই সপ্তশৃঙ্গীগড়। এখানে সতীর ডান হাত পড়েছিল বলেই বিশ্বাস। সপ্তশৃঙ্গীদেবী এই সাত পাহাড়েই বিরাজ করেন। গাড়ির পথ যেখানে শেষ সেখান থেকে ৪৭০টি সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয় মূল মন্দিরে। কিন্তু বৃষ্টির জন্য সিঁড়ি পিছল থাকবে এই আন্দাজ করে নীচ থেকেই দেবীকে প্রণাম করে ফিরে চললাম বানির দিকে।
কিছুটা গিয়েই গাড়ি থামল এখানকার অসাধারণ একটি ভিউ পয়েন্টে। সপ্তশৃঙ্গীতে আসার সময়েই দেখেছিলাম। গাড়ির দরজা খুলতেই কনকনে হাওয়া। একেই এত উচ্চতা, তার পর বৃষ্টি, সেই সঙ্গে আমাদের কোনও গরম পোশাক না-থাকা, সব মিলিয়ে ঠান্ডার গ্রাসে। ছাতা থাকলেও তাতে কোনও কাজ হচ্ছে না, অগত্যা ছাতা বন্ধ করে ঝিরঝিরে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই গাড়ি থেকে নামলাম। মেঘ ভেদ করে ভিউ পয়েন্ট থেকে আপাতত কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মিনিট খানেক পরেই হঠাৎ করে মেঘ সরে গেল। দেখলাম নীচের উপত্যকাকে। অসামান্য দৃশ্য। নিজের চোখকে পরম স্বস্তি দেয়, এমন দৃশ্য। আবার যাত্রা শুরু হল, এ বার গন্তব্য সাপুতারা। বানিতে

নেমে এসে এ বার ডান দিকে।
আবার আমাদের পাহাড়ি পথে ওঠা শুরু। তবে সপ্তশৃঙ্গীর মতো নয়। ইতিউতি পাহাড়ের গা বেয়ে রাস্তা চলেছে। বানি থেকে ৩২ কিমি হাটগড়। এখানেই মহারাষ্ট্র শেষ, গুজরাত শুরু। হাটগড়কে মহারাষ্ট্রের আরও একটা হিল স্টেশন হিসেবে তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে রাজ্য সরকারের তরফ থেকে।

পৌঁছলাম সাপুতারা। গুজরাতের একমাত্র হিল স্টেশন। সমুদ্রতল থেকে উচ্চতা ৩০০০ ফুটের কিছু বেশি। বৃষ্টির কিন্তু বিরাম নেই। আমাদের প্রথম গন্তব্য টেবল-ল্যান্ড। শহরের প্রাণকেন্দ্র, সাপুতারা লেককে পেরিয়ে রাস্তা উঠতে লাগল ওপরে। বেশ কয়েকটি হেয়ারপিন বেন্ড পেরিয়ে উঠে এলাম এই টেবল-ল্যান্ডে। পাহাড়ের ওপরে সমতল এই জায়গা। বর্ষা উপলক্ষে এখানে এখন সাপুতারা মনসুন ফেস্টিভ্যাল চলছে, তাই সাজো সাজো রব চারিদিকে। এখানে একটা ভিউ পয়েন্ট আছে। নীচের সাপুতারা লেক আর ডাংস উপত্যকা দেখা যায়। কিন্তু এই মুহূর্তে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মেঘে ঢেকে আছে সব কিছু। আমাদের আশপাশেও মেঘের আনাগোনা। মাঝে মধ্যে মেঘের পর্দা আমাদের নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। কিছু ক্ষণের জন্য ঘোড়সওয়ার হয়ে, গরম সেদ্ধ ভুট্টায় কামড় দিয়ে নেমে চললাম লেকের দিকে।
নৈনিতাল, শ্রীনগর, উটি, কোদাইকানালের মতো গুজরাতের একমাত্র এই হিল স্টেশনটির প্রাণকেন্দ্রও এই লেক। প্রথম দিকে মেঘে ঢাকা থাকলেও, আমরা আসতেই মেঘের হয় তো অন্য কিছু মনে হল। লেকের ওপর থেকে নিজের আস্তরণ উঠিয়ে নিলেন। বুঝলাম, বাকি শহরগুলির মতো এই লেকের আয়তনও বেশ বড়। মনসুন ফেস্টিভ্যালের জন্য লেকের ওপর একটা বড়ো বলকে ভাসিয়ে রাখা হয়েছে। উৎসাহী পর্যটকরা বোটিং-এ মেতেছেন।
হাতে সময় অল্প, বিকেলের মধ্যেই নাসিক ফিরতে হবে। তাই বেশি দেরি না করে চলে এলাম সাপুতারা ট্রাইবাল মিউজিয়ামে। জনপ্রতি মাত্র ২ টাকা টিকিটে ঘুরলাম দু’তলা এই মিউজিয়ামটি। গুজরাতের এই ডাংস অঞ্চলটি প্রধানত আদিবাসী মানুষের বসবাস। এই মিউজিয়ামে তুলে ধরা হয়েছে এখানকার মানুষের জীবনযাত্রার যাবতীয় নমুনা। পাশেই রয়েছে একটি অ্যাকুরিয়াম। দেখে নিলাম সেটাও।

কাছাকাছি আরও কিছু দ্রষ্টব্য স্থান ছিল যেমন সানসেট পয়েন্ট, গিরা জলপ্রপাত। কিন্তু সময়ের অভাবে পরের বারের জন্য বাকি রেখে নাসিক ফেরার পথ ধরলাম। আবহাওয়াও পালটে গেল হঠাৎ করে, মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারলেন সূর্যদেব। যেন বললেন, “সাপুতারার বর্ষার রূপ দেখাব বলেই সারা দিন মেঘের আড়ালে ছিলাম”।
কী ভাবে যাবেন?
পশ্চিমবঙ্গবাসীর জন্য সাপুতারা যাওয়ার সব থেকে সহজ উপায় নাসিক হয়ে যাওয়া। ছ’টি ট্রেন হাওড়া থেকে নাসিক রোড যায়। এর মধ্যে বেলা ১:৫০-এর গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস নাসিক রোড পৌঁছয় পরের দিন বিকেল সাড়ে চারটেয়। নাসিক থেকে সাপুতারার দূরত্ব ৮০ কিমি। এখানকার সেন্ট্রাল বাস টারমিনাস থেকে অনবরত বাস চলছে সাপুতারার উদ্দেশে। গাড়ি ভাড়া করেও যেতে পারেন সাপুতারা। এ ছাড়াও হাওড়া থেকে সকাল ৮:২০-র মুম্বই দুরন্ত এক্সপ্রেসে পরের দিন সকাল ৭:৪০-এ পৌঁছন ইগতপুরি। এখান থেকে নাসিক হয়ে সাপুতারার দূরত্ব ১২৭ কিমি।
কোথায় থাকবেন?
সাপুতারার রাত্রিবাসের অঢেল জায়গা। রয়েছে প্রচুর বেসরকারি হোটেল আর রিসোর্ট। রয়েছে গুজরাত পর্যটনের ‘তরণ হিল রিসোর্ট’। অনলাইনে বুক করতে পারেন: booking.gujarattourism.com। তবে নিরামিষাশী রাজ্য হওয়ায় গুজরাতের বেশির ভাগ হোটেলেই আমিষ খাবার পাওয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে বর্ডারের এ পারে হাটগড়েও থাকতে পারেন। এখানে বেশ কিছু বেসরকারি হিল রিসোর্ট তৈরি হয়েছে। আগাম বুকিং না করে গেলেও চলে।
ছবি: লেখক
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।