মৈত্রী মজুমদার
মধ্যপ্রদেশ। ভারতীয় ভূখণ্ডের ঠিক মধ্যবর্তী এই প্রদেশটি তার প্রাকৃতিক সম্পদ, আধ্যাত্মিকতা আর সুদীর্ঘ পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক গাথাকে বুকে নিয়ে বহুকাল ধরেই নীরবে কালযাপন করে এসেছে। পর্যটন বাণিজ্যের যতটা সুযোগ মধ্যপ্রদেশে আছে, সেই তুলনায় তার প্রচার-চাঞ্চল্য অতটা নেই। তাই বেরিয়ে পড়া রহস্য উন্মোচনের অভিপ্রায়ে।
মধ্যপ্রদেশের অন্যতম উল্লেখযোগ্য শহর জব্বলপুর। রামায়ণ বলে, ভৃগু ঋষির পুত্র জাবালির তপস্যাভূমি হওয়ায় এই স্থানের নাম ছিল জবালিপুরম, কেউ বলে পুরাতন নাম ছিল জুব্বালগড়। পরে ব্রিটিশ শাসকের হাত ধরে জব্বলপোর থেকে অধুনা জব্বলপুরে নামান্তরিত হয়েছে।
আর জাবালি মুনির সেই তপস্যাস্থল হল ভেড়াঘাট।
জব্বলপুর শহর থেকে ২০ কিমি দূরে অবস্থিত এই নগর পঞ্চায়েতটির স্থানীয় রাজনীতিতে বিশেষ ভূমিকা আছে। একই সঙ্গে এই স্থানটি অত্যাবশ্যকীয় ভাবে ভ্রমণপিপাসুদেরও কাছে টানবেই।
ভেড়াঘাটের অন্যতম প্রধান উল্লেখ্য স্থানটি হল ধুঁয়া-ধার জলপ্রপাত। পশ্চিমবাহিনী নর্মদা নদী সাতপুরা পর্বতের উত্তরপূর্ব থেকে উৎপন্ন হয়ে আরব সাগরে যাওয়ার পথে এখানে এই জলপ্রপাতটি সৃষ্টি করেছে। তুমুল জলরাশি উপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে নীচে পড়ার সময় যে লক্ষাধিক জলকণা চার দিকে ছড়িয়ে যায়, তা দেখে নদীগর্ভ থেকে ধোঁয়া উঠছে বলে মনে হয়। তাই এই জলপ্রপাতের নাম ধুঁয়া-ধার।
এই জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির বিশালতার ছায়ায় মানব হৃদয়ের ক্ষুদ্রতা-তুচ্ছতাগুলো বিসর্জন দেওয়ার ইচ্ছা জাগবেই, অন্তত জাগার তো কথা। তাই হয়তো কেউ কেউ মা নর্মদার কোলে ফুল, বেলপাতা, নারকেল উৎসর্গ করেন।
কিন্তু কিছু মানুষের জীবনে খিদের জ্বালা এতটাই বালাই, যে সে জ্বালা মেটাতে প্রাণ বিসর্জনের ঝুঁকিও ক্ষুদ্র মনে হয়। তাই এখানে নারকেল উৎসর্গ করার মানুষও যেমন আসেন, সে ভাবেই ৫০ টাকার বিনিময়ে নদীগর্ভে ঝাঁপ দিয়ে সেই নারকেল তুলে আনার মানুষও থাকেন পাশাপাশি। মানব ইতিহাসে আবহমানকাল ধরে চলতে থাকা বৈপরীত্যের কাহিনী হয়তো নর্মদার জলরাশির মতোই চিরবহমান।
ধুঁয়া-ধারের সঙ্গে নর্মদার সামগ্রিক রূপের হদিস পেতে হলে আপনাকে কেবল কার-এ উঠতেই হবে। কেবল কার-এ চড়ে রোপওয়ে দিয়ে যেতে যেতে নিজেকে এক প্রাগৈতিহাসিক কালের যাত্রী মনে হতেই পারে।
বর্ষার ধুঁয়া-ধার এতটাই আগ্রাসী রূপ নেয় যে সে সময় তার কাছে যাওয়া বিপজ্জনক। তাই বর্ষাকালে ওখানে না যাওয়াই ভালো। বছরের অন্য যে কোনও সময় যেতে পারেন ওখানে।
এই অঞ্চলের দ্বিতীয় দর্শনীয় স্থানটি হল ৬৪ যোগিনী মন্দির। দশম শতাব্দীতে কালাচুরি রাজাদের রাজত্বকালে নির্মিত এই মন্দিরটি ভারতের ৪টি যোগিনী মন্দিরের অন্যতম। বাকি ৩টির মধ্যে দু’টি আছে ওড়িশায়। তিন নম্বরটি মধ্যপ্রদেশের অন্যতম বিখ্যাত পর্যটনস্থল খাজুরাহোয়।
ছোট একটি পাহাড়ের ওপর অবস্থিত মন্দিরটিতে পৌঁছতে ১০৫টিরও বেশি ধাপ ভাঙতে হবে। মন্দিরচত্বরের ঠিক মাঝখানে আছে শিব আর দুর্গার মন্দির। এখানে হর-গৌরীর বিগ্রহ নন্দীর পিঠেচড়া। সকালের আলোতে খুবই সুন্দর দেখায় মন্দিরটি। এই মন্দিরকে মাঝখানে রেখে গ্যালারির মতো আবর্তাকারে যোগিনী মূর্তিগুলি সজ্জিত। এই যোগিনীরা আসলে দুর্গার সহচরী।
খুবই সাধারণ ভাবে মন্দিরটি নির্মাণ করা হলেও, স্থানীয় গ্রানাইট পাথরে তৈরি, ললিতাসনা যোগিনী মূর্তিগুলি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে নিখুঁত ভাবে বানানো। খাজুরাহের মতোই প্রাচীন ভারতীয় ভাস্কর্যশিল্পের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যবহনকারী।
মন্দিরের চত্বর থেকে নীচে নর্মদা উপত্যকার দৃশ্য নয়নাভিরাম।
ভেড়াঘাটের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান মার্বেল রক। সেই একই নর্মদা নদী কিন্তু এক্কেবারে অন্য রূপে, অন্য রঙে হাজির এই স্থানে। সমতলে আসার সঙ্গে সঙ্গে শান্ত হয়ে প্রায় স্রোতহীন ভাবে বয়ে যাচ্ছে এই মার্বেল পাথরের পার্বত্য উপত্যকার মধ্যে দিয়ে। এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় একশো ফুট বা তারও বেশি উচ্চতার পাহাড়গুলি অধিক মাত্রায় ম্যাগনেসিয়াম-থাকা লাইমস্টোনের পাহাড়। তাই আলো পড়ে এই পাহাড়ের গা থেকে যে বিচ্ছুরণের সৃষ্টি হয়, তার প্রতিফলনে স্থির জলে এক মোহময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এই সব পাহাড়ের কোনও একটার ভিতরেই আছে জাবালি মুনির গুহা।
ছবি : লেখক
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।