মৌসুমি বিলকিস
পায়েস্তুম শহরটার পাশে তাইরেনিয়ান সমুদ্রের দীর্ঘ বিচ। ঘন নীল জল। জলের মধ্যে ছোট ছোট পাহাড় জেগে আছে। নীল ফুটকিওয়ালা সাদা জেলিফিশরা সাঁতার কাটতে ব্যস্ত। নারী পুরুষ সবাই স্বল্পবাস। কিন্তু এত স্বাভাবিক। বহু দিনের অভ্যাসের সংস্কৃতি। প্রচুর বাচ্চাকাচ্চা বালি নিয়ে খেলছে। এত বাচ্চা দেখব ভাবিনি। ফেরিওয়ালারা ঘুরে ঘুরে জিনিসপত্র ফেরি করছে। কোনও কোনও ফেরিওয়ালা লম্বা একটা স্টিকে মেয়েদের জামাকাপড় ঝুলিয়ে রেখেছে। অনেক বাংলাদেশিও এখানে ফেরিওয়ালা। দিব্যি ইতালিয়ান শিখে নিয়েছে।

এনরিকা আর চিজারের শহর সালের্নো, পায়েস্তুম থেকে আধ ঘন্টা। শহরের প্রাচীন অংশ ঘুরে ঘুরে দেখাল ওরা। এখানেই ষোড়শ শতকে পৃথিবীর প্রথম মেডিক্যাল স্কুল গড়ে উঠেছিল। চিজারে এই শহরের কত যে চমকপ্রদ গল্প জানে। এ শহর খ্রিস্টজন্মেরও আগের পায়েস্তুমের গ্রিক শাসকদের রাজ্য ম্যাসিডোনের অংশ ছিল। গ্রিকদের স্থাপত্যকৌশলে একটা শহর চৌমাথা থেকে শুরু হত। সে রকম চৌমাথায় হাঁটতে গিয়ে গা ছমছম। শহরের প্রাচীন বাসিন্দাদের পদচিহ্ন স্পর্শ করে যাচ্ছি যে! রাস্তাগুলো খুব চওড়া নয়। গলিগুলো আরও অপ্রশস্ত। গলির ওপর দিয়ে বাড়িগুলোর সংযোগসেতু। শত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে নাকি এমন ব্যবস্থা, যাতে প্রচুর সৈন্য এক সঙ্গে ঢুকতে না পারে। সংযোগসেতুগুলো থেকে শত্রুর ওপর গরম জল ইত্যাদি ফেলা হত। কত পুরোনো সব চার্চ। সেগুলোর কোনও কোনওটায় গ্রিক, রোমান, আরব স্থাপত্য একাকার হয়ে গেছে। এ শহরে আরব আক্রমণও ঘটেছিল। এখানে এক সময় নাকি এত দাস আমদানি হয়েছিল যে তাদের কাকে কোথায় থেকে ধরে আনা হয়েছিল কেউই জানত না। এমনকি তারা নিজেরাও নিজেদের পরিচয় ভুলে গিয়েছিল। এক রক্তাক্ত ইতিহাস এ শহরের মজ্জায়। এই দাসদের মৃতদেহ নাকি সৎকার করতে চাইত না কেউ। কারণ, প্রথমত এরা ছিল ঘৃণ্য। দ্বিতীয়ত, এদের ধর্মবিশ্বাস কী, আর কী মতে সৎকার করা উচিত তা ছিল ধোঁয়াশা। শেষে নাকি এরা নিজেরাই নিজেদের চার্চ বানিয়েছিল। এখানকার ধর্ম মেনে নিয়েছিল এরা। এনরিকা চতুর্দশ শতকের এক প্রাচীন চার্চ চিয়েজা দেল আনুনচিয়েতা-র চূড়া সংস্কারে যুক্ত তখন। সেখানেও গেলাম। চার্চগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়। একটা চার্চে দেখলাম নাটকের শো আছে। আর একটায় হচ্ছে কনসার্ট। এ সময় চলছিল সাহিত্য সম্মেলন, অনেকগুলো চার্চে এক সঙ্গে। সেই উপলক্ষে এলাহি বুফের ভাগ পেলাম আমরাও। এই শহরের প্রাচীন বাসিন্দাদের ধারণা ছিল সিংহ মাত্রেই পুরুষ। কিন্তু আশ্চর্য ভাবে একটি চার্চের প্রবেশদ্বারের একপাশে নারী-সিংহের একমাত্র প্রাচীন ভাস্কর্য। প্রাচীন শহরটার পাশে নতুন অংশটাও ঝকঝকে, পরিষ্কার। শহরের এক দিকে তাইরেনিয়ান সমুদ্রের অংশ সালের্নো গালফ। অন্য দিকে পাহাড়ের গায়ে বাড়িঘর। রাতে আলোয় আলোকময় শহরটি দূর থেকে আশ্চর্য মায়াবী।

যে দিন মি. ভার্মার নিমন্ত্রণে গেলাম রোম, দেখি রোমের ট্রেনে জিন্স পরা এক ভিখারিনি। সত্যি আশা করিনি। আমাদের মেট্রোর মধ্যে ঝকঝকে কোনও তরুণীকে ভিক্ষা করতে দেখলে যে দশা হতে পারে। এদের ট্রেন আমাদের মেট্রোর থেকেও সুন্দর। এখানকার স্টেশন রোমা তারমিনি প্রায় শিয়ালদার মতো ভিড়ে ভিড়াক্কার। মজা হল ‘Esci’ (একজিট) লেখা দরজা দিয়ে হুড়হুড় করে ঢুকে যাচ্ছে যাত্রীরা। সত্যি! একটা অন্য ইউরোপ! এখানে নতুন স্থাপত্যের পাশাপাশি প্রাচীন স্থাপত্যগুলো সুন্দর করে সংরক্ষিত। ঝুম্পা লাহিড়ি এখন এ শহরের বাসিন্দা (২০১৪)। ইতালি যাওয়া চূড়ান্ত হতেই সোনালি দাশগুপ্তকে মনে পড়ছিল খুব। তাঁর রসোলিনির সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত একটা বড়সড় চ্যালেঞ্জ ছিল সে কালে।ওখানে পৌঁছনোর কিছু দিন আগেই তিনি মারা গেলেন। ইতালির সর্বপ্রাচীন সিনেমা স্টুডিও চিনেচিত্তা (Cinecitta) দেখলাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটি উদ্বাস্তু শিবিরে পরিণত হয়েছিল। এখন অবশ্য তার সে কৌলীন্য নেই। খুব সুন্দর একটা প্রাচীন বাড়িতে ভারতীয় দূতাবাস। মি. ভার্মা আমাদের ঘুরে ঘুরে দেখালেন। শেষে তাঁর সঙ্গে লাঞ্চ, সি ফুড আর হোয়াইট ওয়াইন। রোমে এলাম, কিন্তু রোমান্স হল কই। শুধুই রোমান হলিডে।
ছবিঃ লেখক ও আলবের্তো ফ্রাঙ্কোর সৌজন্যে
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।