মৈত্রী মজুমদার
জঙ্গলে যত ক্ষণই ঘোরাঘুরি করুন না কেন, জিপ থেকে তো নামা নিষেধ। তাই অনেক ক্ষণ পর নেমে, বিভিন্ন জরুরি কাজ সেরে, হাত-পা সোজা করতে করতে আর গরম চা খেতে খেতে আলাপ-আলোচনা চলছিল অন্যান্য জিপের ট্যুরিস্টদের সঙ্গে। জানা গেল, কেউই যদিও এখনও বাঘের দেখা পাননি, তবে ভল্লুক নাকি দেখা গিয়েছে ‘ঘোস্ট ট্রি’-র কাছে।
আরে হ্যাঁ, ‘ঘোস্ট ট্রি’-র কথা তো বলাই হয়নি। এই জঙ্গলের একটি অন্যতম দ্রষ্টব্য। এটি একটি পুষ্প পত্রহীন (আপাতত), অত্যন্ত সুন্দর সাদা রঙের গাছ। নীল আকাশ আর সবুজ বনানীর প্রেক্ষাপটে তার সুদৃশ্য ডালপালা মেলে সুদৃঢ় ভাবে নিজেকে সাব্যস্ত করছে। গাছটি বছরে চার বার রঙ পাল্টায়। এই কারণেই হোক বা রাতের জঙ্গলের প্রেক্ষাপটে এর অবস্থানের (মনে মনে কল্পনা করলাম) কারণেই হোক- একে ‘ঘোস্ট ট্রি’ বলা হয়। শুধু এই জঙ্গলেরই নয়, এই অঞ্চলেরই এটি একটি উল্লেখযোগ্য ‘ফনা’।
যাই হোক, অন্যদের মুখে ভল্লুকের কথা শুনে আমরাও আমাদের জিপের ড্রাইভার আর গার্ডকে ধরলাম ভল্লুক আর চিতাবাঘ দেখানোর জন্য। সূর্যমামাও তখন অল্প অল্প তেজ দেখাতে শুরু করেছে।
আমাদের ইমোশনাল ব্ল্যাক মেলিং-এর কাছে নতি শিকার করে গার্ড সাহেব ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন, জিপ শ্রবণ তাল-এর দিকে ঘোরাতে। শ্রবণ তাল বা লেক একটি রামায়ণ খ্যাত জলাশয়। এখানেই নাকি রাজা দশরথ হরিণ ভ্রমে শব্দভেদী বান ছুড়ে ঋষিপুত্র শ্রবণকুমারকে মেরে রামায়ণের আখ্যান শুরু করেন।
আবার আমরা গত কালের মতো চোখে-কানে শান দিয়ে জঙ্গলযাত্রা শুরু করলাম। ঠান্ডাও অল্প কম, জিপ যাচ্ছে, থামছে, আবার যাচ্ছে। কোথাও আমরা হরিণের জল, কোথাও একাকী বিরহী ময়ূরের সাক্ষাৎ পাচ্ছি। অল্প অল্প গরম পড়ায় জঙ্গলের গভীরে থাকা প্রাণীরা আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে।
হঠাৎ আমাদের আগে-থাকা জিপ থেকে কিছু নির্দেশ এল। আমাদের গার্ডও আমাদের ঝটিতি নির্দেশ দিল মাথা নিচু করতে। জিপের রড শক্ত করে ধরে বসার নির্দেশ। আর বলা মাত্র জিপটি প্রচণ্ড দ্রুত গতিতে সামনের দিকে এগোতে থাকল।
মনে মনে ভাবছি কীই বা হল ? পিছন থেকে চিতাবাঘে তাড়া করল নাকি ? ভাবতে ভাবতেই ক্যাঁচ!!……শব্দ করে জিপ থামল। মাত্র দু’টি জিপ আর জিপের সামনে দিয়ে দুলকি চালে ডান দিকের ঘন শালের জঙ্গল থেকে বের হয়ে, মাটির রাস্তা পেরিয়ে বাঁ দিকের বাঁশঝাড়ের ঢালে চললেন মহারানি।
হ্যাঁ, একটি কমবয়সি স্লিম অ্যান্ড ট্রিম বাঘিনি। বাঁশঝাড়ে ঢুকে এক বার ঘুরে তাকালেন ক্যামেরা-হাতে হাঁ- হয়ে-থাকা আমাদের দিকে। তার পর পাত্তা না দিয়ে আবার সামনে নিজের গন্তব্যের দিকে হাঁটা দিলেন সুন্দরী, তার অনায়াস ক্যাট-ওয়াক-এ। যত দূর চোখ যায়, আমরা তার যাওয়া দেখতে থাকলাম দু’চোখ ভরে।
‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমার সেই দৃশ্যটির কথা মনে আছে ? যেখানে গুপি-বাঘা গ্রাম থেকে বিতাড়িত হয়ে জঙ্গলে এসে প্রথম বাঘের দেখা পায়। সত্যজিৎ রায়কে নাকি সমালোচনা শুনতে হয়েছিল বাঁশের জঙ্গলে বাঘ দেখানোর জন্য। সেই বিশ্ব-নিন্দুকদের এখানে এনে দেখাতে ইচ্ছা করে বাঁশঝাড়ে বাঘ থাকে থাকে কি না ?
তত ক্ষণে আরও কিছু জিপ এসে হাজির। লক্ষ করলাম এদের মধ্যে গত কালের দেখা বড় বড় দামি লেন্সের ক্যামেরা থাকা বিদেশি পর্যটকরাও আছেন। কিন্তু না, রাজার সাথে সাক্ষাৎ তাদের আর হল না। ওদের চোখে তখন দু’দিন বাঘের সাক্ষাৎ পাওয়া আমরাই সেলিব্রিটি।
কানহা সম্পর্কে দু-চার কথা
১. কানহা যাওয়ার সব চেয়ে ভালো সময় ফেব্রুয়ারি থেকে জুন।
২. কানহা বন্ধ থাকে ১ জুলাই থেকে ১৫ নভেম্বর।
৩. জঙ্গলে ঢোকার তিনটি রাস্তা — কিসলি, ম্যুবিস, সেরাই।
৪. আগে থেকে অনলাইনে বুকিং করে আসা জরুরি। জঙ্গল সাফারি এবং রিসর্ট উভয় ক্ষেত্রেই। আগে থেকে বুকিং করলে হাতির পিঠেও সাফারি করতে পারবেন।
৫. এখানে আসতে পারেন জব্বলপুর (১৭৫ কিমি), নাগপুর (২৯০ কিমি) বা রায়পুর (২১৯ কিমি) হয়ে।
৬. যেটা না উল্লেখ করলেই নয়, সেটা হল —
ক) কানহা রিসর্টের অসম্ভব ভালো আতিথেয়তা এবং অতি সুস্বাদু নিরামিষ খাবারের কথা।
খ) মধ্যপ্রদেশ সরকারের বন দফতরের জঙ্গল সংরক্ষণের প্রতি নিষ্ঠা এবং নিয়মানুবর্তিতার কথা। যে ভাবে এরা অসীম ধৈর্য এবং নিষ্ঠার সঙ্গে অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কানহা পার্কের শৃঙ্খলা ও পবিত্রতা রক্ষা করে চলেছেন, তা নির্দ্বিধায় স্যালুট দাবি করে।
(শেষ)
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।