শ্রয়ণ সেন ঋভু
লক্কিড়িতে বেশ কিছু ক্ষণ কাটিয়ে ফের পথ চলা শুরু।
রাস্তা এ বার ক্রমে নামতে শুরু করল। আড়াই হাজার ফুট উচ্চতা থেকে একেবারে সমুদ্রতলে নামছি। বেশ রোমাঞ্চকর রাস্তা। ন’টা হেয়ারপিন বেন্ড। পাহাড় ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে। আবহাওয়ারও আমূল বদল। প্যাচপ্যাচে গুমোট গরম।
কালিকট পৌঁছনোর পর প্রথমেই চমক। জাতীয় সড়ক থেকে ডানহাতি রেড ক্রস রোডে ঢোকার মুখে ট্র্যাফিক জ্যাম। সামনে কিছু মিছিল চলেছে। বাজনার আওয়াজ আসছে। মনে হচ্ছে যেন বাংলার ঢাকের আওয়াজ।
যা-ই হোক, পুলিশের ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণের সুবিধা নিয়ে মিছিলের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে এক ঝলক নজর গেল মিছিলকারীদের দিকে – বঙ্গললনারা না ? সিঁদুর খেলেছেন সবাই। দু’টি ট্রাকে চলেছেন সপরিবার মা দুর্গা। দশভূজা মহিষাসুরমর্দিনী। আজ তো বিজয়াদশমী। কী আশ্চর্য! এই সুদূর কালিকটে।
হোটেলে চেক-ইন করার সঙ্গে সঙ্গেই সেই মিছিলের হট্টগোল কানে এল। না, এই সুযোগ ছাড়তে দেওয়া যায় না। এক ছুট্টে চলে এলাম নীচে।

প্রথম ট্রাকটির সামনে ব্যানার। তাতে ইংরেজিতে লেখা – ‘শারদীয়া দুর্গাপূজা ২০১৫, স্থান জুবিলি হল, টালি, কালিকট। বেঙ্গলি সমিতি, কালিকট। ১৮ অক্টোবর থেকে ২৩ অক্টোবর’। আজ দশমী, তাই বোঝাই যাচ্ছে মা চলেছেন কৈলাসে। কিন্তু বাংলা থেকে এত দূরে এই কোড়িকোড়ে এত বাঙালি কী করে! আমাদের কৌতূহল মেটালেন প্রসেনজিৎ রায়, উপকূলরক্ষী বাহিনীর কর্মী। তাঁর কর্মস্থল বন্দরশহর কোচি। পুজোর ছুটিতে চলে এসেছেন এই কালিকটে, এখানকার বেঙ্গলি সমিতির পুজোয় শামিল হতে। প্রসেনজিৎ জানালেন, কালিকটের বাঙালিরা গত চার বছর ধরে এখানে দুর্গাপুজো করছেন। এখানে বেশ কয়েক হাজার বাঙালি থাকেন, যারা অলংকারশিল্প এবং নির্মাণশিল্পের বিভিন্ন কাজে জড়িত। কালিকট শহরের এক বর্ধিষ্ণু এলাকা টালি। সেখানকার জুবিলি হলে পঞ্চমী থেকে দশমী, এই ছ’দিন ধরে পুজো চলে। শহরের বাঙালি সমাজ সেখানে একত্রিত হয়। পুজোর পাশাপাশি চলে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আর তার সঙ্গে খাওয়াদাওয়া।
মিছিল দেখতে জড়ো হয়েছেন আশপাশ থেকে আসা স্থানীয় বাসিন্দারা। অনেকেই নিজস্ব ক্যামেরায় তুলে রাখছেন এই মুহূর্ত। দেবী দুর্গাকে বিদায় জানিয়ে ঘরে ফিরলাম ৩৭০ কিমি দীর্ঘ যাত্রার ধকল থেকে একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য। তবে বেশি ক্ষণ ঘরে থাকতে পারলাম না। হাতে সময় খুব অল্প। এখান থেকে ১০ কিমি দূরের বেপোর সৈকতটা এখনই দেখতে হবে।
ভাস্কো-ডা-গামার কালিকট কোঝিকোড় নামেই বেশি পরিচিত। তবে স্থানীয় উচ্চারণে এই শহর কোড়িকোড়। প্রাচীন শহর, এখনও সে ভাবে অতি আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। রাস্তাঘাট সে রকম চওড়া নয়। বাড়ি, ঘরদোরে কেরলের প্রাচীন ঐতিহ্যের পরশ। রেডক্রস রোড দিয়ে এসে ১৭ নম্বর জাতীয় সড়কে উঠলাম। বিখ্যাত মানানচিরা স্কোয়ারকে একটা বেড় দিয়ে এগিয়ে চললাম দক্ষিণে। কিলোমিটার পাঁচেক যাওয়ার পর জাতীয় সড়ক ছেড়ে ডান দিকে পায়ানাক্কাল রোড। আরও ৫ কিমি পথ। ক্রমশ এগিয়ে এল সমুদ্র। এই ভ্রমণে আমাদের প্রথম সমুদ্র দর্শন। খুব সুন্দর সৈকত। এখানকার সব থেকে আকর্ষণীয় ব্যাপার হল, সমুদ্রের মধ্যে দিয়েই বাঁধানো রাস্তা। পশ্চিম দিকে এগিয়ে যাচ্ছি রাস্তাটা দিয়ে। ডান দিকে আরব সাগরের ক্লান্তিহীন ঢেউ, আর বাঁ দিকে শান্ত ব্যাকওয়াটার, যা চেলিয়ার নদী নামেই পরিচিত। ও পারেই রয়েছে জাহাজ তৈরির কারখানা, দেড় হাজার বছরের পুরনো। কিলোমিটার খানেক হাঁটার পর রাস্তাটা শেষ। সামনে জল, বাঁ দিকে জল, ডান দিকে জল। ডাঙা বলতে শুধু যে রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে এসেছি। সূর্যাস্তের সাক্ষী থাকতে ভিড় জমেছে বেশ। সাগরের ঢেউয়ে ডুব দিলেন দিবাকর আর আমরাও ফেরার পথ ধরলাম।

হোটেলে ফেরার পথে এক বার ঢুঁ মারলাম মানানচিরা স্কোয়ারে। ঘড়িতে সন্ধে সাতটা, তাই মানুষজনের ভিড় দেখার মতো। এখানে রয়েছে মানানচিরা দিঘি। সেই সঙ্গে আনসারি পার্ক। আটটা পর্যন্ত খোলা থাকে। কিছু ক্ষণ সময় কাটিয়ে ফিরলাম হোটেলে।
একটা জমজমাট শহরের সৈকত যেমন হওয়া উচিত, কোড়িকোড়ের বিচ ঠিক তেমনই। সাতসকালেই ভিড় করেছেন স্থানীয় মানুষজন। কেউ মেতে আছেন শারীরিক কসরতে, কেউ ছোট্ট বাচ্চাকে প্যারাম্বুলেটরে ঘোরাচ্ছেন। একেই ফুটবল পাগল রাজ্য, তার ওপর আইএসএল জ্বরে আক্রান্ত। এক দল ছেলে এই সক্কালেই নেমে পড়েছে তাদের প্রিয় খেলা নিয়ে। আবার এক দল দেদার সেলফি তুলে চলেছে সমুদ্রকে পেছনে রেখে। মর্নিংওয়াকের অছিলায় চলে এসেছি বিচে। হোটেল থেকে মেরেকেটে ১০০ মিটার। একটু পরেই কোড়িকোড় শহর ছেড়ে পাড়ি দেব আরও উত্তরে, তার আগে শহরের নিঃশ্বাসের জায়গাটাকে একটু ভালো করে চিনে নিচ্ছি। কাছেই আছে ১০০ বছরের পুরনো দু’টি বিধ্বস্ত সেতুস্তম্ভ।

প্রাতরাশ করলাম শহরের বিখ্যাত প্যারাগন হোটেলে। ১৯৩৯-এ স্থাপিত হওয়া এই হোটেল ঐতিহ্য আর আধুনিকতার দুর্দান্ত মিশেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রেড ক্রস রোড আর জাতীয় সড়ক ১৭-এর সংযোগস্থলে। যেমন দারুন খাওয়া, ঠিক তেমনই সস্তা। ব্যস্ত ভ্রমণসূচিতে মাত্র আঠারো-উনিশ ঘণ্টা কোড়িকোড়কে সময় দিতে পেরেছি। তাই অনেক ভালো লাগা আর অনেক কিছু না-দেখতে পাওয়ার আপশোশ নিয়ে শহর ছাড়লাম। আমাদের আজ রাত্রিবাস এখান থেকে ১৮০ কিমি দূরে কাসারগড়ে।

দারুন একটা জায়গা বেছেছিলেন ভাস্কো-ডা-গামা নোঙর ফেলার জন্য। ১৪৯৮ সালের সেই স্মৃতি নিয়ে আজও কিংবদন্তী হয়ে রয়েছে কাপ্পাড় সৈকত। কোড়িকোড় থেকে ১৮ কিমি। গাঢ় নীল জল আর ধবধবে সাদা বালির এক অসাধারণ মেলবন্ধন ঘটেছে এখানে। প্রকৃতির খেয়ালে এই সাদা বালির মধ্যে গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য রঙবেরঙের ফুল। ভাস্কোর পদার্পণের সাক্ষী হিসেবে রয়েছে একটি স্মারকস্তম্ভ।
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।