শ্রয়ণ সেন ঋভু
কাপ্পাড় সৈকতে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আবার পথ চলা শুরু। ১৭ নম্বর জাতীয় সড়ক এক কথায় অনবদ্য। ডান দিকে পশ্চিমঘাট পর্বত আর বাঁ দিকে আরব সাগর। মাঝখান দিয়ে আমরা চলেছি। রাস্তা মাঝে মাঝে পাহাড়ে উঠে যাচ্ছে, আবার কখনও মনে হচ্ছে এই বুঝি সাগরকে ছুঁয়ে ফেলবে। ব্যাকওয়াটার বা খাঁড়ির জন্য বিখ্যাত কেরল। মাঝেমধ্যেই পেরিয়ে যাচ্ছি এ রকম খাঁড়ি। ডান দিকে দু’পাশে নারকেলবাগানের মধ্যে এঁকে বেঁকে ঢুকে যাচ্ছে জল, আর বাঁ দিকে সমুদ্রের মোহনা। কোড়িকোড় থেকে ৬০ কিমি। এল মাহে। কেরল থেকে হঠাৎ ঢুকে পড়লাম পন্ডিচেরির প্রশাসনিক এলাকায়। চার দিকের চেহারাও যেন পাল্টে গেল। বিদেশে এসে পড়েছি মনে হচ্ছে। রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন। রাস্তার নাম, ধারের ঘরবাড়ি সব কিছুতেই ফরাসি ছাপ। তবে সড়ক এখানে বেশ সংকীর্ণ, তাই যানজটের সমস্যা আছে। মাহের সীমানা শেষ, আবার কেরল। একটু পরেই পেরিয়ে গেলাম মুড়াপ্পিলানগাড় সৈকত যাওয়ার রাস্তা। এই সৈকতের বৈশিষ্ট্য, এর ওপর দিয়ে গাড়ি চলে। আমাদের মন্দারমণির মতো। আরও কয়েকটা স্পট দেখার ইচ্ছে ছিল, যেমন কান্নুরের একটু আগে থোটাড্ডা সৈকত আর সেন্ট অ্যাঞ্জেলো ফোর্ট, কান্নুর থেকে ৩২ কিমি উত্তরে অন্নপূর্ণেশ্বরী মন্দির আর এড়িমালা ভিউ পয়েন্ট, কিন্তু সময়ের অভাবে এ যাত্রায় অদেখাই থেকে গেল।

সাড়ে চারটে। পৌঁছলাম বেকাল দুর্গ। কোড়িকোড় থেকে ১৭০ কিমি পথ পাড়ি দিতে লাগল পাক্কা ছ’ঘণ্টা। আসলে জাতীয় সড়ক হলেও কেরলে রাস্তা খুব সংকীর্ণ, তাই গাড়ির গতি ছিল বেশ স্লথ। দুর্গের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকেই শ্রীমুখ্যপ্রাণা মন্দির। বিগ্রহ হনুমান। এর পর টিকিট কাউন্টার। জনপ্রতি পাঁচ টাকা আর ক্যামেরার জন্য ২৫ টাকার টিকিট কেটে প্রবেশ করলাম দুর্গে। বিকেলের বেকালের সৌন্দর্যে আমরা মোহিত। তর্কাতিত ভাবে দেশের সেরা দুর্গগুলির মধ্যে অবলীলায় জায়গা করে নেবে এই বেকাল। ১৬৫০ সালে শিবাপ্পা নায়ক আরব সাগরের ধারে তৈরি করেন এই দুর্গ। পর্তুগাল আর বাকি ইউরোপীয় দেশের সাথে সামুদ্রিক বাণিজ্যে মুখ্য ভূমিকা পালন করত বেকাল। তার এই ‘স্ট্র্যাটেজিক লোকেশন’-এর জন্য অষ্টাদশ শতকে হায়দার আলি আর ব্রিটিশদের মধ্যে অনেক যুদ্ধের সাক্ষী থেকেছে এই দুর্গ। টিপু সুলতানের সময় এই বেকাল ছিল তুলুনাড়ু আর মালাবারের প্রশাসনিক রাজধানী। ১৭৯৯ সালে টিপুর হাত থেকে ব্রিটিশদের ক্ষমতায় চলে আসে বেকাল।

বিশাল জায়গা নিয়ে তৈরি এই দুর্গ। রয়েছে ১২ মিটার উঁচু পাঁচিল। দুর্গের উত্তর দিক ঘেরা রয়েছে জলপূর্ণ পরিখায়। ১৯৯৭ থেকে ২০০১, এই চার বছর ধরে খননকাজ হয়েছে এখানে। মন্দির, আবাসিক স্থান, দরবার হল, টিপুর সময়ের টাঁকশাল এবং আরও অনেক কিছুই খননের পর পাওয়া যায়। উঠলাম অবজারভেশন টাওয়ারে। এখান থেকে দুর্গের তিন দিকেই সাগর দৃশ্যমান। কিছুটা সময় টাওয়ারে কাটিয়ে এ বার আউটার ওয়াল বরাবর হাঁটা। পাঁচিলের দিকে যাওয়ার পথে দেখে নিলাম ধাপওয়ালা জলাধার (স্টেপ্ড ট্যাঙ্ক)। একটি টানেল দেখতে পেলাম। তার দরজা বন্ধ। এই টানেল দিয়ে না কী চলে যাওয়া যায় সাগরের ধারে। এখানে অস্ত্রভাণ্ডারও ছিল। দুর্গের পাঁচিলের ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নজরে পড়ল পাঁচিলের গায়ে একটা গলতা। সেটা দিয়ে গলে একেবারে সমুদ্রের ধারে চলে যাওয়া যায়। অগুনতি পর্যটকের মতো আমরাও সেই পথ ধরলাম। পাহাড়ি পথের মতো করে ঘুরতে ঘুরতে নেমে গেলাম সমুদ্রের ধারে। এটাও দুর্গেরই অংশ। এখান থেকেই উপভোগ করলাম অসাধারণ সূর্যাস্ত। এ বার ফেরার পালা।

সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গেই এলাম কাসারগড়। বেকাল থেকে কাসারগড়, মাত্র বারো কিমি পেরোতে আমাদের সময় লাগল প্রায় এক ঘণ্টা। সৌজন্য, দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা। সন্ধের অন্ধকারে এই শহরটা সম্পর্কে কোনও ধারণাই করতে পারলাম না।
সকাল হল কাসারগড়ে। ছোট কিন্তু সাজানোগোছানো শহর। কাছেই বাসস্ট্যান্ড। আমাদের হোটেলটা শহরের একদম শেষ প্রান্তে। চারি দিকে একটা অদ্ভুত বৈচিত্র। নারকেল গাছের সারি, তার পরেই পশ্চিমঘাটের শ্রেণি। দেখে কোনও ভাবেই বোঝার উপায় নেই যে হোটেল থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার গেলেই দেখা মিলবে সমুদ্রের। তবে আমাদের হাতে সময় খুব অল্প। কোনও ভাবেই কাসারগড়ের সৈকত দেখতে পারব না। কেরল ছেড়ে কর্ণাটকে ঢোকার আগে একটা মন্দির দেখতেই হবে। এই অঞ্চলের খুব বিখ্যাত।
কাসারগড় থেকে ৮ কিমি দূরে মধুবাহিনী নদীর ধারে অবস্থিত শ্রী মদনেশ্বর মন্দির তার স্থাপত্যেই মাতিয়ে দিয়েছে। মাধুর মন্দির নামে পরিচিত এই মন্দির দক্ষিণ ভারতের আর পাঁচটা মন্দিরের থেকে একেবারেই আলাদা। প্রবেশাধিকারে কোনও পুরুষ-মহিলা বাছবিচার নেই, পোশাকবিধি নেই। প্রথমত শিব মন্দির হলেও, এখন গর্ভগৃহে সিদ্ধিদাতা গণেশের বাস। এক পুরোহিতের ছেলে খেলার ছলে গণেশের মূর্তিটি তৈরি করেন। হাতির পিঠের আদলে তৈরি এই তিন তলা মন্দির কেরলের মন্দির-স্থাপত্যের এক চমৎকার নিদর্শন। কথিত আছে টিপু সুলতান মালাবার-কুর্গ আক্রমণের সময়ে এই মন্দির ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখানকার কুয়োর জল পান করার পর তাঁর মত বদল করেন। তবে তাঁর সৈন্যদের তুষ্ট করার জন্য টিপু আক্রমণের চিহ্ন হিসেবে তাঁর তলোয়ার দিয়ে মন্দিরের গায়ে একটি দাগ করে যান। এই দাগ এখনও দেখা যায়।

বেশ কিছুটা সময়ে কাটিয়ে আবার যাত্রা শুরু। গত দু’দিন ধরে না-জানা কেরলের আরও কিছুটা অংশ দেখে এগিয়ে চললাম কর্ণাটকের উদ্দেশে।
ছবি : লেখক
কী ভাবে যাবেন :
কলকাতা থেকে দু’রকম ভাবে যাওয়া যেতে পারে। এক, বেঙ্গালুরু পৌঁছে সেখান থেকে যাত্রা করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে প্রথম রাত্রিবাস সুলথান বাথেরিতেই করা ভালো। দূরত্ব ২৫৮ কিমি। এখান থেকে কোড়িকোড় ৭০ কিমি। দুই, সাঁতরাগাছি থেকে সাপ্তাহিক বিবেক এক্সপ্রেস। প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টে ৫০ মিনিটে ছেড়ে কোড়িকোড় পৌঁছয় শনিবার ভোর ৪টে ৫৫ মিনিটে, কান্নুর পৌঁছয় সকাল ৬টা ৩৫ মিনিটে আর কাসারগড় পৌঁছয় সকাল ৮টা বেজে ৪মিনিটে।
কোথায় থাকবেন :
সুলথান বাথেরি, কোড়িকোড়, কান্নুর আর কাসারগড়ে রয়েছে প্রচুর হোটেল। তবে কোড়িকোড় আর কান্নুরে কেরল পর্যটনের হোটেল দু’টিই সমুদ্র থেকে অনেক ভেতরে। সুলথান বাথেরিতে কেরল পর্যটনের হোটেলে থাকতে পারেন। থাকা-খাওয়া ভালো। অনলাইনে হোটেল বুকিং করতে পারে। কেরল পর্যটনের সঙ্গে যোগাযোগ : www.ktdc.com
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।