শ্রয়ণ সেন ঋভু
কেরলের ওয়েনাড়। পর্যটক মানচিত্রে অতটা পরিচিত নাম না হলেও পর্যটন বৈচিত্রে যে কতটা ভরপুর তা অনেকখানি বুঝলাম এই সুলতান বাথেরি আসার পথে। কর্ণাটকের কুর্গ থেকে রওনা হয়েছি সক্কালেই। কুট্টা শহর দিয়ে কেরলে প্রবেশ করতেই চমক। শুরু হয়ে গেল ‘আপার ওয়েনাড় ওয়াইল্ডলাইফ স্যাঙ্কচুয়ারি’। অভয়ারণ্যের মধ্যে দিয়েই প্রধান সড়ক। বেশ ঘন জঙ্গল। পরতে পরতে সতর্কবার্তা। যে কোনও মুহূর্তে বন্যজন্তু রাস্তা পেরোতে পারে। এক বার ডান দিক, পর ক্ষণেই বাঁ দিক, তাকাতে তাকাতে চলেছি। এই ভাবে ঘাড় ব্যথা হওয়ার আগেই চমক। বাঁ দিকে তাকাতেই লক্ষ করলাম দু’টো হরিণ নিজেদের মধ্যে খোশগল্পে মেতে আছে। কোনও কিছুর তোয়াক্কা নেই যেন। ব্যাগ থেকে বেরিয়ে এল ক্যামেরা। কয়েকটা ছবি তুলে আবার রওনা। কিছুটা পথ এগোতেই আবার থমকালাম। এ বার ডান দিকে। হাতি। একলা, সঙ্গিহীন। গাড়ি থেকে নেমে সে দৃশ্য উপভোগ করছিলাম। ছবিও নিলাম। কিন্তু সতর্ক করলেন সামনের গাড়ির চালক। ইশারায় বুঝলাম, হাতি খেপে উঠতে পারে তাই বেশিক্ষণ না দাঁড়ানোই ভাল। আসলে নাকি সঙ্গিহীন হাতির মতিগতি বোঝা ভার। অগত্যা আবার রওনা।
বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ পৌঁছলাম সুলতান বাথেরি। কেরল পর্যটনের পেপার গ্রোভ হোটেলে চেক-ইন করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম। সুলথান বাথেরির আগের নাম ছিল হন্নারেডু বিথি, যার অর্থ বারোটা রাস্তা। ৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বয়ালনাড় অঞ্চল (এখনকার ওয়েনাড়) দখল করে গঙ্গারা। এর পর কদম্ব, হয়সালা, বিজয়নগর, ওয়াদিয়ার প্রভৃতি সাম্রাজ্যের হাত বদল হয়ে হায়দার আলির দখলে আসে। অষ্টাদশ শতকে টিপু সুলতান এখানকার জৈন মন্দিরকে তাঁর বাহিনীর শিবির হিসেবে ব্যবহার করার ব্যবস্থা করেন। তখন শহরের নাম বদলে হয় ‘সুলতান’স ব্যাটারি’, এখন এটি প্রচলিত সুলতান বাথেরি হিসেবে।
মধ্যাহ্নভোজন সেরে বেরিয়ে পড়লাম মুথাঙ্গা অভয়ারণ্যের উদ্দেশে। শহর থেকে বেরিয়ে মহীশূরের পথে দশ কিমি যেতেই এসে গেল অভয়ারণ্যের প্রবেশদ্বার। লোয়ার ওয়েনাড় ওয়াইল্ডলাইফ স্যাঙ্কচুয়ারি হিসেবেও পরিচিত মুথাঙ্গা। কেরলের এই মুথাঙ্গা, কর্ণাটকের বন্দিপুর আর তামিলনাড়ুর মুদুমালাই, তিনটে নিয়েই এখনকার নীলগিরি বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ। হাতির জন্যই এই অঞ্চল বিখ্যাত। জনপ্রতি ৭৫ টাকা, ক্যামেরার ২৫ আর জিপ সাফারির জন্য তিনশো টাকার টিকিট কেটে চড়ে বসলাম ফরেস্টের জিপে। গাইড হিসেবে পেলাম ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের এক কর্মীকে। এক ঘণ্টার জিপ সাফারিতে হরিণ চোখে পড়ল বেশি। সাফারির একদম শেষ লগ্নে হাতি দর্শন দিল। একটা নয়, অন্তত জনা পাঁচেক। তবে বেশ কিছুটা দূরে। বিকেল ৪টে নাগাদ শেষ হল সাফারি। হোটেলে ফেরার পথে শহরেরই মধ্যে দেখে নিলাম সেই ঐতিহাসিক জৈন মন্দির। চোদ্দ শতকের মন্দির। গ্র্যানাইট দিয়ে তৈরি এই মন্দিরে কেরলের ঐতিহ্য মেনে রয়েছে গর্ভগৃহ, অন্তরাল, মহামণ্ডপ, মুখ্যমণ্ডপ আর নমস্কারমণ্ডপ। তবে নমস্কারমণ্ডপটি মূল মন্দিরের থেকে বিচ্ছিন্ন। গর্ভগৃহে কোনও মূর্তি নেই। মহামণ্ডপে রয়েছে জৈন প্রতিকৃতি। তিনি পদ্মাসনা, ধ্যানমুদ্রার ভঙ্গি তাঁর।
রাত পেরিয়ে সকাল হল। এই ওয়েনাড়কে আরও ভালো করে চিনতে হবে। তাই প্রথম গন্তব্য এড়াক্কাল গুহা। আমাদের হোটেলের কাছেই। হোটেল থেকে বেরিয়ে জাতীয় সড়কে কোড়িকোড়ের (কোঝিকোড়) দিকে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার যেতেই বাঁ দিকের একটা রাস্তার মুখে এড়াক্কালের দিকনির্দেশ দেখা গেল। ঢুকে পড়লাম। আরও কিলোমিটার পাঁচেক। এসে গেল এড়াক্কাল গুহার পাদদেশ। পাহাড়ে তো অল্পবিস্তর বিচরণ করেছি। কিন্তু আম্বুকুটি পাহাড়ের কোলে এই গুহায় ওঠার জন্য এই রকম কালঘাম এর আগে খুব কমই ছুটেছে।
জনপ্রতি ২০ টাকার টিকিট কেটে হাঁটা শুরু। প্রথম ৭০০ মিটার বাঁধানো রাস্তা দিয়ে পাহাড়ে ওঠা। তার পর বাঁধানো রাস্তা উধাও। পাহাড়ের গা বেয়ে খাড়া উঠে যাচ্ছে পথ। কিছুটা অংশ পাথরের ওপর দিয়ে সন্তর্পণে উঠে শেষ চড়াইটা সিঁড়িতে। কারও মাথাঘোরার রোগ থাকলে তাঁর এখানে না আসাই বাঞ্ছনীয়। তবে এক বার ওপরে উঠে গেলে চার দিকের শোভায় মুগ্ধ হতেই হবে। প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষের আঁকা গুহাচিত্রের জন্যই বিখ্যাত এই এড়াক্কাল। পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা রয়েছে বিভিন্ন চিত্র। আমাদের চোখে এগুলো সাধারণ আঁকিবুঁকি হলেও তখনকার দিনের মানুষের কাছে নিশ্চয়ই এর কোনও তাৎপর্য ছিল।
সাড়ে দশটা নাগাদ নেমে এলাম আম্বুকুটি পাহাড়ের পাদদেশে। পরের গন্তব্য পুকোট লেক। জাতীয় সড়কে উঠে ফের বাঁ দিক। আবার কোড়িকোড়ের দিকে গাড়ি ছুটল। পাহাড়ি পথ দিয়ে এগিয়ে চলেছি। রাস্তা মাঝে মাঝে পাহাড় বেয়ে উঠে যাচ্ছে ওপরে, আবার কখনও নীচে নামছে। আধ ঘণ্টা পর পৌঁছলাম কালপেট্টা। ওয়েনাড় জেলার সদর। শহর থেকে চেম্ব্রা পিক দৃশ্যমান। সাড়ে ছ’হাজার ফুট উচ্চতার এই চেম্ব্রা পিক কেরলের দ্বিতীয় উচ্চতম আর ওয়েনাড় জেলার উচ্চতম পাহাড়শীর্ষ।
কালপেট্টা ছাড়িয়ে ভাইথিরি। পথ নির্দেশ মেনে ডান দিকে পুকোট লেকের দিকে গাড়ি ঘুরল। দেড় কিলোমিটার পেরোতেই এসে গেল এই বিরাট হ্রদ। এখানেও জনপ্রতি ২০টাকা প্রবেশ দক্ষিণা। পশ্চিমঘাটের কোলে স্বচ্ছ জলের এই হ্রদের ধার দিয়ে পায়ে চলার পথ করা আছে। অত্যুৎসাহী টুরিস্টরা বোটিং করছেন। আমরা অবশ্য লেকের ধার দিয়ে হাঁটাকেই শ্রেয় মনে করলাম। মিনিট কুড়ি সময় কাটিয়ে পার্কিং-এ ফিরে এলাম। গাড়ি ছুটল লক্কিড়ি ভিউ পয়েন্টের উদ্দেশে।
গাড়িটা জোরে ব্রেক কষে লক্কিড়ি ভিউ পয়েন্টে দাঁড়াতেই আমার সম্বিৎ ফিরল। বেঙ্গালুরু থেকে ওয়েনাড় হয়ে কোড়িকোড় যাওয়ার পথে ফিরে গিয়েছিলাম তিন বছর আগে। সে বারই দর্শন হয়েছিল মুথাঙ্গা, বাথেরি, এড়াক্কাল, পুকোট ইত্যাদি। সেই পথে এ বার আবার।
ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে পড়েছি বেঙ্গালুরু থেকে। মহীশূর হয়ে পৌঁছলাম গুন্দলুপেট। সেখান থেকে বাঁ দিকে কোড়িকোড়ের জাতীয় সড়ক। শুরু হয়ে গেল বন্দিপুর অভয়ারণ্য। জাতীয় সড়ক জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বলে যে কোনও মুহূর্তে বন্যপ্রাণী দেখতে পাওয়ার আশা। বিশেষ করে হাতি দর্শন তো হতেই পারে। কিলোমিটার খানেক অন্তর অন্তর ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সতর্কবার্তা, গাড়ি আসতে চালানোর অনুরোধ করা হচ্ছে। জঙ্গলের মধ্যেই রাজ্য পালটে গেল, কর্ণাটক থেকে আমরা কেরলে ঢুকে গেলাম। আর বন্দিপুর নয়, অভয়ারণ্যের নাম মুথাঙ্গা। মনে পড়ে গেল তিন বছর আগের সেই দিনটার কথা। এই গেট দিয়েই আমরা মুথাঙ্গায় প্রবেশ করেছিলাম। তবে আগের বারের মতো এ বার আর হাতি দর্শন হয়নি। সুলতান বাথেরি থেকে লক্কিড়ির রাস্তাটা এখন বেশ চওড়া হয়েছে। বাজার- দোকানপাট অনেক বেড়েছে। এই পথ পাহাড়ি বলে এখন আর মালুম হয় না তেমন।
কিছুক্ষণ সময় লক্কিড়িতে স্মৃতি রোমন্থনে কেটে গেল। পাহাড়ের ওপর থেকে দেখা যাচ্ছে দূরের সমতল ভূমি, জঙ্গল-পাহাড়ের মাঝেওমাঝে উঁকি দিচ্ছে জাতীয় সড়ক। বোঝাই যাচ্ছে, পাহাড়ের গা বেয়ে ক্রমশ নীচে নেমে গেছে সে। চেরাপুঞ্জি-মৌসিনরামের পর সব থেকে বেশি বৃষ্টি হয় এখানেই, এই লক্কিড়িতে। এক দিকে খাড়া পাহাড় আর অন্য দিক বাধাহীন। তাই সমুদ্র থেকে উঠে আসা সব জলীয় বাষ্প এখানে পুঞ্জিভূত হয়ে ব্যাপক বৃষ্টি নামায়।
খবরের সব আপডেট পড়ুন খবর অনলাইনে। লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।