ভ্রমণ কথা
রূপসী বাংলার সন্ধানে ২/ সাগর থেকে জঙ্গলমহলে

শ্রয়ণ সেন
লজের কর্মী ঘর খুলে দিতেই মনটা অসম্ভব ভালো হয়ে গেল। সুন্দর গন্ধ বেরোচ্ছে। বিশাল বড়ো ঘরটা এক্কেবারে ঝকঝকে তকতকে। বাথরুমটা দেখে মনে হচ্ছে যেন ঘরের থেকেও বেশি পরিষ্কার। ফিনাইলের গন্ধে ম ম করছে। যে রকমটা আমরা চেয়েছি, ঠিক সেটাই পেয়ে গিয়েছি।
শুধু ঘর বা বাথরুমের পরিচ্ছন্নতাই নয়, লজকর্মীরাও যে স্বাস্থ্যবিধি দুর্দান্ত ভাবে মেনে চলছেন, সেটা দেখেও খুব ভালো লাগল। এখানে পৌঁছোনো ইস্তক কাউকে এক মুহূর্তের জন্যও মাস্কবিহীন দেখলাম না।
অথচ তাজপুরের অভিজ্ঞতা ঠিক উলটো ছিল। ভিড়ভাট্টা ছিল না, তাই অসুবিধা হয়নি। কিন্তু সব সময়ে মাস্কবিহীন ব্যক্তিদের থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে চলতে হয়েছে। এখন অবশ্য পরিস্থিতি অন্য রকম।
কোভিডের কল্যাণে এ বার একটু অন্য রকম ভ্রমণের পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনার দ্বিতীয় ভাগে ছিল আজকের এই জার্নিটা।
কলকাতা থেকে দিঘা তো সড়কপথে কত বারই গিয়েছি। কিন্তু আজকের সড়ক সফরটা সত্যিই অন্য রকম। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে উপকূল থেকে চলে এলাম পশ্চিমাঞ্চলের পাহাড়ে। ভূপ্রকৃতি পুরোপুরি বদলে গেল।
এখন আমরা রয়েছি ঝিলিমিলিতে। প্রশাসনিক দিক থেকে এই ঝিলিমিলি বাঁকুড়া জেলার অন্তর্গত। কিন্তু এক দিকে ঝাড়গ্রাম এবং অন্য দিকে পুরুলিয়া জেলা ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে।

ঝিলিমিলির রিমিল ইকো ট্যুরিজম লজটা একটা ছোটো টিলার ওপরে। শাল-পিয়ালের জঙ্গলে ঘেরা বিশাল ঢালু জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কটেজ, টেন্ট হাউজ, গাছবাড়ি। তবে আমরা যেখানে রয়েছি, সেটা এক কালে পঞ্চায়েতের গেস্টহাউসে ছিল, এখন লজের অন্তর্গত।
এখানে এসেই বুঝলাম যে দু’টো দিন ল্যাদ খেয়ে কাটানোর আদর্শ জায়গা এটা। দুপুরে খাবার খেয়ে পেটকে শান্ত করা গিয়েছে। তাই ফিরে গেলাম আজকের সড়কযাত্রার স্মৃতি রোমন্থনে।
আজকের সফরটা মোটামুটি চারটে ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগ, তাজপুর থেকে এগরা হয়ে বেলদা। দ্বিতীয় ভাগ, বেলদা থেকে খড়গপুর হয়ে লোধাশুলি। তৃতীয় ভাগ, লোধাশুলি থেকে ঝাড়গ্রাম হয়ে শিলদা আর চতুর্থ ভাগ শিলদা থেকে বেলপাহাড়ি হয়ে ঝিলিমিলি।
২২৫ কিলোমিটারের এই জার্নিতে দেখলাম কী ভাবে বদলে গেল ভূপ্রকৃতি। এক একটা ভাগে এক এক রকম বৈশিষ্ট্য হাজির হল আমাদের সামনে।
পশ্চিমাঞ্চলের ছোঁয়া থাকলেও বেলদা পর্যন্ত উপকূলীয় ব্যাপারটা ভালো ভাবেই টের পাওয়া যায়। রাজ্য সড়কের দু’ ধারে ইউক্যালিপটাস গাছের সারি। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানখেতের মধ্যে দিয়ে পিচ ঢালা রাস্তা দিয়ে ছুটে চলে আমাদের স্কর্পিও।
বেলদা আসতেই পথ বদল। ঘুরলাম খড়গপুরের দিকে। আট লেনের দুর্দান্ত জাতীয় সড়ক, সোনালি চতুর্ভুজের অংশ। আমার পেছনে চেন্নাই, সামনে খড়গপুর।
চা-বিরতি হল কিছুক্ষণের। কোভিডের আবহে রাস্তার ধারের ধাবা এড়িয়ে চলছি। তাজপুরের হোটেলেই চা বানিয়ে ফ্লাস্কে ঢালা হয়েছিল। সেটার সদ্ব্যবহার হল খড়গপুরের ঠিক উপকণ্ঠে।

একটা চৌমাথা এল। ডান দিকে কলকাতা। আমরা এ বার বামপন্থী। এই সেই জাতীয় সড়ক যা আমাদের কাছে বোম্বে রোড হিসেবে পরিচিত। আগে এর নম্বর ৬ হলেও বর্তমানে সেটার বদল হয়েছে। কলকাতা থেকে খড়গপুরের অংশটা জাতীয় সড়ক ১৬, খড়গপুর থেকে ওড়িশার দেওগড় পর্যন্ত ৫৩। সে যা-ই হোক না কেন আমাদের কাছে এটা জাতীয় সড়ক ৬ থাকবে সব সময়ে।
সোনালি চতুর্ভুজের অংশ হলেও যেটা দেখলাম তা হল, কলকাতা থেকে খড়গপুর পর্যন্ত রাস্তাটা মসৃণ হলেও, খড়গপুরের পর এখনও বিভিন্ন জায়গায় কাজ হচ্ছে।
ধীরে ধীরে ভূপ্রকৃতি বদল হতে শুরু করল। চারিদিকে এখন লাল মাটির রাজত্ব। মালভূমি অঞ্চলে পড়ে গিয়েছি, তাই রাস্তাও কখনও উঁচু, কখনও নিচু।
ঘণ্টাখানেক ছুটে চলার পর এসে পৌঁছোলাম লোধাশুলি। আবার পথ বদল। এ বার ঘুরতে হবে ডান দিকে, অর্থাৎ ঝাড়গ্রামের দিকে।
ঝাড়গ্রাম বার তিনেক এসেছি, কিন্তু সব সময়ে ট্রেনে। অবশ্য সেটা বছর দশেক আগে। তখন শুনতাম গাড়িতে ঝাড়গ্রাম আসার সব থেকে বড়ো সমস্যা হল এই লোধাশুলি-ঝাড়গ্রাম রাস্তাটাই। আইনশৃঙ্খলার অবস্থা বিশেষ সুবিধার ছিল না। আর তখন ঝাড়গ্রাম এবং তার আশেপাশের এই অঞ্চল মানেই মাওবাদীদের দাপট। নিরাপত্তার ব্যাপারটি নিয়ে বড়ো রকমের প্রশ্নচিহ্ন ছিল।
এখন অবশ্য কোনো সমস্যা নেই। রাস্তাটা দু’ লেনের হলেও মসৃণ, পিচ ঢালা। দু’ দিকে শাল-পিয়াল-শিমূলের জঙ্গল। এই গাছের ছায়া রাস্তার সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই যে এখন জঙ্গল অনেকটাই কেটে সাফ করা হয়েছে, তবুও যা আছে তাতে ঝাড়গ্রামের সৌন্দর্য অনেকটাই অক্ষুণ্ণ আছে।
ঝাড়গ্রাম একটা অদ্ভুত শহর। শহরে ঢোকার এক কিলোমিটার আগেও শাল-পিয়ালের ঘন জঙ্গল। সেই জঙ্গলের মাঝেই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ বনোন্নয়ন নিগমের ঝাড়গ্রাম প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র।
জঙ্গল শেষ, ঝাড়গ্রাম শহর শুরু। গাড়ি থেকে ঝাড়গ্রাম শহরটাকে যতটুকু দেখলাম, একটা ব্যাপার অত্যন্ত ভালো লাগল। গোটা শহর মাস্ক পরে রয়েছে। শহরের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছে গাড়ি। ঘাড় ঘুরিয়ে দু’ দিকে তাকিয়ে যাকেই দেখেছি, মুখে মাস্ক। কলকাতা থেকে বেরোনোর পর কোথাওই মাস্কের এমন চল দেখিনি, যেটা ঝাড়গ্রামে এসে দেখছি। খুব ভালো লাগল।
ঝাড়গ্রাম ছেড়ে এ বার এগিয়ে চললাম শিলদার দিকে। পথে পড়ল দহিজুড়ি, বিনপুর। কুখ্যাত সব জায়গা ছিল বছর দশেক আগেও। সংবাদের শিরোনামে প্রায় রোজই এই সব জায়গার নামোল্লেখ থাকত। কেন, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।
এখন অবশ্য সে সমস্যা নেই। গাড়ি ছুটে চলেছে। দু’ ধারে ধানখেত। ও হ্যাঁ, জঙ্গল কিন্তু এই রাস্তায় উধাও, সেটা ফিরল শিলদা থেকে বেলপাহাড়ির দিকে ঘোরার পর।
এই সড়কযাত্রার শেষ অংশ এটা। নিঃসন্দেহে সব থেকে রোমাঞ্চকর অংশ। জঙ্গল তো এলই, সেই সঙ্গে দূরে দেখা যাচ্ছে পাহাড়শ্রেণি। অবশ্য জমিটাও পাহাড়ি পাহাড়ি। কখনও সে নিজের থেকে উঠে যাচ্ছে, আবার নেমে যাচ্ছে।
রাস্তার ধারে কী একটা দেখা যাচ্ছে যেন! জোরে ব্রেক কষল আমাদের সারথি।
ওমা! এ তো ময়ূর! বেলপাহাড়ি ঢোকার আগেই ময়ূরদর্শনে বেশ তৃপ্তি পেলাম। পেখম তোলেনি, কিন্তু সে আমাদের ছবি তোলার আবদার মিটিয়েছে।

চলে এলাম বেলপাহাড়ি। ঝাড়গ্রাম জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জনপদ এই বেলপাহাড়ি। বাংলার পর্যটন মানচিত্রেও এর গুরুত্ব অপরিসীম।
পাঁচ নম্বর রাজ্য সড়ক দিয়ে ঝিলিমিলির দিকে এগোতে গিয়েই চোখে পড়ল একের পর এক পর্যটনস্থলের দিকনির্দেশ। কোনোটায় ডান দিকে দেখানো রয়েছে ঘাগরা জলপ্রপাত, একটায় বাঁ দিকে দেখানো রয়েছে খান্ডারিনি লেক। চাতন ডোংরি ভিউপয়েন্ট, পবন পাহাড় ভিউ পয়েন্ট, গজপাথর সরোবর, কাঁকরাঝোড়-সহ আরও কত জায়গায় যে যাওয়া যায় বেলপাহাড়ি থেকে। নতুন পর্যটনস্থল ঢাঙিকুসুমও খুব একটা দূরে নয়।
বেলপাহাড়িতেও এখন রাত্রিবাসের ব্যবস্থা রয়েছে। তাই একবার এখান থেকেই এই সমস্ত পর্যটনস্থল দেখতে হবে।
এগিয়ে চললাম রাজ্য সড়ক ধরে। জেলা বদল হয়ে গেল। ঝাড়গ্রাম ছেড়ে ঢুকে পড়লাম বাঁকুড়া। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাঁ দিকের একটি দিক নির্দেশ জানিয়ে দিল ঝিলিমিলি সেই দিকেই।
ছ’ ঘণ্টার জার্নিতে বেদম খিদে পেয়ে গিয়েছে। এখন প্রাথমিক লক্ষ্য পেটবাবাজিকে ভরিয়ে তাকে শান্ত করা। (চলবে)
এই ভ্রমণকাহিনীর প্রথম অংশ পড়ুন এখানে।
ভ্রমণ কথা
রূপসী বাংলার সন্ধানে ৪/ সিঙ্গির শান্তিনিকেতনে দুটো দিন

শ্রয়ণ সেন
আমাদের ছোটো নদী। নাম তার ব্রহ্মাণী। মধ্য-কার্তিকে অর্থাৎ নভেম্বরের শুরুতেও টলটলে জল তার। ছলাত ছলাত শব্দে সে এগিয়ে চলেছে নিজ গন্তব্যে।
সম্রাটদা বললেন, “মাত্র ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদী। ভাতারের কাছে জন্ম নিয়ে কাটোয়ায় গঙ্গায় গিয়ে মিশেছে।”
নদীর ধারের পাড়টায় বসে থাকতে দিব্য লাগছে। এখন সকাল ৮টা। চামড়ায় টান ধরতে শুরু করে দিয়েছে। একটা শিরশিরানি ব্যাপার রয়েছে আবহাওয়ায়।
গতকাল এখান আসার পর থেকেই সম্রাটদা, বউদি আর তাঁর দলবল যে ভাবে আমাদের দিকে খেয়াল রাখছে, সেটা ভাষায় ব্যাখ্যা করা যাবে না। আজ তো আবার দুপুরে দেশি খাসির ব্যবস্থা হবে বলেও জানিয়ে দিয়েছে সম্রাটদা।

গতকাল এখানে এসেছি। পৌঁছোতে যে এমন দেরি হয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি। আসলে ঝিলিমিলি থেকে রওনা হয়েছিলাম পৌনে ন’টা নাগাদ। ২৩০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পূর্ব বর্ধমানের সিঙ্গি গ্রামে আসতে বড়োজোর ঘণ্টা পাঁচেক লাগত। কিন্তু বাধ সাধল বাঁধ।
মানে, ঝিলিমিলি থেকে রানিবাঁধ, বাঁকুড়া, বেলেতোড় হয়ে বড়জোড়া পৌঁছে সেখানে আধ ঘণ্টা জ্যামে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার পর জানতে পারলাম দুর্গাপুর ব্যারেজ বন্ধ। লকগেট ভেঙে গিয়েছে। গাড়ি যাবে না।
অগত্যা গাড়ি ঘুরিয়ে ফের বেলেতোড় এসে, সেখান থেকে বাঁ দিকে ঘুরলাম। সোনামুখী, খণ্ডঘোষ হয়ে বর্ধমান পৌঁছোতেই দুপুর দেড়টা বেজে গেল।
বর্ধমান থেকে ভাতার, বলগোনা, চন্দ্রপুর হয়ে সিঙ্গি যখন পৌঁছোলাম তখন ৩টে বাজে। পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে রীতিমতো।
সম্রাটদার শান্তির নিকেতনে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামতেই লেবুর শরবত চলে এল। ওপরে পুদিনা পাতা ভাসছে। আহ! কী অসম্ভব তৃপ্তি যে পেলাম। গোটা রাস্তার ক্লান্তি যেন নিমেষের মধ্যে দূর হয়ে গেল।
অনেকেই প্রশ্ন করবেন, দক্ষিণবঙ্গে গন্ডা গন্ডা তথাকথিত ‘টুরিস্ট স্পট’ থাকতে কেন পূর্ব বর্ধমানের এক গ্রামকে বেছে নিলাম দু’টো দিন থাকার জন্য।
সত্যি কথাই, ভ্রমণ-মানচিত্রে খুব একটা পরিচিত নয় এই সিঙ্গি গ্রাম। তবে বাংলায় মহাভারত রচয়িতা কাশীরাম দাসের জন্য এই গ্রামের খ্যাতি যথেষ্ট। এই গ্রামেই তাঁর জন্ম, রয়েছে তাঁর বসতবাটীও।
কাশীরাম দাসের বসতবাটী তো দেখতে যাবই, কিন্তু সেটা প্রাথমিক উদ্দেশ্য নয়। আসলে সম্রাটদার ডাককে উপেক্ষা করতে পারিনি। সেই জানুয়ারিতে ফেসবুকে আলাপ হয়েছে ভদ্রলোকের সঙ্গে। তার পর তো লকডাউন হয়ে গেল।
জুনে লকডাউন উঠতে সম্রাটদাই বলতে থাকলেন এক বার তাঁর শান্তিনিকেতনে আসতে। প্রথমে অবাক লাগত। কেন যাব তাঁর শান্তিনিকেতনে?
প্রশ্নের উত্তরে তিনিই বলেন, “পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অলস বিশ্রাম যাপন করতে অথবা নিজের কাছে একলা হতে, ফুসফুস ভরে বিশুদ্ধ অক্সিজেন নিতে, মুখরোচক অথচ ১০০% বিষমুক্ত খাবারের স্বাদ নিতে, আর বর্ষার তো একটা অন্য রূপ আছেই, তা দু’ চোখ ভরে দেখতে এখানে আসতেই হবে।”
বর্ষার রূপ দেখা হল না বটে, তবে এখন যা রূপ দেখছি, তা-ই বা কম কীসে! বাড়ির তিনতলায় ছাদ। সেই ছাদ সংলগ্ন দু’টো ঘর আমাদের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘরের জানলা দিয়ে পূর্ব ও দক্ষিণ আর ছাদে দাঁড়ালে উত্তর ও পশ্চিম, যে দিকে তাকাই শুধু সবুজ আর সবুজ। এই আমার শস্যশ্যামলা বাংলা।

পাহাড় বা সমুদ্র তো কতই দেখেছি, কিন্তু এমন ভাবে সবুজ বাংলাকে দেখার ভাগ্য আর কত জনের হয়! মনে ভরে যাচ্ছে আমার। বাড়িটার নাম শান্তিনিকেতন হোমস্টে। সিঙ্গি গ্রামের বাসিন্দা সম্রাট বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বাবা শান্তিময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে এই হোমস্টের নাম দিয়েছেন।
হাতমুখ ধুয়ে মধ্যাহ্নভোজন করতে বসে চক্ষু চড়কগাছ। কত রকম পদের ছড়াছড়ি। গুনে গুনে ১৪ রকম। পেট ভরে খাওয়ার পর শেষ পাতে ঠান্ডা ঘোলটা যেন অমৃত।
সম্রাটদা বলেন, এখানে কোনো রেস্টুরেন্ট নেই। সিঙ্গি গ্রামের পরিশ্রমী মানুষের সহযোগিতায় বাড়ির নিজস্ব রান্নাঘরে অতিথির জন্য খাবার তৈরি করা হয়।
বাড়িতেই আছে বিভিন্ন ধরনের ফল, সবজি এবং বিভিন্ন গাছে ছাওয়া দু’টি ছোটো বাগান। সবজিতে কোনো রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয় না। এ ছাড়া আছে খুব ছোট্ট একটি বাঁধানো পুকুর, যেখানে ছোটো মাছ চাষ করা হয়।
বাগানের সেই সবজিই বাড়ির রান্নাঘরে ঘরে তৈরি তেল এবং বিভিন্ন মশলা দিয়ে রান্না করা হয়। তা ছাড়া ঘি-ও বাড়িতেই তৈরি।
পাশের মসজিদ থেকে আসা আজানের সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়েই সবুজ ধানখেতে টুক করে ডুব দিল সূর্য। সন্ধ্যা নামল সিঙ্গিতে। সম্রাটদাকে নিয়েই জমে উঠল আমাদের সন্ধ্যার আড্ডা। রাত বাড়ল সিঙ্গিতে, সেই সঙ্গে অল্প অল্প ঠান্ডাও।
পরের দিন সকাল ৭টায় টোটো এসে হাজির শান্তিনিকেতনের গেটে। সিঙ্গি গ্রামের মধ্যে দিয়ে সরু বাঁধানো রাস্তা ধরে সে আমাদের নিয়ে চলল।
ধান পাকতে শুরু করেছে। তাই সবুজ ব্যাপারটা কোথাও কোথাও সোনালি রঙ নিচ্ছে। ধান কাটার কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে।
ছোটো মেইগাছি গ্রাম পেরিয়ে এসে পৌঁছোলাম ব্রহ্মাণী নদীর পাড়ে। জায়গাটা সিঙ্গি থেকে ২ কিলোমিটার দূরে। ব্রহ্মাণীকে দেখতে দেখতেই সময়ে কেটে যাচ্ছিল। সম্বিৎ ফিরল সম্রাটদারই ফোনে। শান্তিনিকেতনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে গরম গরম লুচি।
ফুলকো ফুলকো গরম লুচি সাঁটিয়ে প্রাতরাশ করলাম। এর পর আরও এক দফা সিঙ্গি গ্রাম ঘোরা। চলে এলাম লৌকিক দেবতা ক্ষেত্রপাল ঠাকুরের থানে।
কোনো বিগ্রহ নেই এখানে। অতি প্রাচীন একটি বটগাছকে পুজো করা হয়। গ্রামের প্রান্তিক দেবতা। আষাঢ়-নবমী বা উলটোরথের দিন এখানে বিশাল মেলা বসে। বেশ কয়েক দিন ধরে সেই মেলা চলে। কিন্তু এ বার করোনার কারণে, সেই মেলা হয়নি। তাই সিঙ্গির মন খারাপ।

মন খারাপ হয়ে যায় আরও একটা জিনিস দেখলে। সেটা হল কাশীরাম দাসের বসতবাটী। মহাকবি কাশীরামের বাড়ির অতিভগ্ন দশা।
কয়েকটি দেওয়াল ছাড়া এখন কিছুই প্রায় টিকে নেই। এখানে পাতালঘর রয়েছে। শোনা যায় তাঁর ওপরে আক্রমণ আটকাতে এই পাতালঘরে নিজের সব পাণ্ডুলিপি নিয়ে আত্মগোপন করতেন কাশীরাম।
বাড়িটি এখন সাপখোপের আখড়া হয়েছে। তবে বাড়িটি যাদের দেখভালে রয়েছে তাদের এবং সম্রাটদা-সহ সিঙ্গি গ্রামের নাগরিক সমাজের প্রচেষ্টায় এখানে একটা স্মৃতিমন্দির তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। বর্তমানে বাড়ির ঠিক সামনে একটা গেট তৈরি হয়েছে, যা এই মন খারাপের আবহেও কিছুটা স্বস্তি দেয়।
ফিরে আসি শান্তিনিকেতনে। এ বার এখানকার বাগান ঘুরে দেখার পালা। কত শাকসবজি ফলেছে এখানে, নানা রকমের আম গাছ রয়েছে। ডিসেম্বরেও আম ফলে, এমন গাছ রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন মশলার গাছ আর কত কী! এই বাগান ঘুরে দেখতে দেখতেই ঘণ্টা খানেক সময়ে কেটে যায়।
কথা দিয়েছিলেন সম্রাটদা। সেইমতো দুপুরের পাতে দেশি খাসির ঝোল। চার পিস খাওয়ার পরেও পেট আইঢাই করল না! সত্যিই, এখানকার তেলমশলা এবং রান্নার গুণ রয়েছে।

সিঙ্গির অবস্থান দারুণ জায়গায়। কাছেই ঐতিহাসিক দুই শহর কাটোয়া ও দাঁইহাট। কালনাও খুব বেশি দূরে নয়। কুমুদরঞ্জন মল্লিকের কোগ্রামও গাড়িতে ঘণ্টাখানেকেরই পথ। সিঙ্গিকে আশপাশ দিয়ে ঘিরে রেখেছে কয়েকটি সতীপীঠ।
এমনই এক সতীপীঠে গেলাম বিকেলে। ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যা মন্দির। সিঙ্গি থেকে ১৮ কিমি। গ্রামে ঢুকতেই হাজার বিঘের ক্ষীরদিঘি, যেখানে পড়েছিল সতীর ডান পায়ের আঙুল। এই দিঘিতেই থাকে দেবীর মূর্তি। ওই মূর্তি বছরে মাত্র ছ’ দিন পুজোর জন্য দিঘি থেকে তোলা হয়।

ক্ষীরদিঘির পাড়ে অসাধারণ সূর্যাস্ত দেখে ফিরে এলাম শান্তিনিকেতনে। আমাদের ভ্রমণের আজই শেষ সন্ধ্যা। স্মৃতি রোমন্থনের সন্ধ্যা।
কোভিডের আবহে ৮ দিনের ট্যুর করছি এবং পাঁচ জনের দলে চার জনের বয়স ৫৮ থেকে ৭১-এর মধ্যে, এটা শুনে অনেকেই চোখ কুঁচকেছিল। অনেক রকম ভয় দেখিয়েছিল। বলা হয়েছিল, বেড়াতে বেরিয়ে অসুস্থ হয়ে ফিরব।
কিন্তু সেই সব ভয় আমরা অতিক্রম করতে পেরেছি। সব বাধা টপকে অসাধারণ একটা ট্যুর করতে পেরেছি। এই ৮ দিনের ভ্রমণে বুঝে গিয়েছি, বেড়াতে বেরোলেই অসুস্থ হয়ে ফিরতে হবে, এই ধারণা এক্কেবারেই অমূলক।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব জায়গায় চললে, ভিড় এড়িয়ে গেলে, সর্বজনীন জায়গায় মাস্ক না খুললে, মাঝেমধ্যেই স্যানিটাইজারে হাত সাফ করে নিলে আপনার সংক্রমণের কোনো ঝুঁকিই নেই।
আমি তো বলব, কলকাতায় একটু অসতর্ক হলেই সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়, কিন্তু ফাঁকা জায়গায় বেড়াতে গেলে সে সবের কোনো আশঙ্কা নেই।
ভ্রমণ আমাদের করতেই হবে। ভ্রমণ এক দিকে আমাদের মনকে যেমন ভালো করে, তেমনই ভ্রমণ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মানুষজনদেরও সাহায্য করে, তাদের মুখে হাসি ফোটায়। সেটা তাজপুর, ঝিলিমিলি আর এই সিঙ্গিতে এসে বুঝেছি।
তাই ভ্রমণ চলবেই। আপাতত বাড়ি ফিরেছি, কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে আবার বেরিয়ে পড়ব, হ্যাঁ সব স্বাস্থ্যবিধি মেনেই।
আর এই সিঙ্গি তো রয়েছেই। সম্রাটদা এত দিন আমার ভার্চুয়াল বন্ধু ছিলেন, এখন মুখোমুখি আলাপের পর নিজের দাদার মতো হয়ে গিয়েছেন। বউদি আর শান্তিনিকেতনের বাকিদের যা আতিথেয়তা পেলাম, তা-ও অনবদ্য।
তাই, কলকাতার একঘেয়েমি জীবন থেকে মুক্তি পেতে আর কোথাও না হোক এই শান্তিনিকেতনে যে আসবই, তা বলাই বাহুল্য। (শেষ)
পুনঃ সিঙ্গিতে শান্তিনিকেতন হোমস্টেতে থাকতে চাইলে যোগাযোগ করুন: ৭০৪৪৭৯১৪৩৬
এই ভ্রমণকাহিনীর বাকি ৩টে পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এখানে।
ভ্রমণ কথা
রূপসী বাংলার সন্ধানে ৩/ রোমান্টিক ঝিলিমিলির আশেপাশে
ধীরে ধীরে আলো ফুটছে। অদ্ভুত একটা রোমান্টিকতা ছড়িয়ে রয়েছে চার দিকে। সবুজের সমুদ্র।

শ্রয়ণ সেন
‘কোঁ কোঁর কোঁ’…‘কোঁ কোঁর কোঁ’…
মোরগের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। ভোর সাড়ে পাঁচটা। কলকাতায় থাকতে এই ডাকটা তো শুনতেই পাওয়া যায় না। তাই আজকের সকালটা সত্যিই একটা বিশেষ তাৎপর্যের।
ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়াতেই অদ্ভুত একটা উপলব্ধি হল। ধীরে ধীরে আলো ফুটছে। অদ্ভুত একটা রোমান্টিকতা ছড়িয়ে রয়েছে চার দিকে। সবুজের সমুদ্র।
মালভূমি অঞ্চলের ছোঁয়া। চারিদিকে জঙ্গল আর ছোটোখাটো পাহাড়। ভৌগোলিক কারণেই এই নভেম্বরের শুরুতেই বেশ ঠান্ডা ঝিলিমিলিতে। কাল রাতে পাখা তো চালাতেই হয়নি, বরং কম্বল গায়ে দিতে হয়েছে। এখনও গায়ের ওপরে হালকা চাদর। বলা যায়, এই ঝিলিমিলিতেই শীতের নতুন মরশুমকে স্বাগত জানালাম।
এই রিমিল লজটাই কিন্তু ঝিলিমিলির প্রধান আকর্ষণ। শাল-পিয়াল-পলাশ-মহুয়া গাছে ভরে রয়েছে লজের চত্বর। এ ছাড়া কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, আম, জাম, কাঁঠাল গাছ তো রয়েছেই।

নেমে এলাম লজ চত্বরে। পরিবেশটা প্রাতর্ভ্রমণের জন্য আদর্শ। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুব আকাশ রাঙিয়ে সূর্যদেব উঠলেন। লম্বা লম্বা গাছের আড়াল ভেদ করে ধীরে ধীরে লজ চত্বরে তাঁর আশীর্বাদ ঝরে পড়তে লাগল।
অন্য কোথাও না গিয়ে, অবলীলায় একটা গোটা দিন স্রেফ বিশ্রাম নিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায় রিমিলে। যদিও আমরা টুকটাক কিছু সাইটসিয়িংয়ের সিদ্ধান্ত নিলাম।
সত্যি কথা বলতে কী! ঝিলিমিলির আশেপাশে এত কিছু দেখার আছে, যে সব কিছু দেখতে হলে অন্তত চারটে দিন থাকতেই হবে এখানে। কিন্তু আমাদের হাতে তো অত সময় নেই।
দুয়ারসিনির নাম কত শুনেছি। সেই দুয়ারসিনি ঝিলিমিলির এত কাছে, সেটা আগে জানতাম না। আগে মাওবাদীদের সমস্যা থাকলেও এখন অবলীলায় যাওয়া যায় সেখানে। লজকর্মীদের কাছে এমন আশ্বাস পেয়েই প্রাতরাশ করে বেরিয়ে পড়লাম।
ঝিলিমিলি থেকে বেরিয়ে কুইলাপালের কিছু আগেই ঢুকে গেলাম পুরুলিয়ায়। এর পর এল বান্দোয়ান। সড়ক যোগাযোগের প্রেক্ষিতে বান্দোয়ানের গুরুত্ব অপরিসীম।
বান্দোয়ান থেকে ঘুরলাম বাঁ দিকে। পথের প্রথম অংশটা ধানখেতের মধ্যে দিয়ে হলেও কিছুক্ষণের মধ্যে এগিয়ে এল জঙ্গল। আমাদের চারিদিকে ঘিরে ধরল পাহাড়। শুরু হয়ে গেল ঘাটরাস্তা। রাস্তাটা খুবই সরু কিন্তু পিচের।
বান্দোয়ান থেকে ঘণ্টাখানেক পথ চলার পর এসে পৌঁছোলাম দুয়ারসিনি। এখান থেকে মাত্র দু’ কিলোমিটার দূরে আসানপানি, সেটাই বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমানা। কিছু দূরেই ঘাটশিলা।
দুয়ারসিনি ঢোকার একটু আগেই পড়ল ভালোপাহাড়। আদতে গ্রামটার নাম ডঙ্গোরজুরি। কিন্তু এই নাম ওখানকার লোক প্রায় ভুলেই গেছে, সবার কাছে এখন এটা ‘ভালোপাহাড়’।
‘সভ্যতা’র গ্রাস থেকে প্রকৃতিকে বাঁচানোর তাগিদে এগিয়ে এসেছিলেন কয়েক জন সাহসী মানুষ। নেতৃত্বে সাহিত্যিক কমল চক্রবর্তী। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও ‘ভালোপাহাড়’-এর কাজ থেমে থাকেনি।
দক্ষিণবঙ্গের ‘ডুয়ার্স’ হিসেবে খ্যাতি দুয়ারসিনির, যে শব্দটির অর্থ ‘দ্বাররক্ষক ঠাকুর’। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী এখানে যে খাড়া পাহাড় রয়েছে, তার ওপর দিয়েই লঙ্কার রাজা রাবণ স্বর্গে যাওয়ার সিঁড়ি তৈরি করতে চেয়েছিলেন।

২৯৪ হেক্টরের প্রাকৃতিক জঙ্গলে ঘেরা দুয়ারসিনি। গভীর অরণ্যের মাঝেমাঝে ছোটো ছোটো টিলা। পাহাড় আর পাহাড়ের মাঝ দিয়ে আঁকাবাঁকা পথে বয়ে চলা সাতগুরুম নদী।
তবে দুয়ারসিনিকে বুঝতে এখানে একটা রাত থাকতেই হবে। তা হলেই পাহাড়, জঙ্গল, নদীর সঙ্গে এখানকার নির্জনতাও উপভোগ করা যাবে।
এক যুগ আগেও দুয়ারসিনিতে টিলার ওপরে অবস্থিত বনোন্নয়ন নিগমের তিনটি কটেজে ভিড় লেগে থাকত পর্যটকদের। কিন্তু আশেপাশে মাওবাদীদের ল্যান্ড মাইন বিস্ফোরণের পর বন্ধ হয়ে যায় পর্যটকদের আনাগোনা।
অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে থাকতে ধ্বংস হয়ে যায় নিগমের কটেজগুলি। দীর্ঘদিন পর আবার এখানে পর্যটনক্ষেত্র গড়ে তোলার জন্য নতুন করে কটেজ তৈরির ব্যাপারে উদ্যোগী হয় নিগম। বর্তমানে কটেজগুলি পুরো তৈরি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কবে থেকে অনলাইন বুকিং শুরু হবে, বা কবে থেকে পর্যটকরা এখানে রাত কাটাতে পারবেন, সে ব্যাপারে কারও কাছেই কোনো তথ্য নেই।
ঠিক যেমন কেউ জানে না যে সুতানের নবনির্মিত বন বিশ্রামাগারে কবে মানুষজন রাত কাটাবেন।
দুয়ারসিনির মতোই পর্যটকদের পা বিশেষ পড়ে না দক্ষিণবঙ্গের গভীরতম জঙ্গল সুতানে। ঝিলিমিলির ‘বারোমাইল’ জঙ্গলের একটা অংশ এই সুতানের জঙ্গল।
এই ‘বারোমাইল’ জঙ্গলের বুক চিরে বেরিয়ে যাচ্ছে ঝিলিমিলি-রানিবাঁধ রোড। রাস্তা আঁকাবাঁকা, পাহাড়ি।

মসৃণ রাস্তার লোভে পড়ে গাড়ি যদি বেশি স্পিড তুলে ফেলে তা হলে সুতানের জন্য নির্দিষ্ট ডান দিকটা মিস করার প্রবল সম্ভাবনা। মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করে না, তাই গুগল ম্যাপ কোনো ভরসা দেবে না।
যা-ই হোক, আমাদের গাড়ি সেই ভুল করেনি। ডান দিকের সরু রাস্তায় ঘুরতেই সম্পূর্ণ অন্য একটা জগতে প্রবেশ করলাম যেন।
পাথুরে রাস্তা যাচ্ছে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, একধারে খাদ, প্যাঁচানো রাস্তা, প্রাচীন গাছপালা। আমাদের সাধারণ প্রবণতা, কোথাও যাওয়া মানে একটা গন্তব্য বা স্পট থাকতে হবে। রাস্তা উপভোগ করতে আমরা ভুলে যাই। কিন্তু সুতানের রাস্তাই যেন এর প্রধান আকর্ষণ।
বিরাট বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়ে ছড়ানো বিশুদ্ধ বনভূমি দিয়ে যেতে যেতে মাঝেমধ্যে দু-একটা পাথুরেপথ ডান দিকে বা বাম দিকে চলে যায় কোনো একটা জঙ্গলঘেরা গ্রামের দিকে।
এই যে ৬.১৪৩ কিলোমিটার পথ চলে আমরা সুতানের বন বিশ্রামাবাসের কাছে পৌঁছোলাম, তার অভিজ্ঞতাটা কিন্তু এক কথায় দুর্দান্ত। এই পথে যেতে যেতে ময়ূরের সঙ্গে দেখা হওয়াটা আশ্চর্যের কিছু নয়। হাতিরও দর্শন পেয়ে যেতে পারেন।

বিশ্রামাবাস তৈরি হয়েছে। অতীতের সাক্ষ্য বহন করে এখানেই দাঁড়িয়ে আছে সিআরপিএফের একটি ক্যাম্প, যেটা এখন ধ্বংসাবশেষে পরিণত। পাশেই নতুন একটি ওয়াচটাওয়ার। তবে সেই ওয়াচটাওয়ার বেশি উঁচু নয়।
বিশ্রামাবাসটা বাইরে থেকে দেখতে বেশ সুন্দর। রঙের নতুন প্রলেপ পড়েছে। স্থানীয় এক গ্রামবাসী বললেন, বন দফতরের আধিকারিকরা এখানে এলেও কেউ রাতে থাকেন না। তার অবশ্য একটা কারণ রয়েছে। গহন এই অরণ্যে কোনো নেটওয়ার্ক নেই। রাতবিরেতে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে কারও সাহায্য চাওয়ার কোনো উপায় নেই।
বিশ্রামাবাসের ঠিক পেছনেই রয়েছে একটি বিল। শীতে হয়তো এখানে টুকটাক পরিযায়ী পাখি আসে।
সুতানের পালা মিটিয়ে এ বার আমাদের গন্তব্য তালবেড়িয়া জলাধার। বাংলার পর্যটন মানচিত্রে এই লেক এখনও সে ভাবে স্থান পায়নি। কিন্তু বাংলার অন্যতম সেরা হ্রদ হওয়ার যাবতীয় রসদ রয়েছে এই তালবেড়িয়ার মধ্যে।
সবুজ জঙ্গল ও অনুচ্চ পাহাড়ে ঘেরা এই হ্রদ। টলটলে নীল জল। পানকৌড়ি আর বকের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে।

জলাধারের কিছুটা ভেতরে একটা দাঁড়ানোর জায়গা তৈরি হয়েছে। সেখানে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি রয়েছে। লেকটাকে প্রকৃত ভাবে উপভোগ করা যায় এখানে দাঁড়িয়ে। উত্তর দিক থেকে শিরশিরানি ধরানো একটা হাওয়া আসছে। ছায়ায় থাকার ফলে নভেম্বরের দুপুরেও ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে।
তালবেড়িয়ার মতো সুন্দরী না হলেও রিমিলের ঠিক কাছে কল্যাণ সায়রটাকেও বিকেলে বেশ উপভোগ করা গেল। সায়রের বুকে ফুটে রয়েছে অসংখ্য পদ্ম। জলের মধ্যে মাছেদের খেলে বেড়ানো দেখতে দেখতেই সময়টা কখন কেটে গেল বুঝতে পারলাম না।
সূর্য অস্ত গেল। ঝিলিমিলিতে আমাদের থাকার সময়ও ধীরে ধীরে ফুরিয়ে এল। (চলবে)
এই ভ্রমণকাহিনির প্রথম অংশ পড়ুন এখানে
এই ভ্রমণকাহিনির দ্বিতীয় অংশ পড়ুন এখানে
ভ্রমণ কথা
রূপসী বাংলার সন্ধানে ১/ অবাক করল তাজপুর
কোভিডের আবহেই আট দিনের ট্যুর করেছি। তারই প্রথম পর্ব।


দিগন্ত বিস্তৃত বালিরাশি। তাতে অবাধ বিচরণ শুধু আমার আর গোটা কতক গোরুর। কোভিডের চোখরাঙানি, তাই বোধহয় সৈকত এত ফাঁকা!
কোভিড আমাদের জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে বেশ কিছু জিনিস। আবার নতুন কিছু সুযোগও এনে দিয়েছে।
এই যেমন, প্রতি বছরই পুজোর পরে আমরা বেরিয়ে পড়ি অন্য রাজ্য ভ্রমণে। হিমাচল হোক বা উত্তরাখণ্ড। কিংবা কেরল বা গোয়া। কিন্তু এ বার তো সেই সুযোগ নেই। তা বলে কি একদম বসে থাকব বাড়িতে? কখনোই নয়। অগত্যা একটা গাড়ির বন্দোবস্ত করে বেরিয়ে পড়লাম। এ বার দক্ষিণবঙ্গ চষে বেড়াব। তারই প্রথম গন্তব্য তাজপুর।
অবশ্য তাজপুরকেই ভ্রমণের প্রথম গন্তব্য বলা ঠিক হবে না! পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুর থেকে এই ভ্রমণ শুরু হয়েছে। পটাশপুরের কাজলা গ্রামে শ্রীরামকৃষ্ণ প্রেমবিহার মঠের নতুন শাখা হয়েছে। ধানখেতের মাঝখানে মঠের বাড়িতে একটা দিন কাটাতে যে কী আনন্দ হয়েছিল তা বলে বোঝানো যাবে না।
কলকাতার ব্যস্ত জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে কাজলার মতোই এমন একটা জায়গার দরকার ছিল আমাদের।
কিন্তু কাজলা ছিল আমাদের নিজেদের মঠ। আর এখন রয়েছি তাজপুরের একটি রিসর্টে। তবে রিসর্টে পৌঁছোনো ইস্তক বিভিন্ন ভাবে হতাশ হতে হয়েছে।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো ব্যাপারই প্রায় চোখে পড়ল না এখানে। যখন রিসর্টে ঢুকলাম, ম্যানেজার হোক বা কর্মী, কারও মুখেই মাস্ক দেখলাম না।
অথচ স্যানিটাইজ করার নাম করে ওই রিসর্টকর্মীরা আমাদের গায়ে কিছু স্প্রে করে দিতে চেয়েছিলেন। এই সব রাসায়নিক বস্তু শরীরের পক্ষে কতটা ক্ষতিকারক কোনো ধারণাই নেই আমাদের। জিনিসপত্রে স্প্রে করা অন্য ব্যাপার, কিন্তু শরীরে স্প্রে কোনো ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
কিন্তু যারা রিসর্টে আসা পর্যটকদের গায়ে স্প্রে করার জন্য এতটা উদ্যত, তারা নিজেরা মাস্ক পরছে না কেন? কোনো উত্তর নেই রিসর্ট কর্তৃপক্ষের কাছে।

তবে ব্যাপারটা সেখানেই থেমে ছিল না। আরও অনেক ঘটনা ঘটেছে। মাস্ক পরার ব্যাপারে আমি জোরজার করতে রিসর্ট কর্মীরা তো পরলেন, কিন্তু সেখানে থাকা একটি পর্যটকদলের কানে আমাদের কোনো কথাই গেল না।
আমাদের এখানে মাস্ক পরতে যাদের অনীহা, তারা অন্তত নিজেদের থুতনিতে বা কানে মাস্কটা ঝুলিয়ে রাখে। কিন্তু ওই পর্যটক দলে কোনো রকম মাস্ক ছিল না। রিসর্টের পরিবেশকে কলুষিত করে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মদ্যপান করে গিয়েছে।
এখানেই শেষ নয় অবশ্য। মাস্ক পরার আবেদন করেছিলাম বলে ওদের অসম্ভব টিটকিরির শিকার হয়েছি আমরা। খুব খারাপ লাগল যখন ওই দলের কয়েক জন সদস্য মাস্ক না পরে নেশার ঘরে রিসর্টের বিভিন্ন প্রান্তে থুতু ফেললেন। আমি প্রতিবাদ করা সত্ত্বেও রিসর্ট কর্তৃপক্ষ আমার পাশে দাঁড়ায়নি।
যাই হো-ক, দু’দিনের এই তাজপুরবাসে আমরা যা বুঝলাম তা হল নিজের সুরক্ষা নিজেদের কাছেই। ভ্রমণ বন্ধ করা যাবে না। কারণ ভ্রমণ আমাদের কাছে প্রয়োজনীয়তা। ৮ দিনের এই দক্ষিণবঙ্গ ভ্রমণে বেরিয়েছি শুধুমাত্র সেই প্রয়োজন মেটাতে।

তবে এটাও ঠিক, এই দু’ দিন তাজপুর সৈকতকে যে ভাবে উপভোগ করেছি, কোভিড না থাকলে এ ভাবে উপভোগ করা যেত কি না জানি না।
মনটা অনেক দিন থেকেই সমুদ্র সমুদ্র করছিল। কিন্তু দিঘা বা মন্দারমণি যাওয়ার সাহস করতে পারছিলাম না কিছুতেই। অগত্যা তাজপুরকেই বেছে নেওয়া। কিছুটা ঝুঁকি অবশ্যই ছিল। কিন্তু ফাঁকা সৈকতটাকে দেখে বেশ ভালো লাগছে।
তাজপুরের যে রিসর্টটি সমুদ্রের এক্কেবারে ধারে, সেখানেই উঠেছিলাম। রিসর্টের লন থেকে সৈকতে নামার জন্য রয়েছে বাঁশের তৈরি ঢালু পথ। জোয়ারের সময়ে সমুদ্রের জল এই বাঁশ-পথে ধাক্কা মারে। আর ভাটার সময়ে তাজপুর সৈকতের আসল চেহারা দেখা যায়।
বাংলার অন্যতম সেরা সৈকত কি বলা যায় তাজপুরকে? আমার সেটা বলতে কিন্তু কোনো আপত্তি নেই। গত বছর বগুড়ানের সৈকতকে সেরা বলেছিলাম। তার পরেই এই তাজপুরকে রাখব।
সকালে বাঁ দিকে ঘাড় ঘোরালে দুর্দান্ত সূর্যোদয় যেমন উপভোগ করেছি, তেমনই মোহিত হয়েছি বিকেলে ডান দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে সূর্যাস্তের মুহূর্ত।

সঙ্গে গাড়ি ছিল, তাই মনে হল তাজপুর থেকে একটু ঘুরে আসি। একদিন প্রাতরাশের ঠিক পরেই বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু কোথায় যাব? ঠিক হল পশ্চিমবঙ্গের সীমানা পেরিয়ে ওড়িশায় ঢুকে যাই।
না, তালসারি যাইনি। আমরা গেলাম বিচিত্রপুর। বছর তিনেক হল পর্যটন মানচিত্রে বেশ জায়গা করে নিয়েছে বিচিত্রপুর।
প্রকৃতির উপহার বিচিত্রপুর। একেবারে নতুন পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে ওড়িশা সরকার গড়ে তুলছে বিচিত্রপুরকে। তালসারি নয়, এই বিচিত্রপুরের কাছেই বঙ্গোপসাগরে মিশেছে সুবর্ণরেখা। এখানে রয়েছে একটি খাঁড়ি।
স্পিড বোটে করে সেই খাঁড়ি দিয়ে বঙ্গোপসাগরে সুবর্ণরেখার মোহনা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। অনেকটা সুন্দরবনের খাঁড়ির মধ্যে দিয়ে যাওয়ার মতো অভিজ্ঞতা এবং রোমাঞ্চ অনুভব করা যায়। দু’ দিকে ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। তফাত বলতে শুধু বাঘটাই যা নেই।
কিন্তু এই খাঁড়ি-সফরের একটা মূল শর্ত হল জোয়ার-ভাটার সময়। ভাটা হয়ে গেলে বোট চলতে পারবে না। আর ঠিক সেই কারণেই এখানে একটা রাত কাটানো বাঞ্ছনীয়।
এখানে থাকার জন্য রয়েছে ওড়িশার বনোন্নয়ন নিগমের বিচিত্রপুর নেচার ক্যাম্প। তা হলে জোয়ার-ভাটার সময়ে অনুযায়ী খাঁড়ি-সফর করা যাবে। জঙ্গলের মধ্যে নেচার ক্যাম্পটাকে দেখে মনে হল, এখানে একটা রাত কাটানো কিন্তু বেশ রোমাঞ্চকর।

বিচিত্রপুরের কাছেই ভূষণ্ডেশ্বর। এই জায়গাটির খ্যাতি শিবলিঙ্গের জন্য। কোনো মন্দির নেই, মাটি থেকে বেরিয়েছে শিবলিঙ্গটি। স্বয়ম্ভূ। এশিয়ার বৃহত্তম শিবলিঙ্গ হিসেবে খ্যাতি তার।
এশিয়ার বৃহত্তম শিবলিঙ্গ কি না, সেটা নিয়ে বিরুদ্ধমত থাকতেই পারে। কিন্তু মাটি থেকে এ ভাবে শিবলিঙ্গ বেরোনো যে যথেষ্ট রোমহর্ষক একটা ব্যাপার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রাতরাশ করে বেরিয়েছিলাম মধ্যাহ্নভোজের আগেই ফিরে আসি তাজপুর। সৈকতে বেড়াতে এসে দুটো কাজ দেদার হচ্ছে। প্রথমটা হল সৈকত ধরে হেঁটে বেড়ানো। আর দ্বিতীয়টা হল খাওয়াদাওয়া। বিশাল সাইজের পমফ্রেট আর পারশের সাহায্যে দুর্দান্ত পেটপুজো হয়েছে।
তাজপুরের সৈকত ধরে পশ্চিমে হাঁটলে দিঘা, আর পুবে মন্দারমণি। বিকেল ঘনিয়ে যখন সন্ধ্যা নামে, তখন দেখেছি দুই দিকে দিঘা আর মন্দারমণির আলোর ছটায় যেন কিছুটা ম্লান হয়ে রয়েছে অন্ধকার তাজপুর। কিন্তু সেই অন্ধকারই যে আমাদের খুব পছন্দের।
আর সূর্যোদয়ের সময়ে চওড়া সৈকত ধরে এগিয়ে গিয়েছি, দিকশূন্যপুরের উদ্দেশে। আমার এক দিকে বঙ্গোপসাগরের বিরামহীন ঢেউ আর এক দিকে ঝাউবন। নজর পড়েছে কী ভাবে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে সমুদ্র। ঝাউবনকে গ্রাস করছে সে।

সমুদ্রকে কেন্দ্র করে এখানকার বাসিন্দাদের জীবনসংগ্রাম। তাই সক্কাল হতেই সবাই চলে এসেছেন সমুদ্রের ধারে। সৈকতের বিভিন্ন জায়গায় চলছে মীন বাছার কাজ। কেউ কেউ জাল নিয়ে চলে গিয়েছেন সমুদ্রের মধ্যে। ঢেউয়ের সঙ্গে সংগ্রাম করে চলেছে মাছ ধরা।
দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এই সমুদ্রই এখানকার সুখের কারণ, আবার দুঃখেরও। এই সমুদ্র আছে বলে এখানকার মৎস্যজীবী পরিবারগুলির সংসার চলছে। আবার মাঝেমধ্যে এই সমুদ্রের দানব জলোচ্ছ্বাস ভাসিয়ে দিচ্ছে এখানকার চাষের জমি।
কিন্তু সে সব নিয়ে মানিয়ে চলতে হচ্ছে এখানকার মানুষদের। ঠিক যেমন বর্তমান কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গেও যুদ্ধ করতে হচ্ছে অবিরাম। লকডাউনের করাল গ্রাসে জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছিল এখানকার স্থানীয়দের। এখন ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে পর্যটন-কেন্দ্রিক অর্থনীতি।
তাজপুরের ফাঁকা সৈকতে দুটো দিন বেশ উপভোগ করলাম। এ বার বিদায় জানাতে হবে, কারণ পরের গন্তব্য যে ডাকছে। (চলবে)
-
রাজ্য2 days ago
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিশানা করতে সিপিএমের লাইনেই খেলছেন শুভেন্দু অধিকারী
-
দেশ3 days ago
নবম দফার বৈঠকেও কাটল না জট, ফের কৃষকদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে কেন্দ্র
-
প্রযুক্তি3 days ago
হোয়াটসঅ্যাপে এ ভাবে সেটিং করলে আপনার আলাপচারিতা কেউ দেখতে পাবে না এবং তথ্যও থাকবে নিরাপদে
-
শরীরস্বাস্থ্য3 days ago
কেন খাবেন মেথি?