Home দুর্গাপার্বণ দুর্গোৎসব ২০২৪: জনাই-বাকসা চৌধুরী পরিবারে মা দুর্গা চতুর্ভুজা, প্রতিমার কাঠামোয় রয়েছেন কৃষ্ণ-রাধা

দুর্গোৎসব ২০২৪: জনাই-বাকসা চৌধুরী পরিবারে মা দুর্গা চতুর্ভুজা, প্রতিমার কাঠামোয় রয়েছেন কৃষ্ণ-রাধা

0
গণেশের উপরে রয়েছেন কৃষ্ণ, কার্তিকের উপরে রাধা।

বাংলার বহু ইতিহাসের সাক্ষী সরস্বতী নদী। এই নদীর তীরেই পর্তুগিজরা একসময় বসতি গড়ে তোলে। পর্তুগিজরা বজরায় চেপে জলপথে যাতায়াত করত। আর সেই বজরাকে তারা বলত ‘বাক্সেল’। কালক্রমে সেই ‘বাক্সেল’-এর সূত্র ধরেই হুগলির জনাই-এর অনতিদূরে গড়ে ওঠা একটি বর্ধিষ্ণু অঞ্চলের নাম হয়ে গেল ‘বাকসা’। জনাই আমাদের কাছে খুব পরিচিত একটা জায়গা, তার বিখ্যাত মিষ্টি মনোহরার জন্য। সেই জনাইয়ে রয়েছে বেশ কিছু বনেদি পরিবার, যাদের মধ্যে অন্যতম হল বাকসার চৌধুরী পরিবার। এই অঞ্চলের একটি ঐতিহাসিক জমিদার পরিবার এই চৌধুরী পরিবার, যেখানে ঐতিহ্যের সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার মিলন ঘটেছে।

জমিদার পরিবার বলতেই সাধারণত আমাদের চোখের সামনে যে ছবি ভাসে তার সঙ্গে এই পরিবারের কোনো মিল নেই। একসময়ে এই পরিবারের উদ্যোগে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সমাবেশের আয়োজন করা হত যেখানে যোগ দিতেন বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সংস্কৃতিজগতের মানুষজন। শিল্পকলার প্রতি তাদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং অঞ্চলের উন্নয়নের প্রতি তাদের অঙ্গীকার জনাইতে চিরস্থায়ী ছাপ রেখে গেছে।

durga baksha chowdhury 2 03.10

দুর্গাদালান।

এই পরিবার সম্পর্কে আর-একটি কথা বলা খুব জরুরি। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় এই অঞ্চলের বুভুক্ষু, রোগগ্রস্ত মানুষের জন্য একনাগাড়ে অন্নদানের ব্যবস্থা করেছিল এই চৌধুরী পরিবার। মহারাজা নন্দকুমার ছিলেন এই পরিবারের বন্ধুস্থানীয়। নন্দকুমারের নামে যখন মিথ্যে মামলার ষড়যন্ত্র চলছিল আদালতে, সেই সময় তাঁর পাশে ছিলেন এই পরিবারের রূপনারায়ণ চৌধুরী, যদিও নন্দকুমারের ফাঁসি আটকানো যায়নি।

বর্ধমান রাজার দেওয়ান রাজারাম চৌধুরী এখানে করহীন ৭৫ বিঘা জনি পেয়ে জমিদারির পত্তন করেন। বাংলায় যখন শাক্ত (শক্তি) এবং বৈষ্ণবদের দ্বন্দ্ব চরমে সেই সময়ে সেই দ্বন্দ্ব দূর করতে রাজারাম একই সঙ্গে শাক্তদেবী দুর্গা এবং রাধাগোবিন্দের পুজো শুরু করেন। আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে।

এ বাড়ির দুর্গাপুজোয় বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। প্রথমত, এখানে মা দুর্গা দশভুজা নন। তাঁর চারটি হাত এবং সেই চার হাতে ধরা রয়েছে তরবারি, ঢাল, ত্রিশূল ও সাপ। দ্বিতীয়ত, মা দুর্গার কাঠামোতে জয়া ও বিজয়ার পরিবর্তে রয়েছেন রাধা ও কৃষ্ণ। কৃষ্ণ রয়েছেন গণেশের উপরে আর রাধার অধিষ্ঠান কার্তিকের উপরে। তৃতীয়ত, পরিবারের সদস্যের কল্যাণকামনায় অষ্টমীর দিন এ বাড়িতে কল্যাণীপুজো হয়। এ বাড়ির পুজোর আর-একটি বিশেষত্ব হল, বিসর্জনের সময় সপরিবার মাকে দুটি মশাল জ্বালিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।         

রাধাগোবিন্দ জিউ মন্দিরের কারুকাজ।

ষষ্ঠীর দিন চাঁদনি বেলতলায় বিল্ববরণের মাধ্যমে বোধন হয় দেবীর এবং সপ্তমীর সকালে বাড়ির জলাশয়ে নবপত্রিকা স্নানের পর মায়ের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা হয়। শাক্তমতে পুজো হলেও কেবলমাত্র চাল, ফল আর মিষ্টিতেই এখানে সাজানো হয় মায়ের নৈবেদ্য। আগে সন্ধিপুজো, নবমী ও দশমীতে বলিপ্রথার চল থাকলেও, এখন শুধুমাত্র প্রতীকী বলির আয়োজন করা হয়। সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত হয় কুমারীপুজো।

দশমীর দিনে বাড়ির কুলদেবতা রাধাগোবিন্দ জিউ, আর-এক কুলদেবতা বিশালাক্ষী দেবী এবং গ্রামের আর-এক জাগ্রত দেবী বদ্যিমাতার আরাধনা করা হয়‌। এঁদের  পুজো শেষ হলে ঘট বিসর্জন দেওয়া হয় সরস্বতী নদীতে। চৌধুরী পরিবারের পবিত্রতা এবং ঐতিহ্য বজায় রেখে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এভাবেই পুজোর প্রথাগুলি পালন করে আসছে।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version