আর মাত্র হাতেগোনা কয়েকটা দিনের অপেক্ষা। পিতৃপক্ষের অবসান আর দেবীপক্ষের সূচনার। শহর কলকাতার বাকি সব জাঁকজমকপূর্ণ আড়ম্বরপূর্ণ পুজোর মাঝে নিজস্ব স্বতন্ত্রতা বজায় রাখতে প্রস্তুত দক্ষিণ কলকাতার হাজরা পার্ক দুর্গোৎসব কমিটি।
দলিতদের সমাজে সম্মান ও অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতার বার্তা দিচ্ছে এই পুজো। পাশাপাশি গ্রামবাংলার অসাধারণ শিল্পকর্মকেও তুলে ধরতে প্রস্তুত হাজরা পার্ক দুর্গোৎসব কমিটি। দক্ষিণ কলকাতার এই পুজোর সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন রাজ্যের মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। তিনি এই পুজোর প্রধান উপদেষ্টা।
চলছে মণ্ডপসজ্জার কাজ। ছবি: রাজীব বসু।
৮২ বছরে হাজরা পার্ক দুর্গোৎসবের থিম হল ‘শুদ্ধি’। থিম ভাবনায় রয়েছেন শিল্পী বিমান সাহা। প্রতিমা গড়ছেন শিল্পী পরিমল পাল। হাজরা পার্ক দুর্গোৎসবের পুজোর সহ-সম্পাদক পদে রয়েছেন মন্ত্রীপুত্র তথা তৃণমূল নেতা সায়নদেব চট্টোপাধ্যায়।
থিম প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সায়নদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, “৮২ বছর আগে হাজরা পার্ক দুর্গোৎসব কমিটি এমন কিছু করার সাহস দেখিয়েছিল যা অন্য কোনো পুজো কমিটি করতে পারেনি। তা হল সমাজে দলিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। গত শতকের তৃতীয় দশকের শেষে এবং চতুর্থ দশকের গোড়ার দিকে পরাধীন ভারতে সামাজিক আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী দলিতদের ‘হরিজন’ বলে সম্বোধন করেন ও দলিতদের সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় ধর্মযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। একসময়ে কলকাতা পুর নিগমের মেয়র হন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। সিইও’র পদ অলংকৃত করেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। নেতাজির নেতৃত্বেই কলকাতা পুর নিগম দলিত কর্মচারীদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সামগ্রিক বদল আনে। পরে এই আবহেই হাজরা পার্ক দুর্গোৎসবের জন্ম হয়।”
চলছে মণ্ডপসজ্জার কাজ। ছবি: রাজীব বসু।
হাজরা পার্কের পুজোর এবারের থিম হল ‘শুদ্ধি’। এই নামকরণের মূলে রয়েছে এই পুজোর শুরু হওয়ার ইতিহাস। দলিতদের সমাজে সম্মান অধিকার দেওয়ার জন্য ধর্মযুদ্ধের লড়াই। ৮২ বছর ধরে কলকাতার বাকি পুজোর থেকে আলাদা ভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে হাজরা পার্ক দুর্গোৎসব কমিটির পুজো।’
কেন এমন ‘হটকে থিম’ বেছে নেওয়া হল? এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সায়নদেব চট্টোপাধ্যায় জানান, “কলকাতা পুর নিগমের নিকাশি ব্যবস্থার সবচেয়ে কঠিন কাজ করে এসেছেন দলিত কর্মচারীরাই। দুরূহ কাজ করলেও সমাজে দলিতদের অবস্থান ছিল নীচে। মন্দিরের পাশাপাশি দুর্গাপুজোর মণ্ডপেও তাঁদের ঢোকার অনুমতি ছিল না। কুমোরটুলি থেকে ঠাকুর আনার সময় তাঁরা দূর থেকেই ঠাকুর দর্শন করতেন ও প্রণাম করতেন। এমনকি, মায়ের বিসর্জনের সময়ও দলিতরা দূর থেকে গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে প্রণাম করতেন।”
মণ্ডপসজ্জার উপকরণ বানাতে ব্যস্ত শিল্পীরা। ছবি: রাজীব বসু।
সায়নদেববাবু আরও জানালেন, গত শতকের ৪-এর দশকে দক্ষিণ কলকাতার স্ক্যাভেঞ্জার কলোনি বা দলিত মহল্লা ও কয়লা ডিপো হাজরা পার্কের কাছে অবস্থিত ছিল। এক ব্যক্তি দলিতদের পুজো করার জন্য ছোট্ট দুর্গামূর্তি নিয়ে আসেন। উচ্চবর্গের মানুষের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হয় ওই ব্যক্তির। ডিপোর টিমকিপার ঘটনাটি কলকাতা পুর নিগমের আধিকারিককে জানান। এরপর পুর নিগমের উচ্চবর্ণের কর্মচারী ও আধিকারিকরাই দলিত কর্মচারীদের জন্য পুজোর দায়িত্ব নেন। সেই থেকে এই পুজোর শুরু।
১৯৪৪ সাল পর্যন্ত এই পুজো হয়েছে কদমতলায়। ১৯৪৫ সাল থেকে হাজরা পার্কের বর্তমান জায়গায় উঠে আসে পুজো। এখন সর্বজনীন এই পুজোর দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন কলকাতা পুর নিগমের দলিত কর্মচারীরা। এমনকি পুর নিগমের স্টোর থেকেই মণ্ডপ নির্মাণের সামগ্রী সরবরাহ করা হয়। এ বছর মণ্ডপসজ্জায় বেত, বাঁশের মতো পরিবেশবান্ধব জিনিস ব্যবহার করা হচ্ছে বলে সায়নদেববাবু জানান।
কোথায় এই মণ্ডপ
দক্ষিণ কলকাতায় হাজরা রোড এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোডের মোড়ে যতীন দাস পার্ক, যা লোকমুখে হাজরা পার্ক নামে পরিচিত। এই পার্কেই দুর্গাপুজো হয়।
আরও পড়ুন
দুর্গোৎসব ২০২৪: সাতমহলা জমিদারবাড়ির অন্তঃপুরের কাহিনি শোনাতে প্রস্তুত সিংহী পার্ক সর্বজনীন
দুর্গোৎসব ২০২৪: জাঁকজমকপূর্ণ আড়ম্বর নয়, ভক্তিভরে মায়ের উপাসনাই লক্ষ্য কাঁকুড়গাছি মিতালীর