Home কথাশিল্প প্রিয় পথ…

প্রিয় পথ…

0

ভার্গবী

প্রিয় পথ,

তোমায় দেখি আর ভাবি কোথা থেকে এলে তুমি? কোন বাঁধনে বাঁধো তুমি আর যাবেই বা কোন ঠিকানায়? তোমায় জিজ্ঞেস করে উত্তর পেয়েছিলাম, শেষের কবিতার দুটি পংক্তি, “পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি / আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী”। বুঝিয়েছিলে আমায়, তোমার কোনো গন্তব্য নেই। কোথাও পৌঁছোনোর তাড়া নেই তোমার। শুধু একটা মন্ত্র আছে ‘চরৈবেতি’। 

কাগজের পাখা ঘুরবে বলে কিশোর মন অকারণ পুলকে ধানখেতের আলপথ ধরে ছুটতে থাকে। আলপথের গায়ে কিশোরবেলার কচি পা সবুজ মাড়ায়। আর সেই ফাঁকে হাত উঁচু করে ধরে রাখা রঙিন কাগজের পাখার সাথে আলপথের সবুজ ঘাসের একটা বন্ধুতা তৈরি হয়ে যায়, ঝলমলে সূর্যের আলো মেখে।

সেই গ্রীষ্ম দুপুর। কাঁখে তার পোড়া মাটির কলসি। চলকে পড়া জল। তৃষ্ণার্ত তোমার ধুলো সিক্ত করে কোনো যৌবন-ভীরু পল্লিবালা, তোমারই মেঠো পথে। তুমি শুষে নাও বারিধারার ভালোবাসাটুকু। আচ্ছা, সত্যি করে বলো তো সে চকিতে আঁচল গোছাবে বলেই কি তুমি আছো? সেই থেকেই বুঝি তোমার সাথে আলাপ পোড়ামাটির কলসির?

তুমি এ সব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েও দাওনি। কি এক রহস্যের হাসি এঁটে তুমি দূরে মিলিয়ে গেলে দিগবলয়ের গায়ে। ভেবেছিলাম সেই তোমার শেষ। তুমি বলেছিলে, শেষ বলে কিছু নেই। কিছু হয় না। বিস্তর প্রতিবাদ করেছি আমি। বলেছি জীবনের পথ শেষ হয় মৃত্যুর দরজায়। তুমি বলেছিলে মৃত্যু হয় শরীরের, দেহের। কাজের মৃত্যু নেই। আর নিজেকে উপাধি দিয়েছিলে কর্মবীর বলে।

জিজ্ঞাসা অনন্ত আমার, বললাম…. তো, কী এত কাজ শুনি! বিস্তর কাজের ফিরিস্তি দিয়েছিলে সে দিন। বলেছিলে, যার ঘর নেই তাকে তোমায় ধারণ করে রাখতে হয় বুকের মধ্যে। যার ঘর আছে তাকে যত্ন করে ঘরে পৌঁছে দিতে হয় তোমাকে।

আচ্ছা, তার সাথে কি তুমিও সে ঘরে আটকা পড়ো না? বলেছিলে, তোমার কাজ পৌঁছে দেওয়ার, ঘাঁটি বাঁধার নয়। কখনো তুমি নিয়ে গিয়ে ফেলো ব্যস্ত বন্দরে। জলপথের নরম নীল ডিঙিয়ে সবুজ পান্নার মতো জেগে থাকা কোনো দারুচিনি দ্বীপের কাছে পৌঁছে যাও। কিশোরী মেয়ের ঝিনুক জমানো দেখতে দেখতে এগিয়ে যাও নতুন কোনো দিশায়। কখন কোন ফাঁকে নিয়ে গিয়ে ফেলো সেই জঙ্গলে যেখানে রৌদ্র আর ছায়ার খুনসুটিতে বেলা কেটে যায়। কী একটা অচেনা পাখির ডাক দূরে মিলিয়ে যায়। সন্ধ্যা নামে ধীরে, জোনাক জ্বলে ওঠে ইতি-উতি। পথ, তোমায় ঠাহর করতে পারি না। আর যা অগোচরে থাকে, আড়ালে থাকে, অন্ধকারে আবছা হয়ে থাকে তার প্রতি আকর্ষণ অনিবার্য। তাই তাকে খুঁজতে সে আঁধারে পাড়ি দাও এক দিশা থেকে অন্য দিশায়।

চলা ছাড়া বোধকরি আর কোনো নিয়ম মানায় না তোমায়। মানোও না থামার নিয়মকে তুমি কোনো দিন। পাহাড়ের পাকদণ্ডিকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে দুর্গমে নিয়ে গিয়ে ফেল নিজেই নিজেকে। কতিপয় সাথি জোটে সে দুর্গমের। হারায়ও বিস্তর। বলেছিলাম কেন বাপু, হারায় যদি সাথি, ওই দুর্গমের টানে কেন নিয়ে যাও? বলেছিলে, তোমার চলা আছে, দেখার চোখ নেই। তোমার বলার আছে কিন্তু বলার ভাষা নেই। তাই সাথি জোটাও। বলেছিলাম, হারায় যে সাথি সে দুর্গমে চলার নেশায়, তোমার ভয় করে না। বলেছিলে, সাথি হারায়, সাথে থাকা হারায় না।

পাহাড়ি নদীর সাথে নুপুরের আওয়াজ তুলে নেমে আসো সেই মোহনার কাছে। আবার যাও ধু-ধু মরু প্রান্তর পেরিয়ে, টিলা-পাহাড় ছাড়িয়ে দুর্গম শীতল পাহাড়ের চূড়ায়। চূড়ান্ত চলাচল তোমায় ক্লান্ত করেনি কখনও। তুমি ক্লান্তিহীন, নিশিদিন। তিষ্টও না কোথাও দু’দণ্ড। কী পাও যে চলতে চলতে, বুঝতে পারি না। উত্তর দিয়েছিলে, তিষ্টলে তেষ্টা বাড়ে বাঁধনের। সে বড়ো বালাই। তার চেয়ে কী পাই বলি তোমায় – যা পাই তা রাজার ঐশ্বর্য্যের মতো ক্লান্তিকর  নয়। তা রোজের মধ্যবিত্তের বাজার থেকে বাড়ি ফেরার মতো অভ্যাস নয়। আমি যা পাই তার নাম বৈচিত্র্য।

পথ, তুমি ঠিকানায় পৌঁছোবে না কখনও কোনো দিনও, সে বেশ বুঝতে পারি আমি। তোমার সাথে আমার কিছু দেওয়া-নেওয়া আছে। কিছু নিত্যকার, কিছু অনিত্যের। ভালো থেকো পথ। রোদ ছুঁয়ে থাক তোমায় আলো করে। বৃষ্টি ভিজিয়ে দিক তোমার ভিজে নেওয়ার ইচ্ছাকে। জোৎস্না জিড়িয়ে নিক তোমার বুকে। এ সব নিয়ে ভালো থেকো তুমি।

ভালোবাসা রইল।

ইতি…

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version