Home কথাশিল্প মুক্তির মন্দির সোপানতলে: ভারতের স্বাধীনতাযুদ্ধের এক অল্প-জানা কাহিনি

মুক্তির মন্দির সোপানতলে: ভারতের স্বাধীনতাযুদ্ধের এক অল্প-জানা কাহিনি

0

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

ঢাকায় অত্যাচারী হাডসনকে নিকেশ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফোর্থ ইয়ারের ফার্স্টবয় অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে এল কলকাতায়। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স-এর সিনিয়র বিপ্লবী হরিদাস দত্ত বিষয়টি জানালেন সুভাষচন্দ্রকে। বসল গোপন আলোচনাসভা। এ দিকে ব্রিটিশ গোয়েন্দাপুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই ২০ বছরের তরুণকে। এই কাজের নেতৃত্বে রয়েছেন স্বয়ং কলকাতার ভয়ংকর পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট। তখন তরুণটির মাথার দাম ২০ হাজার টাকা। এহেন পরিস্থিতিতে অনেক ভেবেচিন্তে সুভাষ অভিমত দিলেন, বিনয় বিদেশে চলে যাক। একই অভিমত দিলেন মেজদা শরৎচন্দ্র বসু, বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, লেডি অবলা বসু, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ সবাই। সেইমতো সব পাকা বন্দোবস্ত করলেন হরিদাসবাবু।

কিন্তু বিনয়ের অভিমত – ‘না’। কারণ ইতিমধ্যে তার কানে এসেছে রাইটার্স অভিযানের পরিকল্পনার কথা। বিনয়ের খুব ইচ্ছে কারা বিভাগের জেনারেল কর্নেল সিম্পসনকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার। কারণ সেই শয়তান আলিপুর জেলে সুভাষের দেহ থেকে অনেক রক্ত ঝরিয়েছে, অনেক অত্যাচার করেছে সুভাষের ওপরে। তাই এই অভিযানে “আমি যাব”।

সে দিন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের হরিদাস দত্ত, সত্য বক্সি, মেজর সত্য গুপ্ত, ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিতরায়, প্রফুল্ল দত্ত, মণীন্দ্র রায়, রসময় সুর, জ্যোতিষ জোয়ারদার, যতীশ গুহ, তেজোময় বসু, জিতেন সেন, সুধীর নন্দী, অশোক সেন, গোপাল সেন, অনিমেষ রায়, শচীন ভৌমিক, মণি সেন, নির্মল গুহ, নিকুঞ্জ সেন, সুপতি রায়, অধ্যাপিকা মীরা দত্তগুপ্তা, মণিকুন্তলা সেন প্রমুখ একবাক্যে বিনয়ের সেই ইচ্ছেকে স্যালুট করেছিলেন। সুভাষচন্দ্র-সহ সকলে ঠিক করলেন রাইটার্স অভিযান পরিচালনা করবেন ২০ বছরের বিনয় বসু। আর সঙ্গে থাকবেন আরও দুই মৃত্যুভয়হীন বিপ্লবী –২২ বছরের দীনেশ গুপ্ত এবং ১৮ বছরের বাদল গুপ্ত। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর গোপনে খবরটি দিয়েছিলেন সে দিন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। এই তিন তরুণ বিপ্লবীর অতি প্রিয় ছিল কবিগুরুর রচনা। তিনি গোপনে আশীর্বাদ পাঠিয়েছিলেন।

কিন্তু বিনয় থাকবে কোথায়?

প্রথমে ব্যবস্থা হল বেলেঘাটায়। অবশেষে দলের একনিষ্ঠ কর্মী মেটিয়াবুরুজের রাজেন গুহর বাড়িতে। রাজেনবাবু খুশিতে আত্মহারা। বিনয়ের মতো ছেলে তাঁর আশ্রয়ে থাকবে, এ তো পরম সৌভাগ্যের কথা। এমন ভাগ্য ক’জনের হয়?

চলে গেল বিনয় মেটিয়াবুরুজে। রাজেনবাবুর বাড়িতে তাঁর স্ত্রী সরযুবালা দেবীকে দেখেই বিনয় অভিভূত। বৌদি তো নয়, ঠিক যেন মা। এই বিশ্বসংসারে একমাত্র মা ছাড়া আর কারও কাছ থেকেই বুঝি এমন নিঃস্বার্থ অনাবিল স্নেহ-ভালোবাসা পাওয়া সম্ভব নয়।

সে দিন সরযুদেবীর প্রথম সম্বোধন ছিল, “এসো ভাই”। আহা প্রাণ জুড়িয়ে গিয়েছিল বিনয়ের। সেই ডাকে যেন পাতা ছিল বাংলা তথা সারা বিশ্বের মা-দিদি-বৌদিদের, এককথায়, নারীজাতির স্নেহ-মমতা মাখানো ভালোবাসার শীতলপাটি।

৮ই ডিসেম্বর। ১৯৩০ সাল। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিযুগের রক্তস্নাত ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় শীতের সকাল। সকাল থেকেই সবাই ব্যস্ত। সাজো সাজো রব পড়ে গেল নিউ পার্ক স্ট্রীটের একটি গুপ্তকেন্দ্রে, যেখানে আছেন দীনেশ গুপ্ত, বাদল গুপ্ত এবং বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের পুরুষ-মহিলা নেতৃবৃন্দ। সেই ইতিহাস অন্য কোনো একদিন বলব।

আজ এখন চলে যাই মেটিয়াবুরুজের রাজেন গুহর বাড়িতে।

সকাল থেকেই নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই বুঝি বাড়ির গিন্নি সরযুদেবীর। ঠাকুরপো কী খেতে ভালোবাসে, কোনটা তার বেশি পছন্দের, এই নিয়েই আদরের সন্তানসম ঠাকুরপোর মায়ের মতো বৌদি খুবই ব্যস্ত। শুরু হয়েছে কাল থেকেই, তবু এখনো তার জের শেষ হয়নি। সাধ মেটেনি সরযুবালার। কেবলই তাঁর মনে হয়, এই বুঝি কিছু বাদ পড়ে গেল, এই বুঝি কিছু করা হল না। মাঝেমধ্যেই এক চাপা দুঃসহ ব্যথায় বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে, মনটা গুমরে গুমরে ককিয়ে ওঠে, চোখে জল চলে আসে। নীরবে গোপনে শাড়ির আঁচলখানিতে সেই শব্দহীন কান্নার জল মুছে নিয়ে প্রাণপণ শক্তিতে সামলে নেন নিজেকে সরযুবালা দেবী।

বারবার সরযুবালার মনে হয়, আজ সব কিছুর পরিসমাপণ। ঘরছাড়া মাতৃমন্ত্রে দীক্ষিত, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী আর বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ, রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা প্রিয় স্নেহ-বুভুক্ষু ভাইটি কাল থেকে আর কোনো দিনই তাঁর হাতে খেতে আসবে না। শেষমেশ কী হবে কে জানে! আশঙ্কায় কাঁপতে থাকে তাঁর মাতৃহৃদয়। তবু তিনি ব্যস্ত থাকেন ঠাকুরপো ভাইটির জন্য।

বিনয় বসু

১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর, শীতের সকাল। ঘড়িতে তখন সময় ৭টা। বিনয় তখনও পরম আরামে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন। বৌদি বারবার এসে দেখে যাচ্ছেন, তবু ইচ্ছে করেই ডাকেননি। কেমন যেন মায়া হচ্ছে। আহা ঘুমোক ছেলেটা আরেকটু। আর কতক্ষণই বা। এর পর তো হাজার ডাকলেও হতভাগ্য এ দেশের এই রকম সোনার চাঁদ ছেলেটা আর কোনও দিন সাড়া দেবেনা। আহা ঘুমোক, ঘুমোক।

সকাল ৭টা ১৫। সকাল ৯টায় যে ভারতমায়ের ওই ‘জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য’ করা দামাল ছেলেটা দেশের জন্য মহাসংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে রওনা হবে। তাই আর তো দেরই করা যাবেনা। অতএব…।

— “ঠাকুরপো! ঠাকুরপো!” অসীম মমতা ঝরে পড়ল সরযুবালার কণ্ঠ থেকে। ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ল বিনয়।

—  “ইস! কত বেলা হয়ে গেছে। আমাকে ডাকোনি কেন বৌদি?”

চলে যেতে যেতে বৌদি বললেন, “যাও মুখটা ধুয়ে এসো, আমি চা দিচ্ছি।” আড়ালে মুছে নিলেন সরযুবালা ঝাপসা চোখের জল। মুখ ধুয়ে এসে বিনয় দেখে চায়ের সঙ্গে অনেক খাবার।

— “একী! এই সাতসকালে কি এত খাওয়া যায়? তুমি এক কাজ করো, আমি চা আর একটু খাবার খেয়ে দাড়ি কামিয়ে চানটা করে আসি, তুমি আমাকে একমুঠো ভাত দিয়ে দাও কেমন। ওরা ন’টার মধ্যে চলে আসবে, বেরোতে হবে।”

চান করে এসে বিনয় দেখল, তার পরম স্নেহময়ী জননীসমা বৌদি খাবারের আয়োজন করে তার অপেক্ষায় বসে আছেন। বিনয় অবাক খাবারের আয়োজন দেখে। কিছু বোধহয় বলতে যাচ্ছিল, বৌদি সরযুবালা চোখের তারায় সকরুণ মিনতিতে বলে উঠলেন – “লক্ষ্মীটি আমার, খেয়ে নাও ভাই।”

এর পর প্রতিবাদ করা বৃথা। সুতরাং খাবারে বসতেই হল। সেই আয়োজন যেন রাজসিক ব্যাপার। শুকতো, নানা রকমের ভাজা, নানা রকমের মাছের পদ, মাংস, পোলাও, চাটনি, পাঁপড়ভাজা, পায়েস, নানা প্রকারের মিষ্টি, দই – কিছুই বাদ নেই।

— “খাও ভাই।” বৌদির দু’ চোখে আসন্ন অশ্রুধারার ইঙ্গিত। মুখ মোছার অছিলায় চোখ মুছে নিয়ে বৌদির সকাতর স্নেহ ঝরে পড়ে – “নইলে এ দুঃখ আমার জীবনেও যাবে না, মরেও আমি শান্তি পাব না। আমি যে শুধু তোমার জন্যই এ সব করেছি ভাই।”

— “ঠিক আছে, আমি একটু একটু করে তোমার হাতের সব রান্না আজ খাব, কিন্তু এত খেলে যে মোটা ধুমসো হয়ে যাব। লড়ব কী করে? কবজির জোর দেখাতে হবে না! ব্রিটিশকে তাড়াতে হবে তো। ঠিক আছে, ঠিক আছে, তুমি দুঃখ কোরো না। আমি আস্তে আস্তে খেয়ে নিচ্ছি সব। এ বার খুশি তো? তোমাদের খুশির জন্যেই তো আমার আজকের এই অভিযান।”

খাওয়া শেষ। এ বার পোশাক পরার পালা। সাধারণ যা-তা পোশাক নয়। একেবারে যুদ্ধে যাওয়ার রণসাজ। যাতে ব্রিটিশরা বুঝতেই না পারে যে এই মানুষটি কে? দলের অন্যতম নেতা রসময় সুর এনেছেন দামী স্যুট, নেকটাই, জুতো, মাথার হ্যাট ইত্যাদি – সব চোখ-ঝলসানো পোশাক।

এতক্ষণ এক অপূর্ব সংযমে নিজেকে ধরে রাখলেও, এ বার কিন্তু আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না বৌদি। সন্তানসম ভ্রাতৃবিচ্ছেদের আকুল করা বেদনায় সহসা তিনি ভেঙে পড়লেন কান্নায়। দু’ হাতে মায়ের স্নেহবন্ধনে জড়িয়ে ধরলেন বিনয়কে।

নিমেষে নিজেকে দৃঢ করে তোলেন বিনয়। বললেন – “একী! যে দেশের মায়েরা, দিদি-বোনেরা, বৌদিরা যুদ্ধে যাওয়ার আগে প্রিয়জনকে নিজের হাতে সাজিয়ে দেন, সেই দেশের মেয়ে হয়ে তুমি কাঁদছ? তোমার চোখে জল কেন বৌদি? তুমি তো বিপ্লবী। তুমি তো আমার জন্মভূমি, তুমিই তো আমার ভারতবর্ষ।”

— “ঠিক কথা”, সায় দিলেন রাজেনবাবু। স্ত্রীর হাতে বিনয়ের জন্য আনা পোশাক তুলে দিলেন। বললেন, “ছেলে তোমার পরাধীন ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করতে যাচ্ছে, এই সময়ে তুমি উপযুক্ত মায়ের মতোই নিজের হাতে তাকে সাজিয়ে দাও। নাও ধরো। এত বড়ো সৌভাগ্য জীবনে আর কোনো দিনও পাবে না। শুরু করো” – এই বলে তিনি তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে গেলেন, আড়ালে চোখের কান্না লুকিয়ে মুছে নিতে।

আস্তে আস্তে নিজেকে ধাতস্ত করে সরযুবালা দেবী নিজের হাতেই সাজিয়ে দিলেন তাঁর এই ক’ দিনের সম্পর্কের আদরের প্রাণপ্রিয় ভাইটিকে।

ইতিহাস কি জানে এই সব মহীয়সী নারীদের কাহিনি?

বীরের মতো সন্তানতুল্য ভাই চলল নিজেকে দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তির মন্দির সোপানতলে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে। তাঁর জন্মদাত্রী জননী রইলেন সুদুর ঢাকায়,আর এখানে এই মুহূর্তে কলকাতায় মেটিয়াবুরুজের সরযুবালা গুহ সেই বিনয়ের জননীর প্রতিনিধি হয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে সাজিয়ে দিচ্ছেন ঐতিহাসিক ‘রাইটার্স বিল্ডিং ‘অলিন্দ যুদ্ধ’-এর অন্যতম নায়ক বিনয় বসুকে।

— “যাই বৌদি!” চিরবিদায়ের আগে বিনয় জননীর প্রতিনিধি সেই বৌদিকে প্রণাম করে তাঁর পায়ের ধুলো মাথায় তুলে নিলেন।

 — “যাই বলতে নেই ভাই, আসি বলো” – বৌদি বিনয়ের থুতনিতে হাত স্পর্শ করে স্নেহের আশীর্বাদ ও চুমু দিলেন।

বিনয় হেসে বললেন, “আসি বৌদি।” – “এসো ভাই, আমার।” সেই সময়ে আর কিছু বলার শক্তি ছিল না সরযুদেবীর।

ইঙ্গিত করতেই পাঞ্জাবি ড্রাইভার গাড়িটা স্টার্ট দিল। লগ্ন আসন্ন। আর দেরি নয়। অপলক দৃষ্টিতে শেষ পর্যন্ত গাড়ির যাত্রাপথের দিকে কান্নাভেজা ঝাপসা চোখে তাকিয়ে রইলেন বৌদি। তার পর একসময়ে গাড়িটা মিলিয়ে গেল দৃষ্টির আড়ালে। আর তাকে দেখা গেল না। গাড়ির গন্তব্য খিদিরপুরের পাইপ রোড। সেখানে থাকবে রণসাজে সজ্জিত বাদল গুপ্ত আর দীনেশ গুপ্ত, ক্যাপ্টেন বিনয় বসুর জন্য।

এই ঘটনার ১৭ বছর পরে ভারতবর্ষের মানচিত্রকে দ্বিখণ্ডিত করে, নেতাদের কথায় যা ছিল দুই ডোমিনিয়ন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর, ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছে।

কিন্তু রাজেন গুহ, সরযুবালা দেবীরা হারিয়ে গিয়েছেন। কেউ তাঁদের কোনো খবর রাখেনি। না স্বাধীন দেশের আমরা, না স্বাধীন দেশের সরকার। আজ স্বাধীনতার ৭৬ বছর পরেও মনে হয় এ আমাদের আজন্ম এক ঐতিহাসিক অমার্জনীয় অপরাধ, এক কলঙ্কিত ঘৃণিত লজ্জা।

তথ্যসূত্র:

সবার অলক্ষ্যে – ভুপেন্দ্রকিশোর রক্ষিতরায়

বাংলার বিপ্লববাদ – নলিনীকিশোর গুহ (রাজেন গুহর ভাই)

আমি সুভাষ বলছি- শৈলেশ দে

আরও পড়ুন

শ্বাসেপ্রশ্বাসে এবং বিশ্বাসে বিদ্যাসাগর, জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version