নিজস্ব প্রতিনিধি: সক্কাল সক্কালই পৌঁছে গেলাম ক্যানিং স্ট্রিট আর ব্র্যাবোর্ন রোডের মোড়ে। বিরাট বিরাট ত্রিপল খাটিয়ে পুরোদমে চলছে দোকানপাট। ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভিড়ে ছয়লাপ। তারই মধ্যেই উঁকি মারছে টকটকে লাল এক তিনকোণা মিনার। ব্যস্ততম ব্যাবসা-এলাকায় থেকেও নজর কেড়ে নেয় ওই মিনারটিই।
ইহুদিদের উপাসনালয় মাঘেন ডেভিড সিনাগগ। তারই মিনার নজর কাড়ছে এলাকার মানুষদের। কলকাতায় ইহুদিদের হাতে গোনা যে কয়েকটি উপাসনাস্থল আছে তাদের মধ্যে অন্যতম এই মাঘেন ডেভিড। ভারতে তো বটেই, এমন সুন্দর সিনাগগ সমগ্র প্রাচ্যেও দুর্লভ। একটু দূরেই পোলক স্ট্রিটে ইহুদিদের আর-একটি উপাসনালয় রয়েছে। নাম, বেথ এল সিনাগগ। সৌন্দর্য আর স্থাপত্যে এটিও অনন্য। তবে এই দুই সিনাগগের সৌন্দর্যের মধ্যে কিছুটা যেন ম্লান মাঘেন ডেভিডের প্রতিবেশী নেভে শালোমে সিনাগগ।
ব্রিটিশদের রাজত্বকালে কলকাতা যখন বাণিজ্যনগরী হিসেবে ফুলেফেঁপে উঠেছিল সেই সময়েই বাগদাদি ইহুদিরা এ দেশে আসেন। ইহুদিদের কলকাতায় আসা নিয়ে অনেক কাহিনি প্রচলিত আছে। তবে ইতিহাস বলে, সিরিয়ার আলেপ্পা থেকে ১৭৯৮-এ শালোমে ওয়াদিয়া কোহেন নামে এক ইহুদি সুরাত হয়ে কলকাতায় প্রথম পা রাখেন। সেই শুরু।
লাল ইট দিয়ে তৈরি মাঘেন ডেভিড সিনাগগ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও বহু ইহুদি ছিলেন কলকাতায়। স্বাধীন ইজরায়েল গঠিত হওয়ার পরে এবং আরও নানা কারণে একসময় দলে দলে ইহুদি ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যেতে থাকেন। সেই চলে যাওয়া থেকে কলকাতাবাসী ইহুদিরাও পিছিয়ে থাকেননি।
একসময় পাঁচ হাজারেরও বেশি ইহুদি ছিলেন কলকাতায়। এখন সংখ্যাটা মেরেকেটে ২৫। যে ক’জন এখনও এই শহরে রয়েছেন, তাঁরা এই শহরটাকে ভালোবেসে রয়ে গিয়েছেন। তাঁরা কিন্তু শক্ত মুঠিতে ধরে রেখেছেন তাঁদের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি, ভালোবাসা। এই উদ্দেশ্যেই সময়ের ছাপ পড়ে যাওয়া মাঘেন ডেভিড সিনাগগ এবং বেথ এল-এর সংস্কার শুরু করা হয়।
এক কালে গমগম করত এই মাঘেন ডেভিড সিনাগগ।
মাঘেন ডেভিড সিনাগগটিকে অসাধারণ বললেও কম বলা হয়। লাল ইট দিয়ে তৈরি এর বহিরঙ্গ। ভিতরে ঢুকলে অপার নৈঃশব্দ্য। বাইরের সমস্ত হট্টগোল আর শব্দকে ঢেকে দেয় এই নৈঃশব্দ্য। বহু পুরোনো কোনো এক শহর তার ঐতিহ্য, সাবেকিয়ানা দিয়ে যেন মুড়ে দিয়েছে সিনাগগটির প্রতিটি কোণ। উঁচু জানলা আর ছাদে লাগানো বহু বর্ণময় কাচের টুকরো থেকে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে সিনাগগের থামগুলি ঝিলমিল করছে।
বিরাট হলের মাঝখানে মঞ্চের মতো উঁচু জায়গা। এখানে রাবাই অর্থাৎ ইহুদি পুরোহিতরা বিশিষ্টদের নিয়ে দাঁড়াতেন প্রার্থনার সময়। হলের শেষ প্রান্তে গ্যালারির মতো একটি জায়গা রয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয় এখানে। সিনাগগগুলির এই জায়গাটিই সব চেয়ে বেশি সুন্দর। কারুকার্যময় কাঠের রেলিং দিয়ে ঘেরা। এখানে রয়েছে তিনটি দরজা। এর ভিতরে রক্ষিত রয়েছে ইহুদিদের পবিত্র গ্রন্থ তোরা।
এক কালে গমগম করত এই মাঘেন ডেভিড সিনাগগ।
মাঘেন ডেভিড থেকে কিছুটা দূরেই পোলক স্ট্রিটে বেথ এল সিনাগগ। বিরাট হলঘরে দেখার মতো সুন্দর ঝাড়লণ্ঠন। মাঘেন ডেভিডের মতোই মঞ্চ, রাবাইদের দাঁড়ানোর জন্য। সিঁড়ি দিয়ে পৌঁছে যেতে হয় সেই মঞ্চে। মাঘেন ডেভিডের মতোই ওপরে ব্যালকনি ঘেরা জায়গা মেয়েদের প্রার্থনা করার জন্য। কলকাতায় একসময় প্রচুর ‘তোরা’ (পবিত্র গ্রন্থ) ছিল। এখন আর তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। এর মধ্যে মাত্র দু’টি এখনও সংরক্ষিত রয়েছে বেথ এল সিনাগগে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদি আর মুসলমানদের সম্পর্কে টানাপড়েন থাকলেও তার বিন্দুমাত্র ছাপ কোনো দিন কলকাতায় পড়েনি। এখানে সব ক’টি সিনাগগ দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন মুসলমানরা। এমনকি ‘তোরা’ যে ঘরে রক্ষিত আছে সেখানেও ঢুকতে পারেন এঁরা। প্রার্থনার সময় ইহুদিরা টুপির মতো যে আবরণ দিয়ে মাথা ঢাকেন সেই ‘কিপা’ নিজেরা তো পরেনই, যাঁরা সিনাগগ দেখতে আসেন তাঁরা মাথায় রেখেছেন কি না সে দিকেও কড়া নজর থাকে এঁদের।
বেথ এল সিনাগগের ভিতরে।
কিছু অবশ্য পালনীয় নিয়ম
প্রথামতো শনিবার ইহুদিরা প্রার্থনায় বসেন এখানে। সেই কারণে দর্শনার্থীদের জন্য সিনাগগগুলি পুরোপুরি বন্ধ ওই দিন। বাকি দিনগুলিতে খোলা থাকে। তবে কিছু নিয়ম আছে।
১) শুক্রবার দুপুর এবং শনিবার ছাড়া পর্যটকরা সিনাগগে ঢুকতে পারবেন।
২) তবে একবার ঢুকলে মাত্র দশ মিনিট থাকতে পারবেন তাঁরা। দশ মিনিটের বেশি তাঁদের ভেতরে থাকতে দেওয়া হবে না।
৩) আধার কার্ড নিয়ে আসতেই হবে। পরিচয়পত্র দেখিয়ে তবেই এই সিনাগগগুলিতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।
ছবি: শ্রয়ণ সেন