Home রবিবারের পড়া মৃণাল সেনের ‘কোরাস’ এবং কিছু কথা

মৃণাল সেনের ‘কোরাস’ এবং কিছু কথা

0
ছবি: সূত্র বেঙ্গল ফিলম আর্কাইভ।

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

না, তখনও তার গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ হয়নি। নামমাত্র বোধহয় দুটো টিউশনি করে সে, মানে দুটো বাচ্চাকে পড়িয়ে যেটুকু রোজগার হয় তার, মানে সেই মেয়েটির, যে মেয়েটি ভাড়াবাড়িতে থাকে। তার ঘর একটাই। পিঠে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো ঠাসাঠাসি করে তারা ঘুমোয়, ঘুমোয় মেয়েটি তার ছোটবোন আর মায়ের সাথে। একটুকরো বারান্দায় কোনো রকমে রান্না। মেয়েটির অভাবী, অভাগী মা সংসার চালানোর জন্যে একটি সচ্ছল পরিবারে সারা দিন এক বৃদ্ধার দেখাশোনা করেন, আর সেই সঙ্গে সেই বাড়িতে রান্নার কাজও করেন। সেখানে নানান রকম পদের রান্না  যখন তিনি করেন, তখন হয়তো এক গভীর নিবিড় কষ্ট সেই মায়ের মনে ক্ষুধার্ত হাত পেতে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, যেমন কোনো শিশুসন্তান খিদে পেলে তার মায়ের কাছে খাবারের আবদারে হাত পাতে। যাই হোক, আমাদের এই মা একদিন নিজের দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরে কাঁদতে কাঁদতে ঝাপসা চোখ কাপড়ে মুছতে মুছতে দুই মেয়েকে বলে ওঠেন – “আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে,…আমার কষ্ট হয়,…আমি কত মাছমাংস রেঁধে আসি, আর তোদের পাতে একটু তরকারিও দিতে পারি না।”

গত শতাব্দীর সত্তর দশকের প্রথম দিকের সময়কাল। চাকরির জন্য আবেদনপত্র জোগাড় করতে গেছে আরও বহু ছেলেমেয়েদের সাথে সেই মেয়েটিও। বিরাট লম্বা লাইনে তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পরে শুরু হয় একটা গণ্ডগোল। গণ্ডগোলের মূল উদ্দেশ্য যাতে সেই বেকারদের লাইনটা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। চক্রান্ত শাসকের। তা হলে আর চাকরি দিতে হবে না। বিভিন্ন অজুহাত দেখানো যাবে। তাই শুরু হয় বোমার দৌরাত্ম্য। সবাই যে যার প্রাণ হাতে করে যে যদিকে পারল ছুটতে লাগল। মুহূর্তেই ধোঁয়া ধোঁয়া, চারিদিকে একটা অরাজকতা, অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা দানা বাঁধছে। বাস্তব চিত্রনাট্যের ধারা অনুযায়ী বেশ কিছুক্ষণ বাদে এল পুলিশ। ভিড় সামলে এল সাংবাদিকরাও। সরাসরি প্রশ্ন করা হল সেই মেয়েটিকেই – “যখন বোমাটোমা চলছিল, আপনি ছিলেন?” মেয়েটির তাৎক্ষণিক উত্তর – “ছিলাম মানে! আমার পায়ের কাছেই তো একটা বোমা…।”

ভারতবর্ষের সিনেমায় এক নতুনধারার জন্মদাতা এবং বিশ্বের এক অনন্য ধারার সিনেমা তৈরির কারিগর মৃণাল সেনের ছবি ‘কোরাস-এর এই দৃশ্যটির আজ পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল। ‘কোরাস’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৪ সালে। উল্লিখিত ঘটনার মতো আরও অনেক ঘটনা রয়েছে এই সিনেমায়, যা সেই সময়ের ইতিহাসের অনুভূতিকে জন্ম দেয় –মানুষের খিদে, দারিদ্র্য, অনাহার, চরম বেকারত্ব, শ্রমিক ছাঁটাই, শাসকের মদতে বেআইনি জমি-বাস্তু দখল, বঞ্চনা, দুর্নীতি – শোষণের নানান অধ্যায়, অনুষঙ্গ উপস্থিত এই সাদাকালো কোলাজে, মৃণাল সেনের বিশ্ববন্দিত, পুরস্কারজয়ী চলচ্চিত্র ‘কোরাস’ (১৯৭৪)-এ।

chorus 19.05

‘কোরাস’ সিনেমাটির চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন নাট্যকার কবি মোহিত চট্টোপাধ্যায় – কবি গোলাম কুদ্দুস এবং স্বয়ং চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেনের ভাবনায়, কলমের অক্ষরে অক্ষরে ঘটনাবিন্যাসে। অভিনয়ে ছিলেন গীতা সেন, উৎপল দত্ত, শেখর চ্যাটার্জি, রবি ঘোষ, শুভেন্দু চ্যাটার্জি, হারাধন ব্যানার্জি, দিলীপ রায়, সুপান্থ ভট্টাচার্য, অজয় ব্যানার্জি, রসরাজ চক্রবর্তী প্রমুখ। ক্যামেরায় ছিলেন কে কে মহাজন। আবহসংগীতের দায়িত্বে ছিলেন আনন্দ শঙ্কর। প্রযোজনায় ও পরিচালনায় স্বয়ং মৃণাল সেন। অনেক সমস্যার মুখোমুখি হয়েও তিনি ছবিটি শেষ করেছিলেন ধারদেনা করে। পরে অবশ্য সব মিটিয়ে দেন। এই হল ছবিটির নেপথ্য কাহিনি।

এই ছবিটির শুরুয়াত হয়েছে চারণের একটি গানে – “লীলাচ্ছলে ভগবান মর্ত্যে নেমে আসে/ আর দেশের কান্ডারি রূপে মহিমা প্রকাশে/ কত তন্ত্র কত মন্ত্র কত ভগবান/ অভাব রচেন যিনি তিনি শক্তিমান।”

কৌতুকের বাতাবরণে মোড়া এই ছবির অন্তঃকরণে নাগরিক জীবনের অত্যন্ত বাস্তব তিক্ততা ফুটিয়ে তুলেছেন মৃণাল সেন। বিদ্রুপ উপহাস, অসম্ভাব্যতা, অদ্ভুত তত্ত্ব-সহ মজাদার সব ভাবভঙ্গি একসময়ে ধীরে ধীরে বিস্ফোরিত হয়েছে বিক্ষুব্ধ বিদ্রোহের রাগত মেজাজে। এই হল ‘কোরাস’।

এখন মৃণাল সেন ১০১-এ বিরাজ করছেন (জন্ম – বাংলাদেশের ফরিদপুরে, ১৪ মে ১৯২৩; চলে যাওয়া – ভবানীপুর, কলকাতায়, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮)। তাঁর ভাবনাচিন্তার পটভুমিকা তৈরি হয়েছিল কলকাতায় পড়তে এসে গত শতকের চল্লিশের দশকে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সংস্পর্শে এসে। পরে দিন আনা দিন খাওয়া জীবনযাপনে কখনও তিনি মেডিকেল রিপ্রেসেন্টেটিভ, কখনও সাংবাদিক, কখনও বা সিনেমায় সহকারী। সবশেষে পুরোপুরি চলচ্চিত্র পরিচালনায়।

আসলে ‘কোরাস’ সিনেমার স্রষ্টাকে নিয়ে কিছু বলতে গেলে মনে পড়ে ফরাসি কবি জ্যঁ ককতো-র কবিতার সেই লাইনটি – “ফাটলের মধ্য দিয়ে কবিতা অনুপ্রবেশ করে…”। সত্যিই তা-ই। মৃণাল সেন সেই ব্যক্তিত্ব, যাঁর কাছে বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার আকিরা কুরোসাওয়া, এলাঁন রেনে, জঁ-লুক গদার সহৃদয় মিত্রতায় বিরাজ করেন, চলচ্চিত্র নিয়ে ভাববিনিময় হয়। বিশ্বখ্যাত অভিনেত্রী সোফিয়া লোরেন এবং চিলির কবি গার্সিয়া মার্কেজ প্রমুখ মৃণালের বন্ধু ছিলেন, বিশ্ববরেণ্য চিত্রপরিচালক কার্লোস রেগাডাস, জাফর পানাহির মতো ব্যক্তিত্বরা কলকাতায় এলে একমাত্র মৃণাল সেনের খোঁজ করতেন সময় কাটানোর জন্য, সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, শ্যাম বেনেগাল, আদুর গোপালকৃষ্ণান প্রমুখ চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব বিমুগ্ধতায় মৃণাল সেনকে দেখতেন মৃণালের চলচ্চিত্রের কোলাজে, মন্তাজে, লং শটে, ক্লোজ শটের অনবদ্য কাজের মাধ্যমে।

‘কোরাস’-এর একটি দৃশ্য।

মৃণাল সেন কমিউনিস্ট মতাবলম্বী। তিনি দেখেছেন, পথে ঘাটে মাঠে নেমেছেন মানুষের অধিকারের দাবিতে আন্দোলনের সমর্থক হিসাবে। তাই তাঁর সঙ্গী কবি বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, কবি সমর সেন, কবি অরুণ মিত্র, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য, নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য, নাট্যকার শম্ভু মিত্র, অভিনেতা বলরাজ সাহনি, অভিনেতা এ কে হাঙ্গল, চিত্রপরিচালক ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায়, গায়ক দেবব্রত বিশ্বাস, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সাহিত্যিক সমরেশ বসু, গায়িকা সুচিত্রা মিত্র এবং ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সমকালীন গুণীজনেরা এবং কমিউনিস্ট মনস্কতার মানুষজন।

যা-ই হোক প্রসঙ্গে চলে আসি। আজ থেকে ৫০ বছর আগের তৈরি সিনেমা এই ‘কোরাস’ যেন আজও প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে আমাদের কাছে সেই সময়ের সাথে সাথে আজকের এই মুহূর্তের এক দলিল হিসাবে, এক ইস্তাহার হিসাবে।

সেই গত শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে আজকের এই নতুন শতকের তৃতীয় দশকের মাঝামাঝি সময়ে এসেও আজও আমরা জর্জরিত সেই অর্থনৈতিক অসাম্যতায়। যার ফলে সমাজজীবনে আজও দারিদ্র্য, অন্যায়-অবিচার, প্রকাশ্য দুর্নীতি, শাসকের উলঙ্গ প্রকাশভঙ্গিমা, খেটে খাওয়া সাধারণ আটপৌরে মানুষের প্রতি অসহিষ্ণুতা ইত্যাদি বর্তমান।

যদিও মাঝখানে কেটে গেল ৫০ বছর, কিন্তু অবস্থা যা ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।

‘কোরাস’ সিনেমাটি তৈরি হওয়ার প্রায় কুড়ি বছর পরে নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় স্টকহোমে এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে মৃণাল সেন বলেছিলেন, “শাসন করার অধিকার, এই ব্যাপারটি পুরো ধুয়ে মুছে ফেলা দরকার। সে যে কোনো স্তরেই হোক না কেন, নৈতিক হোক সামাজিক, অর্থনৈতিক হোক বা রাজনৈতিক।”

এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলা ভালো যে ‘কোরাস’ সিনেমটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে, আর তার ৬ মাস পরে ১৯৭৫ সালের জুন মাসে ভারতবর্ষ মুখোমুখি হয়েছিল ‘জরুরী অবস্থা’র।

মৃণাল সেনের ১০১তম জন্মবার্ষিকী এবং ‘কোরাস’-এর ৫০ তম মুক্তিবার্ষিকীর সন্ধিক্ষণে মৃণাল সেনকে আমরা যেন নতুন করে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ভাবে গ্রহণ করি – এটাই সময়ের দাবি।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version