Home রবিবারের পড়া কত দূরের, তবু কত কাছের তিনি – উত্তমকুমার

কত দূরের, তবু কত কাছের তিনি – উত্তমকুমার

উত্তমকুমারের শতবর্ষে খবর অনলাইন-এর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর, আহিরীটোলার বাপের বাড়িতে শ্রীমতী চপলা দেবী জননী হলেন। অত্যন্ত মধ্যবিত্ত সাংসারিক মানুষ সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়ের ঘরনি চপলাদেবীর কোল জুড়ে এল যে শিশু, সেই শিশুই আগামী দিনের বাংলা সিনেমার ‘অরুণ’ – হল অরুণোদয়। তার বড়ো হতে থাকা ভবানীপুরের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে।

তার পর জীবনের পঁচিশ বসন্ত পেরিয়ে অরূপ কুমার নাম নিয়ে অরুণ কুমার একের পর এক অসফল ছবির চরিত্রে অবতীর্ণ। নতুন নাম হল – ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’। পেটের দায়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন পোর্ট কমিশনার্স-এর কেরানির চাকরিটা।

uttam nayak 07.09

‘নায়ক’-এ শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে।

তার পর এল ১৯৫৪ সাল। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া দেশে দু-টুকরো বাংলার জীবনকথা নিয়ে চলচ্চিত্র, একান্নবর্তী পরিবারের কাহিনি ‘বসুপরিবার’ নিয়ে এল কিছুটা সাফল্য। সেই বছরেই নবাগতা সুচিত্রার সাথে সেই ছবি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। বাঙালির ঘরের ছেলে হয়ে বাঙালির চলচ্চিত্রের উঠোনে এসে দাঁড়িয়ে নিজের নাম ঘোষণা করলেন ‘উত্তম কুমার’। জীবনানন্দের কথায় – ‘চাঁদ একটাই আসে…’।

পঞ্চাশের দশক থেকে সত্তর দশক – একটানা তিরিশটা বছর উত্তম কুমার চলচ্চিত্রাকাশের একমাত্র নক্ষত্র হলেও তিনি আমাদের ঘরের পরিচিত মানুষ, আমাদের খুব কাছের যেন প্রতিবেশী।

‘সপ্তপদী’-তে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে।

খুবই বাঙালিয়ানা চেহারা, খুবই কাছের মন ছোঁয়ানো, ভালো লাগার মাধুরী চোঁয়ানো অভিব্যক্তি, ভুবন ভোলানো একমুখ হাসি, কথা বলা – এককথায় নাটকীয়তাহীন সমস্ত চলন-বলন। বাঙালির ঘরের মন জয় করার এক অনন্যসাধারণ সেতু, যে সেতু দিয়ে চলতে চলতে বলা যায়, ‘চণ্ডীদাস কয় নব পরিচয় কালিয়া বঁধুর সনে’। বাঙালির ঘরে ঘরে যেমন কৃষ্ণ গোপাল, যেমন রবীন্দ্র-নজরুল, যেমন শ্রীমা, শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র, ঠিক তেমনই ম্যাটিনি আইডল উত্তমকুমার। উত্তমকুমার তো আমাদের আত্মীয়।

তাই তো রবীন্দ্রনাথের ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’-এ রাইচরণ, শরৎচন্দ্রের ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’-এ স্বয়ং শ্রীকান্ত, তারাশঙ্করের ‘রাইকমল’-এ ঠাকুরজামাই, শরৎচন্দ্রের  রাজনৈতিক উপন্যাস ‘পথের দাবী’-র বিপ্লবী সব্যসাচী, বনফুলের ‘অগ্নীশ্বর’-এর অগ্নীশ্বর, তারাশঙ্করের ‘সপ্তপদী’-তে কৃষ্ণেন্দু, পীযূষ বসু পরিচালিত ‘জীবন জিজ্ঞাসা’-য় সেই দ্বান্দ্বিক চরিত্রের নায়ক ইন্দ্র, সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘নায়ক’-এ অরিন্দম, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চিড়িয়াখানা’য় ব্যোমকেশ, পীযূষ বসু পরিচালিত ‘সন্ন্যাসীরাজা’য় ভাওয়ালের জমিদার থেকে হওয়া সন্ন্যাসী – এই সব চরিত্রচিত্রণে মহানায়ক উত্তমকুমার একমেবাদ্বিতীয়ম – এই বিষয়ে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে?

‘চিড়িয়াখানা’য় শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে।

উত্তম কুমার প্রথমত এবং শেষত আমাদেরই তথা দর্শকদেরই। তিনি অভিনয়ের মাত্রাজ্ঞান কখনোই অতিক্রম করেননি। তাই তো যখন ঠিক হল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নিশিপদ্ম’ বলিউডে তৈরি হবে এবং উত্তমকুমারের অভিনয় করা চরিত্রে নামবেন বলিউডের তৎকালীন সুপারস্টার রাজেশ খান্না, তখন রাজেশবাবু অসংখ্যবার দেখেছিলেন বাংলা ‘নিশিপদ্ম’-এ উত্তমকুমার অভিনীত চরিত্রটি। পরে রাজেশ খান্নাই এক ইন্টারভিউতে বলেছেন, “আমি উত্তমকুমার সাহেবের ধারেকাছে যেতে পারিনি।”

একই কথা বলেছিলেন অমিতাভ বচ্চন ‘দেশপ্রেমী’ সিনেমা করার সময়ে – তাঁর অভিনয় শেখা উত্তমকুমারের অভিনয় দেখে। সত্যজিৎ রায় জানিয়েছিলেন, ‘নায়ক’-এর চিত্রনাট্যই লেখা হয়েছিল উত্তমবাবুকে ভেবে।”

‘সন্ন্যাসীরাজা’য়।

আচ্ছা উত্তমকুমার কি শুধুই আমাদের মহানায়ক? কাছের তবু দূরের নক্ষত্র? বোধহয় না। কারণ, তিনি আমাদের ঘরের আপনজন। তিনি আমাদের অনেক কিছু দিয়েছেন, অভিনয় ছাড়াও। সে কথা আমরা ক’জন জানি?

আমরা যখন সবাই রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসকে ভুলতে বসেছি, তখন তাঁকে নিয়ে রবীন্দ্রসদনে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন উত্তমকুমার। সে দিন হলে সকলের জায়গা হয়নি, রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানুষ শুনেছিলেন গান। আর সব আবডাল ভেঙে উত্তমকুমার সব কিছুর তদারকি করেছিলেন উত্তম স্বয়ং। সে দিন দেবব্রত বিশ্বাস আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে তিনি গানও করেছিলেন রবীন্দ্র সদনের মঞ্চে।

৩ নম্বর ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে প্রায়শই আসতেন বহু অসহায় মানুষ, শিল্পী – সাহায্যের জন্য। সবার অলক্ষ্যে থেকে তাদের দিকে হাত উজাড় করে দিতেন তিনি। তবে একটি শর্ত – কেউ যেন না জানতে পারে।

‘দেয়া নেয়া’-য়।

আজ তিনি নেই সাথে, তবু যেন মনে হয় তিনি রয়েই গেছেন, তাঁর জন্মের শতবর্ষের মাধুর্য নিয়ে বাংলা ও বাঙালির হৃদয়ের নকশিকাঁথার শীতলপাটিতে, সেই হাসি, সেই চাউনি নিয়ে, বাংলা চলচ্চিত্রের আকাশ ছেয়ে।

স্মৃতির স্মরণে তাই আজও ভেসে বেড়ায় তাঁরই অভিনীত চরিত্রের সেই গানগুলি –‘শুধু ভালোবাসা দিয়ে বলে যাই আমি তোমারে বেসেছি ভালো’, ‘আমি যাই, চলে যাই’। কিন্তু সব যাওয়াই তো আর যাওয়া নয়, বরঞ্চ বলা যায় স্মৃতিতে, স্মরণগীতিতে বারবার ফিরে আসা। তাই উত্তমকুমার ছিলেন, আছেন, থাকবেন— যত দিন বাঙালি ও বাঙলা ভাষা থাকবে, যত দিন বাঙলার আকাশে সূর্য চন্দ্র থাকবে। সে এক চিরন্তন শাশ্বত অধ্যায়।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version