Homeপ্রবন্ধরক্তঝরা ১৯ মে, বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবিতে প্রাণ দিয়েছিলেন কমলারা  

রক্তঝরা ১৯ মে, বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবিতে প্রাণ দিয়েছিলেন কমলারা  

প্রকাশিত

শম্ভু সেন

বাংলা ভাষার অধিকার নিয়ে আন্দোলন বলতেই আমাদের ২১ ফেব্রুয়ারির কথা মাথায় আসে। কিন্তু মনে রাখতে হবে একুশের পাশাপাশি একটা উনিশেও আছে –  ১৯ মে। এই ১৯ মে দিনটাকে আমরা ভুলতে বসেছি। বাংলা ভাষার ইতিহাসে আরও একটি রক্তঝরা দিন।

ঠিক ৬২ বছর আগে ১৯৬১ সালের এই দিনেই বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন এগারো জন ভাষাসৈনিক – দশ জন তরুণ, এক জন তরুণী – কানাইলাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হিতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্রনাথ দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকোমল পুরকায়স্থ এবং কমলা ভট্টাচার্য।

ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা আর বরাক উপত্যকা নিয়ে আজকের অসম। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা অসমিয়া হলেও সেখানেও বাংলাভাষীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। আর করিমগঞ্জ, কাছাড়, শিলচর, হাইলাকান্দি নিয়ে গড়া বরাক উপত্যকা তো হল পুরোপুরি বাঙালিদের এলাকা। দেশ বিভাগের এক বছর পর রেফারেন্ডামের মাধ্যমে সুরমা ভ্যালি (বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট বিভাগ) পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু বৃহত্তর সিলেটের তিন-চতুর্থাংশ নিয়ে গঠিত বরাক ভ্যালি থেকে যায় অসমে।

১৯৬০ সালের ২১ ও ২২ এপ্রিল বসেছিল অসম প্রদেশ কংগ্রেসের বৈঠক। সেই বৈঠকে অসমিয়াকে রাজ্যভাষা করা নিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। মাস দুয়েক পরে মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা বিধানসভায় ঘোষণা করেন অসমিয়াকে রাজ্যভাষা করা নিয়ে সরকার শীঘ্রই একটি বিল আনছেন। এই সিদ্ধান্ত অসমে বাঙালি-বিদ্বেষ আরও চাগিয়ে তোলে। শুরু হয় ‘বঙ্গাল খেদাও’। অসমের বাঙালিদের ওপর নেমে আসে অত্যাচার। এই অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে শুরু করলে বাংলাভাষীরা দলে দলে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে বরাক উপত্যকা, প্রতিবেশী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তরপূর্বের অন্যান্য অঞ্চলে আশ্রয় নেয়।

19th may 1961 1 19.05

২ জুলাই শিলচরে ‘নিখিল আসাম বাংলা ও অন্যান্য অনসমিয়া ভাষা সম্মেলন’ ডাকা হয়। সেই সম্মেলনে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যোগ দেয় লুসাই, খাসিয়া, গারো, মণিপুরী ও বাঙালি প্রতিনিধিরা। ভাষার প্রশ্নে হস্তক্ষেপ করার জন্য তারা সম্মিলিত ভাবে আবেদন করে কেন্দ্রের কাছে। এ ভাবেই অহিংস সমাবশের মধ্য দিয়ে বাঙালিরা তাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে দিয়েছিল। ১৯৬০ সালের ১৫ আগস্ট। কলকাতা পালন করল শোক দিবস। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা উত্তেজনায় ফেটে পড়ল। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু গোবিন্দবল্লভ পন্থকে শান্তিদূত করে পাঠালেন অসমে। পন্থজি ফর্মুলা দিলেন। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা নির্দ্বিধায় তা নাকচ করে দিল। কাছাড়বাসীরা ছুটল দিল্লি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার নির্বিকার। ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর রাজ্যভাষা বিল পাশ হয়ে গেল অসম বিধানসভায়। নতুন আইনে সমগ্র অসমে সরকারি ভাষা হল অসমিয়া। শুধুমাত্র কাছাড়ে জেলাস্তরে রইল বাংলা ভাষা।

বরাক উপত্যকা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠল। ভাষার প্রশ্নে এক মন এক প্রাণ হয়ে শপথ নিল ‘জান দেব, তবু জবান দেব না’। মাতৃভাষার মর্যাদা যে কোনো মূল্যে রক্ষা করার শপথ নিল বরাকের বাঙালিরা। ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি করিমগঞ্জ রমণীমোহন ইনস্টিটিউটে কাছাড় জেলা সম্মেলন আহ্বান করা হল। সম্মেলন থেকে দাবি তোলা হল, ‘বাংলাকে অসমের অন্যতম রাজ্যভাষা হিসাবে মানতে হবে’। অসম সরকারের কাছে চিঠি পাঠিয়ে ১৩ এপ্রিলের মধ্যে জবাব চাওয়া হল। গঠিত হল কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ।

অসম সরকার নিরুত্তর। সরাসরি লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তৈরি হল বরাক। ধাপে ধাপে আন্দোলন জোরদার করা হল। ১৪ এপ্রিল শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দির মানুষ অসম সরকারের অবিচারের প্রতিবাদে সংকল্প দিবস পালন করলেন। ২৪ এপ্রিল কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বরাক উপত্যকায় একটি দীর্ঘ পদযাত্রার আয়োজন করে। এই পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা প্রায় ২০০ মাইলেরও বেশি পথ অতিক্রম করে বরাকের গ্রামে গ্রামে বাংলা ভাষার দাবির সমর্থনে প্রচার চালিয়ে গেলেন। মিছিলটি শেষ হয় শিলচরে, ২ মে। পরে হাইলাকান্দিতেও এ ধরনের পদযাত্রা সংগঠিত হয়।

পদযাত্রার পর পরিষদের প্রধান রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেন যে বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে এবং অন্য ভাষাগত সংখ্যালঘুদের ভাষার যথাযথ স্বীকৃতির দাবিতে ১৯ মে থেকে সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত হরতাল পালন করা হবে। ছাত্রসমাজের ডাকে ১৮ মে করিমগঞ্জ শহরে যে শোভাযাত্রা বেরোল, তা যেন এক গণ-অভ্যুত্থানের রূপ নিল। মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার দাবিতে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা যোগ দিল শোভাযাত্রায়। আর সেই শোভাযাত্রার মোকাবিলা করতে সারা জেলা ছেয়ে গেল পুলিশ আর মিলিটারিতে। জারি হল ১৪৪ ধারা। করিমগঞ্জ সংগ্রাম পরিষদের দুই নেতা রথীন্দ্রনাথ সেন ও নলিনীকান্ত দাস এবং ছাত্রনেতা নিশীথরঞ্জন দাসকে গ্রেফতার করা হল।

19th may kamala 19.05

বাংলা ভাষা আন্দোলনের একমাত্র নারী শহিদ কমলা ভট্টাচার্য।

১৯ মে। ভোর চারটে থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত বরাক উপত্যকায় হরতালের ডাক দিল কাছাড় জেলা সংগ্রাম পরিষদ। ডাক দেওয়া হল – ট্রেনের চাকা ঘুরবে না, বিমানের পাখা ঘুরবে না, অফিসের তালা খুলবে না। ভোর হতেই সত্যাগ্রহীরা রেললাইন অবরোধ করল, রানওয়ের ওপর শুয়ে পড়ল, দল বেঁধে দাঁড়াল বিভিন্ন অফিসের সামনে। সত্যাগ্রহে উত্তাল হয়ে উঠল শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, উধারবন্দ, পাথারকান্দি, বদরপুর-সহ গোটা বরাক উপত্যকা।

বেলা দু’টো, দুপুর গড়িয়ে চলেছে। মাতৃভাষা জিন্দাবাদ ধ্বনিতে শিলচর রেলস্টেশন মুখর। হঠাৎ গুলির আওয়াজ। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে এল ‘শান্তিরক্ষক’দের রাইফেল থেকে। রক্তে ভেসে গেল শিলচর স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম। ‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিতে দিতে গুলিতে লুটিয়ে পড়ল ১১টি তাজা প্রাণ। ১৯৬১-এর ১৯ মে জন্ম দিল আরও ১১ জন ভাষাশহিদের। ১৬ বছরের কমলা দু’ দেশের বাংলা ভাষা আন্দোলনে একমাত্র নারীশহিদ।

কমলাদের আত্মবলিদান বৃথা যায়নি। ১৯৬০ সালের অসম ভাষা আইন সংশোধন করা হয়। শহিদের রক্তভেজা বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পেল।

’৫২-এর পরে ’৬১। একই ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে ন’ বছরের ব্যবধানে দু’টি আন্দোলন দু’টি ভিন্ন দেশে। বিশ্বের ইতিহাসে এ এক বিরল ঘটনা। আমরা, বাঙালিরা, যেন মনে রাখি, একুশের পাশাপাশি আমাদের একটা উনিশেও আছে। ১৯ মে – কমলাদের আত্মত্যাগের দিন।

আরও পড়ুন

মাধ্যমিকের ফলপ্রকাশ, ৬৯৭ পেয়ে প্রথম কাটোয়ার দেবদত্তা মাজি

সাম্প্রতিকতম

ক্যালকাটা জার্নালিস্টস ক্লাবের উদ্যোগে নারায়ণা হেলথ্‌-এর সহায়তায় স্বাস্থ্যপরীক্ষা শিবির

নিজস্ব প্রতিনিধি: কলকাতা শহরের অন্যতম বৃহৎ সাংবাদিক-সংগঠন ক্যালকাটা জার্নালিস্টস ক্লাব রবিবার স্বাস্থ্যপরীক্ষা শিবিরের আয়োজন...

ত্রিমুকুট অধরাই থাকল, হার মোহনবাগানের, আইএসএল ফাইনালে বদলা নিল মুম্বই

মোহনবাগান সুপার জায়েন্ট: ১ (কামিংস) মুম্বই সিটি এফসি ৩ (দিয়াজ, বিপিন, ইয়াকুব) খবর অনলাইন ডেস্ক:...

এখনও বেপাত্তা ‘তারক মেহতা…’র অভিনেতা গুরুচরণ সিং, পুলিশের সন্দেহ ‘উধাও’ হওয়ার ছক নিজেই কষেছিলেন

খবর অনলাইন ডেস্ক: জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল ‘তারক মেহতা কা উলটা চশমা’র এক অত্যন্ত জনপ্রিয়...

সন্দেশখালির ‘স্টিং অপারেশন’ ভিডিও নিয়ে তোলপাড় রাজ্য, কী আছে ওই ভিডিয়োয়

কলকাতা: সন্দেশখালিতে নারী নির্যাতন, ধর্ষণের অভিযোগ মিথ্যা, ভুয়ো। শনিবার সকালে ভাইরাল হওয়া ভিডিয়োতে এমনই...

আরও পড়ুন

বাংলার নববর্ষের সঙ্গে রয়েছে পুণ্যাহের যোগ

মুর্শিদকুলি খা পয়লা বৈশাখের সময় রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করেন। এই সময় ধান উঠত খামারে। আর তখনই রাজস্ব আদায়ের দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়। সেটাই পুণ্যাহ উৎসব।

তৃণমূলের সঙ্গে ফের আসন ভাগাভাগিতে কংগ্রেস, কার ভাগে ক’টা

৪২-এর মধ্যে কোন আসনগুলি চাইছে কংগ্রেস? ক'টি আসন ছাড়তে রাজি তৃণমূল? জয়ন্ত মণ্ডল ২০২৪-এ বিজেপির বিরুদ্ধে...

সুড়ঙ্গ থেকে শ্রমিকদের উদ্ধার করে মুন্না, ফিরোজরা মনে করিয়ে দিলেন জন হেনরিকে – ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ওই…’

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায় ‘মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না,...