Homeপ্রবন্ধসুদ ভিত্তিক অর্থনীতি কি গোটা পৃথিবীর গরিব মানুষকে শেষ করে দিচ্ছে?

সুদ ভিত্তিক অর্থনীতি কি গোটা পৃথিবীর গরিব মানুষকে শেষ করে দিচ্ছে?

প্রকাশিত

সুদ ভিত্তিক অর্থনীতি (Interest-based Economy) বিশ্বের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক কাঠামো হয়ে উঠেছে। এই ব্যবস্থায় বিনিয়োগের উপর নির্ধারিত সুদের হার অনুসারে অর্থনৈতিক লেনদেন পরিচালিত হয়। কিন্তু, সুদ ভিত্তিক অর্থনীতির ফলে দরিদ্র মানুষের উপর যে গভীর প্রভাব পড়ছে, তা বর্তমানে ক্রমশ বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অনেকেই মনে করেন, সুদের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা অর্থনীতি গরিব মানুষকে আরও দরিদ্র করে তুলছে এবং বৈষম্যের প্রসার ঘটাচ্ছে। এখন দেখে নেওয়া যাক, সুদ ভিত্তিক অর্থনীতি কীভাবে গরিব মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলে এবং তাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

১. সুদ ভিত্তিক অর্থনীতির মৌলিক ধারণা

সুদ ভিত্তিক অর্থনীতি বলতে আমরা বোঝাতে চাই, যেখানে পুঁজির বিনিময়ে একটি নির্দিষ্ট সুদের হার আরোপ করা হয়। যখন কেউ ঋণ নেয়, তাকে সুদ সহ ঋণ ফেরত দিতে হয়। এতে মূল টাকার চেয়ে বেশি অর্থ প্রদান করতে হয়, যা সেই ঋণগ্রহীতার জন্য একটি বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষত দরিদ্র মানুষের জন্য, যারা আর্থিক সংকট বা সীমিত আয়ের কারণে ঋণের উপর নির্ভরশীল, সুদ তাদের জন্য আরও চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।

২. দরিদ্র মানুষের উপর সুদের বোঝা

সুদভিত্তিক অর্থনীতির ফলে দরিদ্র মানুষকে যে প্রধান সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, তা হল ঋণের সঙ্গে সুদের বোঝা। সাধারণত দরিদ্র মানুষরা ব্যাংক বা ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয় তাদের দৈনন্দিন খরচ মেটানোর জন্য। কিন্তু এই ঋণ পরিশোধের সময় সুদ-সহ দিতে হয়, যা তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটায়। তারা ঋণমুক্ত হওয়ার বদলে আরও বেশি ঋণের জালে আটকে যায়।

বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ যেমন, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফ্রিকার অনেক দেশ সহ আরও অনেক জায়গায় দরিদ্র মানুষের জীবনে সুদের এই বোঝা তাদের আরও দরিদ্র করে তুলছে। অভিযোগ, মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানগুলো যদিও প্রথমে গরিবদের সাহায্য করার লক্ষ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল, কিন্তু বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের উপর উচ্চ সুদের হার চাপিয়ে দিচ্ছে, যা তাদের সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।

৩. আয়ের অসম বন্টন এবং বৈষম্য বৃদ্ধি

সুদ ভিত্তিক অর্থনীতি সমাজের আয়ের অসম বণ্টনকে উৎসাহিত করে। ধনী শ্রেণি বা পুঁজিপতিরা সুদের মাধ্যমে তাদের সম্পদ বাড়িয়ে নেয়, যেখানে দরিদ্র শ্রেণি ঋণের ফাঁদে পড়ে। ধনীরা পুঁজি বিনিয়োগ করে এবং সুদের মাধ্যমে অতিরিক্ত লাভ অর্জন করে, অন্যদিকে গরিবরা ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়ে। এই ব্যবস্থায় এক পক্ষ ক্রমাগত ধনী হতে থাকে এবং অন্য পক্ষ আরও দরিদ্র হয়।

এই বৈষম্যের চক্রটি ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যে ফাঁককে আরও প্রশস্ত করে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক উন্নতির হার যতই বাড়ুক, দরিদ্র জনগোষ্ঠী ক্রমাগত বৈষম্যের শিকার হয়। সুদ ভিত্তিক অর্থনীতি এই বৈষম্যকে আরও তীব্র করে তোলে, কারণ এটি একটি ব্যবস্থার মাধ্যমে ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির পথ সুগম করে, যেখানে দরিদ্ররা সম্পদের অভাবে দিন দিন আরও নিঃস্ব হয়ে পড়ে।

৪. সামাজিক শোষণ এবং ঋণের ফাঁদ

বিশ্লেষকদের মতে, সুদ ভিত্তিক অর্থনীতি দরিদ্রদের উপর একটি সামাজিক শোষণ সৃষ্টি করে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী ঋণের মাধ্যমে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে, কিন্তু ঋণের সুদের হার এতটাই বেশি যে তারা অনেক সময়ই ঋণমুক্ত হতে পারে না। বিশেষ করে কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, এবং বেকাররা এই ঋণের ফাঁদে বেশি পড়ে। তারা ঋণ গ্রহণ করে কিন্তু সুদ পরিশোধ করতে না পেরে পুনরায় ঋণ নিতে বাধ্য হয়। এভাবে তাদের জীবনে একটি চক্র তৈরি হয়, যা থেকে মুক্ত হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

বিশ্বের অনেক জায়গায়, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে, দরিদ্র কৃষকেরা চড়া সুদের ঋণ নিয়ে জমি চাষ করে। ফসল ভালো না হলে তাদের সেই ঋণ শোধ করা সম্ভব হয় না, ফলে তারা সম্পূর্ণভাবে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রেই এমন ঘটনা ঘটেছে যেখানে ঋণ শোধ করতে না পেরে কৃষকেরা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। এই সবকিছুর পিছনে মূল কারণ হল সুদ ভিত্তিক অর্থনীতির একতরফা শোষণ।

৫. সমাধান ও বিকল্প পথ

সুদ ভিত্তিক অর্থনীতির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কিছু বিকল্প পথ বের করতে হবে। প্রথমত, সুদের পরিবর্তে ন্যায্য ও পারস্পরিক লেনদেনের ভিত্তিতে অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, সুদমুক্ত অর্থনীতি দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সহজ শর্তে এবং কম সুদের হার বা সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের তরফ থেকে মাইক্রোফাইন্যান্স সিস্টেমকে আরও উন্নত করতে হবে, যাতে ঋণের বোঝা না বাড়িয়ে তাদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলা যায়।

৬.সুদ ভিত্তিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ

সুদ ভিত্তিক অর্থনীতি দরিদ্র মানুষের জন্য একটি মারাত্মক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। একাংশের অর্থনীতিবিদের মতে, এটি শুধু অর্থনৈতিক ভাবে তাদের দুর্বল করছে না, বরং সমাজে বৈষম্য বাড়িয়ে তুলছে। দরিদ্র মানুষের ঋণ শোধের ক্ষমতা কম, ফলে তারা আরও বেশি শোষণের শিকার হচ্ছে। এ অবস্থায় দরিদ্রদের সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।

আরও পড়ুন: ‘আমি আর পারছি না’! সুইসাইড নোটে কর্তৃপক্ষের চাপের কথা লিখে আত্মহত্যা বেসরকারি ফিনান্স সংস্থার এরিয়া ম্যানেজারের

আপনার প্রশ্ন, আমাদের উত্তর

সাম্প্রতিকতম

কলকাতায় সাউথ সিটি মলে স্কেচার্সের নতুন স্টোর উদ্বোধন করলেন কার্তিক আরিয়ান

কলকাতার সাউথ সিটি মলে নতুন স্টোর খুলল স্কেচার্স। উদ্বোধনে উপস্থিত ছিলেন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর কার্তিক আরিয়ান। কমিউনিটি গোল চ্যালেঞ্জে অংশ নিয়ে কেল ফাউন্ডেশনে শিশুদের জন্য জুতো দান করল সংস্থা।

পুজোর আগে সুখবর, সরকারি কর্মীদের জন্য এলটিসি-এইচটিসির মেয়াদ বাড়ল এক বছর

রাজ্য সরকারি কর্মীদের জন্য বড় সিদ্ধান্ত নিল নবান্ন। এলটিসি ও এইচটিসির মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৬ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত করা হল। আগামী এক বছরের মধ্যে যাঁরা সুবিধা নিতে পারেননি, তাঁরা তা ব্যবহার করতে পারবেন।

কবি সুভাষের পর শহিদ ক্ষুদিরামেও পরিষেবা কমল, পুজোর মুখে বিপাকে মেট্রো যাত্রীরা

দক্ষিণ কলকাতার শহিদ ক্ষুদিরাম স্টেশনে মেট্রো পরিষেবা কমানোর সিদ্ধান্ত নিল কর্তৃপক্ষ। কবি সুভাষ স্টেশনে সংস্কারের কাজ চলায় আগেই বন্ধ ছিল পরিষেবা। বৃহস্পতিবার লাইনের গণ্ডগোলে অর্ধঘণ্টা বন্ধও থাকল মেট্রো।

উত্তরবঙ্গে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস, দক্ষিণেও ঝড়বৃষ্টি; একাধিক জেলায় সতর্কতা জারি

মৌসুমি অক্ষরেখা ও ঘূর্ণাবর্তের প্রভাবে রাজ্যে ঝড়বৃষ্টি। উত্তরবঙ্গের পাঁচ জেলায় ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা, আলিপুরদুয়ারে কমলা সতর্কতা। দক্ষিণবঙ্গেও একাধিক জেলায় হলুদ সতর্কতা জারি।

আরও পড়ুন

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: ভুলে গিয়েছি অগ্নিস্নাত বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষকে  

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায় মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেননি। বিধানচন্দ্র রায়কে আশীর্বাদও করেননি। বল্লভভাই পটেলের...

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: ‘এবার তবে আসি মা!’

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায় একটা সুবৃহৎ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস এত পক্ষপাতিত্ব করে লেখা হয়েছে, যার উদাহরণ...

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: জালিয়ানওয়ালাবাগ ও উধম সিং

সে দিন ব্রিটিশ শাসক অসংখ্য নিরপরাধ ভারতীয় নরনারীকে বুলেটের বন্যায় ধরাশায়ী করেই ক্ষান্ত হয়নি, শহরের গণ্যমান্য নাগরিকদের ঘর থেকে বাইরে টেনে টেনে এনে রাস্তায় হামাগুড়ি দিতে বাধ্য করেছিল। প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে ভারতীয়দের নাকে খত দিতে বাধ্য করেছিল ব্রিটিশ শাসক সে দিন।