হঠাৎ করে অশান্ত লাদাখ। সংবাদসংস্থার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই হিংসায় অন্তত ৪ জন মারা গিয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ৭০ জন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কার্ফু জারি করা হয়েছে।
প্রশ্ন হল, এতদিন শান্ত থাকা এই অঞ্চলে হঠাৎ করে অশান্ত হয়ে উঠল। এই বিক্ষোভের পেছনে বেশ কিছু গভীর কারণ রয়েছে।
মূলত, ২০১৯ সালে জম্মু ও কাশ্মীর থেকে লাদাখকে পৃথক করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করার পর থেকেই এখানকার মানুষের মনে এক ধরনের অসন্তোষ তৈরি হচ্ছিল, যা এখন আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে কেন এই বিক্ষোভ। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির কী অবস্থান তা খতিয়ে দেখা যাক।
অশান্তির মূল কারণ
১. পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা ও ষষ্ঠ তফসিলের দাবি: লাদাখের মানুষের মূল দাবি হলো, তাদের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা থেকে উন্নীত করে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হোক। এর পাশাপাশি তারা সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্তির দাবিও জানাচ্ছে। ষষ্ঠ তফসিল হলো এমন একটি সাংবিধানিক ব্যবস্থা যা উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের ভূমি, সংস্কৃতি, এবং স্বশাসনের অধিকার রক্ষা করে। লাদাখের জনসংখ্যার প্রায় ৯৭ শতাংশই তফসিলি উপজাতিভুক্ত, তাই তাদের এই দাবি খুবই যুক্তিযুক্ত। তারা মনে করে, সাংবিধানিক সুরক্ষা না পেলে তাদের জমি, সংস্কৃতি এবং স্থানীয় কর্মসংস্থান ঝুঁকির মুখে পড়বে।
২. প্রশাসনিক অবহেলা ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের অভাব: কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়ার পর থেকেই লাদাখের মানুষের মধ্যে এক ধরনের প্রশাসনিক উদাসীনতা এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের অভাব নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে। তারা মনে করছে, তাদের নিজস্ব নির্বাচিত সরকার বা বিধানসভা না থাকায় দিল্লির সরাসরি শাসনের অধীনে তারা তাদের নিজস্ব সমস্যার সমাধান করতে পারছে না।
৩. চাকরি ও কর্মসংস্থানের অভাব: লাদাখের যুবসমাজ বেকারত্বের সমস্যা নিয়ে হতাশ। তারা মনে করে, পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা না পেলে এবং সাংবিধানিক সুরক্ষা না পেলে তাদের জন্য সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে না। এই হতাশা থেকেই যুবসমাজ বিক্ষোভে শামিল হচ্ছে।
৪. প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ: ২০১৯ সালে যখন লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হয়, তখন স্থানীয় অনেক নেতা ও সাধারণ মানুষ এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তাদের ধারণা ছিল, এই পদক্ষেপের ফলে তাদের দীর্ঘদিনের দাবি যেমন রাজ্যের মর্যাদা এবং সাংবিধানিক সুরক্ষা, তা পূরণ হবে। কিন্তু কেন্দ্র সরকার সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ না করায় ক্রমশ তাদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে থাকে।
৫. জলবায়ু কর্মী সোনম ওয়াংচুকের অনশন: জলবায়ু কর্মী এবং শিক্ষাবিদ সোনম ওয়াংচুক লাদাখের এই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ। তিনি দীর্ঘ দিন ধরে এই দাবিগুলোর পক্ষে অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি, তার অনশনে থাকা কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়লে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তার শান্তিপূর্ণ আন্দোলন একদল বিক্ষুব্ধ যুবকের হাতে সহিংসতার রূপ নেয়।
VERY SAD EVENTS IN LEH
— Sonam Wangchuk (@Wangchuk66) September 24, 2025
My message of peaceful path failed today. I appeal to youth to please stop this nonsense. This only damages our cause.#LadakhAnshan pic.twitter.com/CzTNHoUkoC
রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান
লাদাখের এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
- ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি): লাদাখে বর্তমানে বিজেপি-ই ক্ষমতায় রয়েছে। ২০১৯ সালে লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার সিদ্ধান্ত বিজেপি সরকারেরই ছিল। সেই সময় বিজেপির স্থানীয় সাংসদ জামিয়াং সেরিং নামগিয়াল এই সিদ্ধান্তের পক্ষে জোরালো সমর্থন জানিয়েছিলেন। কিন্তু এখন এই আন্দোলন যখন সহিংসতার রূপ নিচ্ছে এবং বিক্ষোভকারীরা বিজেপির কার্যালয়ে আগুন দিচ্ছে, তখন দলটি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক লাদাখের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করার কথা ঘোষণা করেছে, যা থেকে বোঝা যায় যে বিজেপি আন্দোলনের তীব্রতা উপলব্ধি করছে এবং রাজনৈতিকভাবে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে।
- লাদাখের স্থানীয় রাজনৈতিক দলসমূহ: লেহ অ্যাপেক্স বডি (Leh Apex Body) এবং কার্গিল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সের (Kargil Democratic Alliance) মতো স্থানীয় রাজনৈতিক সংগঠনগুলি এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। তারা বিজেপির প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জন্য সরাসরি সরকারের সমালোচনা করছে এবং পূর্ণ রাজ্য ও ষষ্ঠ তফসিলের দাবি নিয়ে অনড় রয়েছে। এই দলগুলো মনে করে, কেন্দ্র তাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত কোনো সন্তোষজনক সমাধান দিতে পারেনি।
- অন্যান্য বিরোধী দল: জাতীয় স্তরে অন্যান্য বিরোধী দলগুলি এই ইস্যুটিকে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। তারা বিজেপিকে তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জন্য দায়ী করছে এবং লাদাখের জনগণের দাবির প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে। তারা অভিযোগ করছে যে বিজেপি সরকার প্রথমে প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরে সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসছে। এই দলগুলো লাদাখের জনগণের অধিকার রক্ষার পক্ষে সওয়াল করছে।
ওয়াংচুককেই দায়ী করেছে কেন্দ্র
লাদাখের অশান্ত পরিস্থিতির জন্য সোনম ওয়াংচুককেই দায়ী করেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। কেন্দ্রের অভিযোগ, তাঁর ‘উস্কানিমূলক’ মন্তব্যের জন্য অশান্ত লাদাখ।
লাদাখের অস্থিরতা কেবল একটি প্রশাসনিক সমস্যা নয়, এটি একটি গভীর রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটের প্রতিফলন। জনগণের দীর্ঘদিনের জমে থাকা হতাশা, তাদের সংস্কৃতি, ভূমি এবং কর্মসংস্থানের সুরক্ষার উদ্বেগ, এবং সরকারের প্রতিশ্রুতির অভাব এই অস্থিরতার মূল কারণ। যদি কেন্দ্র সরকার এই সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে এবং দ্রুত একটি সমাধান না দেয়, তবে লাদাখের পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে। একইসঙ্গে, রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এই ইস্যুটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে, যেখানে তাদের জনগণের প্রত্যাশা এবং প্রশাসনিক বাস্তবতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।
আরও পড়ুন: পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষযাত্রা জুবিন গার্গের, বিশ্বরেকর্ড গড়ল জনসমুদ্র