পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
সেই আদিম যুগ থেকে চিরাচরিতভাবেই মানুষের সমাজে তাঁরা – “সংসারে যারা শুধু দিলে, পেলে না কিছুই…” (শরৎচন্দ্র) – আমাদের তথাকথিত সভ্যসমাজ তাঁদের অন্যচোখে, অবজ্ঞা-ঘৃণার চোখে দেখে, যদিও তাঁদের বাসস্থানের পবিত্র মাটি মিশিয়ে নিতে হয় দেবীদুর্গার প্রতিমা তৈরির সময়ে কুমোরপাড়ায়। এ হেন বারাঙ্গনাদেরও অনেক অলিখিত অবদান রয়েছে আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে। তাঁরা নিজেদের ভাইয়ের মতো, সন্তানের মতো আপন করে নিয়েছিলেন সেই যুগের দেশমাতৃকার জন্যে নিবেদিত বিপ্লবীদের, কি শহরে, কি মফস্সলে, কি গ্রামেগঞ্জে।
অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার নন্দীগ্রাম, আসাদতলা, তেরপেখিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে সে যুগে ছিল বিপ্লবীদের আত্মগোপন করে থাকার গোপন ডেরা। এই অঞ্চলেরই আশেপাশে ছিল বারবনিতাদের আস্তানা। সেইখানে যাঁরা থাকতেন, তাঁরা সকলেই বিপ্লবীদের নিজেদের আপনজন মনে করতেন। এমনই একজন ছিলেন, নাম সত্যবতী।
মেদিনীপুরের কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামে মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিলেন সত্যবতী। অল্পবয়সে বিধবা হন। শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসেন বাপেরবাড়ি। সেখানেও সাংসারিক অশান্তি শুরু হয় মা-বাবা হারা মেয়েটিকে নিয়ে। মেয়েটির এই অসহায়তার সুযোগ নেয় এক মানুষরূপী শয়তান। অবশেষে মেয়েটির ঠাঁই হয় পতিতাদের মাঝে।
নাম পরিবর্তন হয়ে গিয়ে নাম হয় ‘সত্যবতী’। বিপ্লবীদের পরম প্রিয়, পরম শ্রদ্ধেয়া ‘সতীদিদি’।
এই সত্যবতী দেবীর কাছে আসতো অনেক পুলিশ অফিসার। তাদের কাছ থেকে সমস্ত খবরাখবর নিয়ে সতীদিদি সেই সব খবর বিপ্লবীদের দিয়ে দিতেন খুব গোপনে। ফলে বিপ্লবীরা আগেভাগে ব্রিটিশ পুলিশের গতিবিধি জানতে পারতেন। সেইমতো বিপ্লবীরাও তাঁদের গোপন ডেরা বদল করতে পারতেন। বিপ্লবীদের অস্ত্র কেনার জন্যে সতীদিদি তাঁর যৎসামান্য সোনার গয়না সব দিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর বিপ্লবী ভাইয়েদের।
বিপ্লবীদের আহ্বানে ধীরে ধীরে সত্যবতী দেবী গোপনে কাজ করার পাশাপাশি নন্দীগ্রাম আসাদতলায় আইন অমান্য আন্দোলনেও যোগ দিয়ে প্রকাশ্যে আসেন ১৯৩০ সালের শেষের দিকে। ১৯৩১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারী – তেরপেখিয়া বাজারে প্রকাশ্যে পিকেটিং করার জন্যে এবং বিপ্লবীদের সমাবেশে যুক্ত থাকার জন্যে পুলিশের লাঠির ঘা পড়ে সত্যবতীর মাথায়। রক্তাক্ত অবস্থায় জ্ঞান হারান তিনি। সেই অবস্থাতেই তাঁকে পুলিশের জেল হেফাজতে পাঠানো হয়। জেল হয় সত্যবতী দেবীর।
তিন মাস পরে সত্যবতী দেবী জেল থেকে ছাড়া পান ১৯৩১ সালের ১০ মে। জেল থেকে ফিরেই অসুস্থ শরীর নিয়েও আবার তিনি বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং দেশের স্বাধীনতার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
১৯৩১ সালের ১৯ আগস্ট নন্দীগ্রামে স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি গোপন সভায় সত্যবতী যোগ দেন। পুলিশ সেখান থেকে গ্রেফতার করে তাঁকে। তত দিনে ব্রিটিশ পুলিশ জানতে পেরে গিয়েছে যে, সমাজে বারবনিতা হিসাবে পরিচিতা হলেও আসলে সত্যবতী দেবী একজন বিপ্লবী নারী, যিনি পুলিশের কাছ থেকে সমস্ত খবর নিয়ে গোপনে দেশের বিপ্লবীদের দিয়ে দেন।
এইবার শুরু হয় সত্যবতী দেবীর ওপরে পুলিশের অমানবিক নির্যাতনের পালা। সেই অত্যাচারের কথা ভাষায় বলা যাবে না। বুকে, পেটে, তলপেটে, পিঠে ভারী বুটের লাথি, গরম লোহার রড দিয়ে মারা, বিবস্ত্র করে অকথ্য অত্যাচার চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। হিংস্র হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশ পুলিশের দল। যার ফলে সত্যবতী দেবীর শরীরের কিডনি, ইনটেস্টাইন ইত্যাদি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। শেষে স্থানীয় হাসপাতালে দেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই তিনি মারা যান।
আমাদের জন্মভূমির স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের পাতায় পাতায় যতই তন্নতন্ন করে খুঁজে যাওয়া হোক – না, পাওয়াই যাবে না এই সব সত্যবতী দেবীদের অবদানের কথা ও কাহিনি।
আগস্ট মাস আমাদের স্বাধীনতার মাস। সেই মাসে, সেই সব অলিখিত ইতিহাসের অজানা বিপ্লবীদের চরণ ছুঁয়ে যাই। “ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা।/ তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা…।।” (রবীন্দ্রনাথ)
তথ্যসূত্র:
জালালাবাদ থেকে কালারপোল – প্রকাশ রায়
উইকিপিডিয়া