Homeপ্রবন্ধপশ্চিমবঙ্গে ‘ডেমোগ্রাফিক শিফট’ নাকি রাজনৈতিক কৌশল? বিজেপি-তৃণমূল তরজার অন্তরালে ভোট, ভীতি ও...

পশ্চিমবঙ্গে ‘ডেমোগ্রাফিক শিফট’ নাকি রাজনৈতিক কৌশল? বিজেপি-তৃণমূল তরজার অন্তরালে ভোট, ভীতি ও বাস্তবতা

পশ্চিমবঙ্গে এক দশকে ভোটার বাড়ল ৪০ শতাংশের বেশি! বিজেপির দাবি— পরিকল্পিত ডেমোগ্রাফিক শিফট চলছে মমতা সরকারের প্রশ্রয়ে। পালটা তৃণমূলের যুক্তি— বিভাজনের রাজনীতি করছে বিজেপি। বিশ্লেষণে উঠে এল বাস্তবতা, ভয় ও ভোটের সমীকরণ।

প্রকাশিত

চিরঞ্জীব পাল

বর্তমান রাজনৈতিক বিতর্কে সবচেয়ে স্পর্শকাতর এবং কৌশলগত বিষয়গুলির মধ্যে একটি হল জনঘনত্বের পরিবর্তন— বিশেষ করে ভোটার সংখ্যা বাড়াকে ঘিরে উঠছে নানা প্রশ্ন। সম্প্রতি বিজেপি দাবি করেছে, পশ্চিমবঙ্গে ২০১১ থেকে ২০২১— এই এক দশকে ৪৬টি বিধানসভা কেন্দ্রে ভোটারের সংখ্যা বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। তাদের ভাষায়, এটি কোনও স্বাভাবিক ঘটনা নয়, বরং রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে পরিচালিত ‘ডেমোগ্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং’। পালটা তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপিকে দুষেছে বিভাজনের রাজনীতির চর্চা করার জন্য। এই বিতর্কের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, ঐতিহাসিক প্রভাব, বাস্তবতা এবং ভবিষ্যৎ আশঙ্কা নিয়ে বিশ্লেষণ করা যাক।

ভোটার বৃদ্ধি: পরিসংখ্যান না কি কৌশল?

বিজেপির দাবি অনুযায়ী, ৪৬টি আসনে ভোটার বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি, যার মধ্যে সাতটি আসনে বৃদ্ধি ৫০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। প্রশ্ন উঠছে— এই প্রবৃদ্ধি কি স্বাভাবিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফল, নাকি পরিকল্পিতভাবে ভোটার তালিকায় নতুন নাম জুড়ে দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থে?

সাধারণত, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ভারতীয় রাজ্যগুলিতে ১০ বছরে ১৫-২০ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। পশ্চিমবঙ্গে কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলে যদি ৪০-৫০ শতাংশ ভোটার বৃদ্ধি ঘটে, তবে সেটি নিঃসন্দেহে গবেষণার দাবি রাখে। তবে শুধুমাত্র সংখ্যা দিয়ে ‘ঘোষণা’ করলেই সেটি সত্য হয়ে যায় না, তার নিরপেক্ষ ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

‘ডেমোগ্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং’— শব্দটির রাজনীতি

এই শব্দগুচ্ছ শুধুই সংখ্যা নয়, এটি একটি ‘আবেগ’ তৈরি করে— বিশেষ করে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘সংখ্যালঘুদের দ্বারা অগ্রহণযোগ্য দখল’-এর আশঙ্কা। বিজেপির বক্তব্য, এই প্রবণতা বাংলাকে একটি ‘ইসলামিক স্টেট’-এ পরিণত করার প্রচেষ্টার অংশ, যার বিরুদ্ধে এক সময়ে লড়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ও গোপাল মুখোপাধ্যায় ওরফে গোপাল পাঁঠা।

এই রেফারেন্সগুলি আসলে রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার এক কৌশল— অতীতের ‘হিন্দু প্রতিরোধ’-এর আবেগকে জাগিয়ে বর্তমান ভোটের সমীকরণকে চাঙা করার চেষ্টা। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়— জনঘনত্বের স্বাভাবিকতা যাচাই না করে এমন দাবি কতটা গ্রহণযোগ্য?

‘চিকেনস নেক’ ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রসঙ্গ

বিজেপি আরও দাবি করেছে, বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তী সরকারে প্রধান উপদেষ্টা মুহম্মদ ইউনুস ‘চিকেনস নেক’ নিয়ে মন্তব্য করেছেন কারণ ওই অঞ্চলের জনঘনত্ব বদলে যাচ্ছে।
চিকেনস নেক হল ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিকে বাকি দেশের সঙ্গে যুক্ত করা এক সরু করিডর, যার কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম।
এই প্রসঙ্গ টেনে আনার পেছনে রয়েছে একটি ভয় তৈরি করা— “দেশের নিরাপত্তা বিপন্ন!” এই ভয় রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত কার্যকরী হলেও, বাস্তব ভিত্তি বিশ্লেষণাত্মক তথ্য ছাড়া দেওয়া কঠিন।

তৃণমূলের পালটা: বিভাজনের রাজনীতি বনাম কাজের রাজনীতি

তৃণমূল কংগ্রেস বরাবরই বিজেপিকে ‘ধর্মভিত্তিক মেরুকরণ’-এর রাজনীতির জন্য অভিযুক্ত করে এসেছে। কুণাল ঘোষের কথায়, বিজেপি আসলে ধর্ম ও ভাষার ভিত্তিতে বাংলাকে বিভক্ত করতে চাইছে। তৃণমূলের দাবি, বিজেপি নিজেই ‘বাইরের মানুষ’ এনে ভোটার তালিকায় ঢোকানোর চেষ্টা করেছে, এবং তার প্রতিবাদেই তারা নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছে।

তৃণমূলের বক্তব্য রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট কৌশলী— এতে তারা নিজেদের সংখ্যালঘু সমর্থন ধরে রাখছে এবং একই সঙ্গে বহিরাগত বনাম বাঙালি আবেগ জাগিয়ে তুলছে।

সমস্যার গভীরে: প্রশাসনিক অব্যবস্থা ও অভিবাসনের বাস্তবতা

বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ একটি বাস্তব সমস্যা, যা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিকে প্রভাবিত করেছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু এই সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা, সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর দায়িত্ব ও নির্বাচন কমিশনের উপর নির্ভরতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অপর দিকে, শ্রম ও জীবিকার খোঁজে এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে অভিবাসন ভারতের বাস্তবতা। এই বাস্তবতা ধর্ম বা ভাষার ভিত্তিতে বিচার না করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলে সামাজিক সৌভ্রাতৃত্ব বিনষ্ট হতে পারে।

ভয় না কি ফ্যাক্ট?

পশ্চিমবঙ্গে ভোটার বৃদ্ধি সংক্রান্ত বিতর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। বিজেপি যেখানে এটিকে ‘সভ্যতা রক্ষার যুদ্ধ’ বলে চিহ্নিত করছে, তৃণমূল বলছে— এটা নিছক বিভাজনের রাজনীতি।

কিন্তু এই বিবাদের মাঝখানে হারিয়ে যাচ্ছে একটি বড় প্রশ্ন— প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন এবং নাগরিক সমাজ কি এই পরিবর্তনের নিরপেক্ষ, তথ্যনিষ্ঠ মূল্যায়ন করতে প্রস্তুত?

এটাই সময়— ভয় নয়, তথ্যের উপর ভিত্তি করে আলোচনা হোক। রাজ্য ও দেশের জনতন্ত্র রক্ষা হোক বিশ্লেষণের মাধ্যমে, বিভেদের মাধ্যমে নয়।

আপনার প্রশ্ন, আমাদের উত্তর

সাম্প্রতিকতম

এশিয়া কাপ: অভিষেক-শুভমনের দুর্দান্ত ব্যাটিং, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আবার জয় পেল ভারত

পাকিস্তান: ১৭১-৫ (সাহিবজাদা ফারহান ৫৮, সইম আয়ুব ২১, শিবম দুবে ২-৩৩) ভারত: ১৭৪-৪ (অভিষেক শর্মা...

৮৩তম বছরে হাজরা পার্ক দুর্গোৎসবের নিবেদন ‘দৃষ্টিকোণ’

৮৩তম বছরে হাজরা পার্ক দুর্গোৎসবের থিম ‘দৃষ্টিকোণ’। শিল্পী বিমান সাহার সৃজনে রঙের বহুমাত্রিকতা ও দেবীর রঙিন রূপে সাজবে কলকাতার ঐতিহ্যবাহী এই পুজো।

থিম ভাবনা ‘চা-পান উতোর’, আশ্চর্য পানীয় চা-কে ঘিরে আবেগের কথা উঠে আসবে আলিপুর সর্বজনীনের মণ্ডপে

আলিপুর সর্বজনীন দুর্গোৎসবের ৮০তম বছরে থিম ‘চা-পান উতোর’। শিল্পী অনির্বাণ দাসের সৃজনে মণ্ডপে ফুটে উঠবে দার্জিলিং-অসমের চা-বাগান, শ্রমিক জীবনের কাহিনি ও বিশ্বজোড়া চায়ের ইতিহাস।

জিএসটি সংস্কারকে ‘সাশ্রয়ের উৎসব’ বললেন মোদী, নবরাত্রির প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশে ভাষণ

নবরাত্রির প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। জিএসটি সংস্কারকে ‘বচত উৎসব’ আখ্যা দিয়ে বললেন, এই পদক্ষেপ দেশকে আত্মনির্ভর ভারতের পথে আরও এগিয়ে নেবে।

আরও পড়ুন

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: ভুলে গিয়েছি অগ্নিস্নাত বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষকে  

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায় মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেননি। বিধানচন্দ্র রায়কে আশীর্বাদও করেননি। বল্লভভাই পটেলের...

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: ‘এবার তবে আসি মা!’

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায় একটা সুবৃহৎ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস এত পক্ষপাতিত্ব করে লেখা হয়েছে, যার উদাহরণ...

স্বাধীনতা আন্দোলনের অলিখিত ইতিহাস: জালিয়ানওয়ালাবাগ ও উধম সিং

সে দিন ব্রিটিশ শাসক অসংখ্য নিরপরাধ ভারতীয় নরনারীকে বুলেটের বন্যায় ধরাশায়ী করেই ক্ষান্ত হয়নি, শহরের গণ্যমান্য নাগরিকদের ঘর থেকে বাইরে টেনে টেনে এনে রাস্তায় হামাগুড়ি দিতে বাধ্য করেছিল। প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে ভারতীয়দের নাকে খত দিতে বাধ্য করেছিল ব্রিটিশ শাসক সে দিন।