তবলার জাদুকর আর নেই। রবিবার সান ফ্রান্সিসকোর হাসপাতালে প্রয়াত হলেন কিংবদন্তি তবলাবাদক, সঙ্গীতজ্ঞ এবং অভিনেতা উস্তাদ জাকির হুসেন। তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে এ খবর জানানো হয়েছে।
জাকির হুসেনের পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে রক্তচাপজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। সম্প্রতি হৃদ্যন্ত্রের গুরুতর সমস্যা দেখা দেওয়ায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়তেই দেশে-বিদেশে থাকা অনুরাগীরা প্রার্থনায় মনোনিবেশ করেছিলেন। কিন্তু সেই প্রার্থনা আর কার্যকর হল না। তবলাবাদক, যাঁর আঙুলের ছোঁয়ায় তবলা কথা বলত, তিনি চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেলেন।
উস্তাদ জাকির হুসেনের মৃত্যুতে সঙ্গীত জগতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাঁর অবদান অনন্তকাল ধরে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হবে।
তবলার প্রতিটি চরণ যেন তাঁর আঙুলের স্পর্শে নতুন ভাষা খুঁজে পেত। বিশ্বসঙ্গীতের মানচিত্রে ভারতকে প্রতিষ্ঠিত করার অন্যতম কারিগর ছিলেন উস্তাদ জাকির হুসেন। সঙ্গীত শুধু তাঁর পেশা নয়, জীবনের ছন্দ। তবলার প্রতিটি বোল তাঁর আত্মার একেকটি কাব্যিক অভিব্যক্তি।
১৯৫১ সালের ৯ মার্চ মুম্বইয়ের এক সংগীতপ্রেমী পরিবারে জন্ম জাকিরের। তাঁর বাবা, তবলা কিংবদন্তি উস্তাদ আল্লা রাখা, ছিলেন তাঁর প্রথম গুরু। মাত্র তিন বছর বয়সে তবলার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব শুরু হয়। ছোট্ট জাকিরের হাতে তবলার প্রথম স্পর্শেই যেন বোঝা গিয়েছিল, এই ছেলেটি একদিন ইতিহাস তৈরি করবে।
সাত বছর বয়সে প্রথম একক মঞ্চে পরিবেশনা করেছিলেন তিনি। সেই সময়কার এক দর্শক বলেছিলেন, “ছোট্ট একটি ছেলে মঞ্চে এসে এমন তবলা বাজাচ্ছে, মনে হচ্ছে একদল পেশাদার বাজিয়ে একসঙ্গে মঞ্চে রয়েছেন।” সেদিন থেকেই তাঁর যাত্রা শুরু।
জাকির হুসেন শুধু তবলার গণ্ডিতে নিজেকে আটকে রাখেননি। ভারতীয় ক্লাসিক্যাল মিউজ়িককে বিশ্বমঞ্চে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনি কাজ করেছেন বিখ্যাত সব শিল্পীর সঙ্গে। জন ম্যাকলকলিন, রবিশঙ্কর, আলি আকবর খানের মতো সঙ্গীতজ্ঞদের সঙ্গে জাকিরের জুটি হয়ে উঠেছিল চিরস্মরণীয়।
একবার আমেরিকার একটি মঞ্চে জাকির যখন তবলা বাজাচ্ছিলেন, তখন এক বিদেশি দর্শক উঠে এসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আপনার তবলা কি কথা বলে?” সেই প্রশ্নের উত্তরে জাকির মৃদু হাসি দিয়ে বলেছিলেন, “তবলার ভাষা বোঝার জন্য আপনাকে কেবল মন খুলে শুনতে হবে।”
বিশ্বের বহু মঞ্চ তাঁর তবলার যাদুতে মুগ্ধ হয়েছে। তবলার বোলের পাশাপাশি তাঁর হাসিমাখা মুখ, মৃদু রসবোধ, আর সঙ্গীত নিয়ে অগাধ জ্ঞান তাঁকে সকলের প্রিয় করে তুলেছিল।
২০১৯ সালে কলকাতার এক মঞ্চে জাকির বলেছিলেন, “তবলা বাজানো শুধু একটি শিল্প নয়, এটি আমার জীবন। আমি তবলাকে ভালোবাসি, কারণ এটি আমার আত্মার কণ্ঠস্বর।” সেই ভালোবাসাই তাঁকে নিয়ে গিয়েছে বিশ্বসঙ্গীতের উচ্চতর শিখরে।
তাঁর অসংখ্য পুরস্কারের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে ভারতের পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ। তবলার জাদুতে তিনি ভারতীয় সঙ্গীতকে পৌঁছে দিয়েছেন গ্র্যামি পুরস্কারের মঞ্চে। তাঁর হাত ধরেই ‘শক্তি’ ব্যান্ডের অ্যালবাম ‘দিস মোমেন্ট’ ২০২৪ সালে গ্র্যামি জেতে।
জাকির হুসেনের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা শুধুমাত্র তাঁর সঙ্গীত প্রতিভার জন্য নয়, তাঁর মানবিকতার জন্যও। তিনি সবসময় বিশ্বাস করতেন, সঙ্গীত সীমানা ভাঙে, মানুষকে একত্র করে। তাঁর বাজানো তবলার প্রতিটি বোল আমাদের সেই কথাই মনে করিয়ে দেয়।
উস্তাদ জাকির হুসেনের যাদুকরী সঙ্গীতের ধ্বনি থেকে আমরা শিখি, কেবল প্রতিভা নয়, ভালোবাসা, নিষ্ঠা, এবং নিজের কাজে আত্মার মিশেলই একজন মানুষকে কিংবদন্তি করে তোলে।
#UstadZakirHussain RIP maverick tabla artist extraordinaire #UstadZakirHussain ,Grammy Award winner pic.twitter.com/z8IIOsqPLx
— Krishna Pachegonker (@skrishhatote) December 15, 2024