কলকাতা: খুন, ধর্ষণ, গণপিটুনি, রাজনৈতিক হানাহানি, জাতপাত-ধর্ম নিয়ে সংঘাত, পরিবেশ দূষণ, পৃথিবী ক্রমশ জলশূন্য হয়ে যাওয়া, নিজেদের ধ্বংস ত্বরান্বিত করা – চারিদিকে মন খারাপ করা খবর। এরই মাঝে ভালো খবরও তো অনেক থাকে। কিন্তু সেই সব খবর খারাপ খবরের ভিড়ে হারিয়ে যায়। আর এই ভালো খবর যাঁরা সৃষ্টি করেন, তাঁরা বিচরণ করেন প্রচারের আড়ালে।
তবে ‘স্পর্শ’ তো রয়েছে। যাঁরা ভালো খবর সৃষ্টির কারণ হয়েও পাদপ্রদীপের আলো থেকে দূরে থাকেন, বা দূরে থাকতে পছন্দ করেন, তাঁদের খুঁজে আনে ‘স্পর্শ’। আর শুধু খুঁজেই আনে না, তাঁদের সম্মানিত করে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে।
প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক তাপস কুমার দে-র কথায়, “যাঁরা মানুষের জন্য একান্তে কাজ করে চলেছেন, তাঁদের সামনে নিয়ে আসে তাঁদের সংগঠন। এই সেবাব্রতী মানুষদের সম্মানিত করে ‘স্পর্শ’ এটাই বোঝাতে চায় যে সমাজের বহু মানুষ তাঁদের পাশে আছেন।”
দশ বছর ধরে এই কাজ করে চলেছে মধ্য কলকাতার সংগঠন ‘স্পর্শ’। সাধারণ মানুষের পাশে থেকে সমাজের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খুঁজে আনে এক গুচ্ছ লড়াকু, ব্যতিক্রমী মানুষ আর সংগঠনকে। প্রতি বছরই তাদের সম্মানিত করে ‘স্পর্শ’। আর সেই উদ্দেশ্যেই আয়োজন করা হয় বর্ষপূর্তির হর্ষ অনুষ্ঠান। অতি সম্প্রতি সুবর্ণবণিক সমাজ হলে অনুষ্ঠিত হল ‘স্পর্শ’-এর দশম বর্ষপূর্তির হর্ষ অনুষ্ঠান।
বিশেষ অতিথি হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়কে সংবর্ধনা জানাচ্ছেন তাপস কুমার দে।
ওই দিনের অনুষ্ঠানে যে সব সংগঠনকে সম্মানিত করা হল তাদের মধ্যে ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগণার তালদির সংগঠন ‘অঙ্গীকার’। এই সংগঠন রক্তযোদ্ধা হিসাবে কাজ করে। সংগঠনের সদস্যরা সারা বছর সাধারণ মানুষের রক্ত দিয়ে প্রাণ বাঁচান। সম্মানিত করা হল সাউথ ক্যালকাটা ট্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনকে।
এ ছাড়াও সম্মানিত করা হল ‘ফ্ল্যাগম্যান’ প্রিয়রঞ্জন সরকার, সুন্দরবনের ‘অক্সিজেন ম্যান’ সৌমিত্র মণ্ডল, মেদিনীপুরের ‘বট বাবা’ শ্যামল জানা, উত্তর ২৪ পরগণার ‘মাস্টারমশাই’ অলোককুমার দালাল এবং ঝাড়গ্রামের ‘ছোটুদা’ স্নেহাশিস দুর্লভকে।
‘অঙ্গীকার’কে সম্মাননা প্রদান।
সুন্দরবনের ‘অক্সিজেন ম্যান’ সৌমিত্র মণ্ডল সারা বছর প্রাণপাত করে রোগীদের জন্য অক্সিজেন জোগাড় করে দেন। কাঁথির ‘বটবাবা’ শ্যামল জানার ধ্যানজ্ঞান বটগাছ লাগানো। পরিবেশসচেতন শ্যামলবাবু এখনও পর্যন্ত অসংখ্যা জায়গায় প্রচুর বটগাছ লাগিয়েছেন এবং লাগিয়ে চলেছেন। এ দিন ‘স্পর্শ’-এর অনুষ্ঠানেও অতিথিদের হাতে বটচারা তুলে দেন তিনি। ‘মাস্টারমশাই’ অলোককুমার দালালের বয়স ৮২ বছর। এই বয়সেও তিনি ছোলা-বাদাম বিক্রি করার ফাঁকে ছোটোদের হাতে তুলে দেন ইংরেজি শেখার বই। ‘ছোটুদা’ স্নেহাশিস দুর্লভ বিনা পারিশ্রমকে অসংখ্য শিশুকে শিক্ষাদান করেন।
তবে এই সব সমাজ-যোদ্ধাদের সম্মানিত করেই ক্ষান্ত থাকে না ‘স্পর্শ’, তারা নিজেরাও নিয়ত সমাজসেবায় মেতে থাকে। ‘স্পর্শ’ নানা ভাবে নিয়মিত সাহায্য করে চলেছে রামকৃষ্ণ অনাথ ভাণ্ডারকে। এ বারও তার অন্যথা হল না। অনাথ ভাণ্ডার-এর শিশু-কিশোরকিশোরীদের জন্য পূজার পোশাক কিনে দিয়েছে ‘স্পর্শ’। এ দিনের সেই সব পোশাক তাদের হাতে তুলে দেন বিশিষ্ট অতিথিরা। দুর্গাপূজার প্রাক্কালে আর্থিক ভাবে দুর্বল মহিলাদের হাতে ‘স্পর্শ’-এর তরফে তুলে দেওয়া হল শাড়ি। ঝাড়গ্রামের অনাথ মেয়েদের জন্য পোশাক কিনে দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ালেন সুমা চট্টোপাধ্যায়।
দুর্গাপূজার প্রাক্কালে আর্থিক ভাবে দুর্বল মহিলাদের হাতে ‘স্পর্শ’-এর তরফে তুলে দেওয়া হল শাড়ি।
দেবপ্রিয়া গুহর কণ্ঠে উদ্বোধনী স্তোত্র ও বিশিষ্ট অতিথিদের হাতে প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। সমস্ত অতিথিকে বরণ করেন ‘স্পর্শ’-এর সাধারণ সম্পাদক তাপস কুমার দে, যাঁকে ছাড়া ‘স্পর্শ’ অসম্পূর্ণ। ‘স্পর্শ’-এর কাজকর্ম সম্পর্কে উপস্থিত জনমণ্ডলীকে অবহিত করেন সংগঠনের সভাপতি সুজিত চক্রবর্তী এবং মুখ্য উপদেষ্টা শান্তনু চট্টোপাধ্যায়।
ওই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ‘এই সময়’ পত্রিকার সম্পাদক হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য বিশিষ্ট অতিথিদের মধ্যে ছিলেন বেলুড় মঠের স্বামী বেদব্রতানন্দ, কলকাতা পুলিশের ডিসি বুদ্ধদেব মুখোপাধ্যায়, বউবাজার থানার অফিসার ইনচার্জ দেবজিৎ ভট্টাচার্য, একবালপুর থানার অফিসার ইনচার্জ সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী, ওয়াটগঞ্জ থানার অ্যাডিশনাল অফিসার ইনচার্জ অমিত ঠাকুর, কসবা থানার অ্যাডিশনাল অফিসার ইনচার্জ সুভাষ মণ্ডল, ‘ভীম চন্দ্র নাগ’-এর অন্যতম কর্ণধার ভরত নাগ, ওই সংস্থারই প্রয়াত কর্ণধার প্রতাপ নাগের কন্যা ময়ুখী বোস, ডালহৌসি অ্যাথলেটিক ক্লাবের স্পোর্টস সেক্রেটারি সিদ্ধার্থ রায়, গড়িয়াহাট থানার অ্যাডিশনাল অফিসার ইনচার্জ অরিজিৎ গাঙ্গুলি, সাংবাদিক শম্ভু সেন প্রমুখ। এ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ‘স্পর্শ’-এর প্রধান উপদেষ্টা সন্দীপ সিনহা, প্রধান পৃষ্ঠপোষক ড. শুভাশিস গুহ ও রাজেশ চন্দ্র, উপদেষ্টা রাজকুমার মোদী, রোহিত শুক্লা ও রবীন্দ্রনাথ মল্লিক, কার্যনির্বাহী সভাপতি রঞ্জন সিনহা প্রমুখ।
কলকাতা পুলিশের ডিসি বুদ্ধদেব মুখোপাধ্যায়কে সংবর্ধনা জানালেন ‘স্পর্শ’-এর সভাপতি সুজিত চক্রবর্তী।
প্রত্যেক অতিথিকে উত্তরীয় পরিয়ে এবং স্মারক ও চারাগাছ দিয়ে সংবর্ধনা জানানো হয়। অতিথিরা তাঁদের ভাষণে ‘স্পর্শ’-এর দীর্ঘায়ু কামনা করেন। সমগ্র অনুষ্ঠানটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করেন সাম্য কার্ফা।