ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা আলি খোমেইনি সম্প্রতি ইরানের সামরিক বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ইজরায়েলের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার মাঝে এই নির্দেশ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে মধ্যপ্রাচ্যে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে। খোমেইনি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, ইরান যেন প্রস্তুত থাকে এবং ইজরায়েলের আক্রমণের মাত্রা অনুযায়ী জবাব দেওয়ার জন্য বিশেষ কৌশল গঠন করে।
ইরানের পাল্টা পদক্ষেপের প্রস্তুতি
ইরানের সরকারি বিবৃতি অনুযায়ী, ইজরায়েল যদি ইরানের তেল ও জ্বালানি পরিকাঠামো, পারমাণবিক কেন্দ্রগুলি বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিশানা করে হামলা চালায়, তবে ইরান তার পাল্টা জবাব দিতে ব্যাপক আক্রমণ করবে। তবে ইজরায়েল যদি সীমিত কিছু সামরিক ঘাঁটি বা ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন সংরক্ষণাগারগুলিতেই আক্রমণ সীমাবদ্ধ রাখে, তাতে ইরান হয়তো সম্পূর্ণরূপে প্রতিক্রিয়ার পথ অবলম্বন নাও করতে পারে।
চারজন ইরানি কর্মকর্তার মন্তব্য উদ্ধৃত করে নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, ইরানের সামরিক বাহিনীকে সম্ভাব্য ইজরায়েলি আক্রমণ প্রতিরোধের পরিকল্পনা তৈরি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (IRGC) দুই কর্মকর্তাও এই বিষয়ে নিশ্চিত করেছেন যে, ইজরায়েল যদি ইরানের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যগুলিতে বড় ধরনের ক্ষতি সাধন করে, তবে ইরান আগ্রাসী প্রতিক্রিয়ার পথে যেতে পারে।
যুদ্ধের সম্ভাবনা, কিন্তু সংঘাত এড়ানোর প্রয়াস
এটা ঠিক ইরান তার সামরিক বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলেছে, কিন্তু তারা সংঘাত এড়ানোর চেষ্টাও করছে। লেবানন এবং গাজার মতো মিত্র দেশগুলিতে চলমান সংঘাতের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে ইরান আরও একটি বড় সংঘাতে না যাওয়ার জন্য সচেষ্ট। ইরান মনে করে, যুদ্ধ শুরু হলে শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্য নয়, বরং পুরো বিশ্বেই তার প্রভাব পড়বে।
ইজরায়েলের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে ইরানের তেল পরিকাঠামো এবং পারমাণবিক কেন্দ্র লক্ষ্য করে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ধরনের হামলার বিরোধিতা করেছে। কারণ এতে সংঘাতের পরিসর বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং ইরান পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে ইজরায়েল বা পশ্চিমঘেঁষা অন্যান্য দেশগুলির বেসামরিক পরিকাঠামোতে আঘাত করতে পারে।
ইরানীয় প্রতিরক্ষা প্রধানের মন্তব্য
ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের প্রধান হোসেইন সালামি সম্প্রতি ইজরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে মন্তব্য করেছেন। রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থা তাস (TASS)-কে দেওয়া এক বিবৃতিতে সালামি বলেন, ‘‘যেভাবে আরো অ্যান্টি-মিসাইল সিস্টেম ও ‘অপারেশন ট্রু প্রমিস ২’ সফল হয়নি, তেমনই টিএইচএএড সিস্টেমও ভবিষ্যতে ইরানের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারবে না।’’ তাঁর মতে, এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নির্দিষ্ট কিছু সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ, যা ইরানকে আক্রমণ প্রতিরোধে বাধা দিতে ব্যর্থ হতে পারে।
ইজরায়েল-ইরান উত্তেজনার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব
ইরান ও ইজরায়েলের মধ্যে ক্রমাগত বাড়তে থাকা উত্তেজনা শুধু এই দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এতে সারা বিশ্বেই উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সংঘাত হলে তেল ও গ্যাসের বাজারে এর প্রভাব পড়বে।
ইরান তাদের সামরিক বাহিনীকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বললেও, কূটনৈতিকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে। ইরান মনে করছে, একটি স্থায়ী সংঘাত শুধুমাত্র ইজরায়েল ও ইরানের জন্যই ধ্বংসাত্মক হবে না, বরং পুরো অঞ্চলকেই অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
সামরিক শক্তির প্রদর্শন
সাম্প্রতিক সময়ে ইরান ও ইজরায়েল একে অপরকে সামরিক শক্তি প্রদর্শন করছে। ইরান তাদের ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির উন্নতি করেছে এবং ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে, ইজরায়েলও তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও উন্নত করেছে এবং মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
ইরানের এই যুদ্ধের প্রস্তুতির নির্দেশ মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার উপর নতুন করে একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ইরান ও ইজরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্বিগ্ন করেছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যা ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত রাখার জন্য বিভিন্ন সময়ে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে এই দুই দেশের মধ্যে সংঘাত এড়াতে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বাড়ানো দরকার।