শৌভিক পাল
ইতিহাস যেখানে কথা বলে…।
এমনই ভাবধারাকে সঙ্গে নিয়ে অষ্টাদশ বর্ষে পা রাখল সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার পরিষদ আয়োজিত আন্তর্জাতিক ইতিহাস উৎসব। বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্ট মানুষের উপস্থিতিতে প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে চার দিনব্যাপী এই ইতিহাস উৎসবের সূচনা হয়ে গেল ১১ ফেব্রুয়ারি, রবিবার।
সাবর্ণ সংগ্রহশালায় (বড়োবাড়ি, বড়িশা) আয়োজিত এই ইতিহাস উৎসবের এ বারের থিম কান্ট্রি হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে ইতালিকে। উৎসবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে নিউ আলিপুর কলেজ। ইতিহাসের টানে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তী, নিউ আলিপুর কলেজের অধ্যক্ষ জয়দীপ ষড়ঙ্গী, সংগীতশিল্পী সোমলতা আচার্য চৌধুরী, অভিনেতা নীলাদ্রি লাহিড়ী, রাজা সেন, ইতালির কনসুলেট জেনারেল রিকারো ডালা কোস্টা-সহ আরও অনেকেই।
‘ফিস ফিস কথা কয় ইতিহাস’
নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তী নিজের বক্তব্যে ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমানের মেলবন্ধনকে আরও দৃঢ় করার জন্য সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার পরিষদের সম্পাদক দেবর্ষি রায়চৌধুরীকে উদ্দেশ করে বলেন, তাঁর এই প্রচেষ্টা পুরোনো দিকগুলি নতুন করে উন্মোচন করছে। পরিবারের সমস্ত সদস্য এই উদ্যোগে নিজের নিজের মতো করে ভূমিকা রেখেছে। এই উদ্যোগ এগিয়ে যাক অনেক দূর।
প্রদর্শনীর একাংশ।
বিভাসবাবু আরও বলেন, ইতালির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অনেকটা গভীর। ইতালির নাট্যকার লিউইজি পিরানদেল্লোর ‘সিক্স ক্যারেক্টার্স ইন সার্চ অফ অ্যান অথর’ থেকে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত অনুবাদ করে লেখেন ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’। পরিচালনা করেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। পরবর্তীকালে ইতালির নোবেলজয়ী নাট্যকার দারিও ফো-র নাটক নিয়ে চর্চা হয় এবং তাঁর নাটক ‘মৃত্যু না হত্যা’, ‘হচ্ছেটা কী’ নাটকগুলি মঞ্চস্থ হয় এই বাংলায়।
সঞ্চালক দেবর্ষি রায়চৌধুরীর সুমধুর ভাষণকে সম্মান জানিয়ে ইতালির কনসুলেট জেনারেল রিকারো ডালা কোস্টা বলেন, শিক্ষা পারস্পরিক সম্পর্ককে আরও দৃঢ় ও মজবুত করে। এ দিনের অনুষ্ঠানে তাঁর বার্তা, ইতিহাস চর্চা নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করবে।
ইতিহাস উৎসবের সূচনার পাশাপাশি পরিবারের ঐতিহ্যবাহী হাতে লেখা পত্রিকা ‘সপ্তর্ষি’র চৌত্রিংশতিতম সংখ্যা প্রকাশিত হয়।
প্রদর্শনীর একাংশ। ১৯৫৩-এর ট্রামভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে অশান্ত কলকাতার ইতিহাস।
ইতিহাস উৎসবে প্রদর্শনী
বিশিষ্ট অতিথিদের বক্তৃতা পর্ব শেষ হওয়ার পরেই প্রদর্শনী কক্ষ ঘুরে দেখেন সকলে। কক্ষটি আকারে সুবিশাল না হলেও প্রাচীন ইতিহাসের আয়না হয়ে উঠেছে। এই সংগ্রহশালা যে ইতিহাসের সাক্ষ্যবহনে যথেষ্ট সফল, সে কথাই শোনা গেল সংগীতশিল্পী সোমলতা আচার্যের মন্তব্যে। তিনি বলেন, এই সাবর্ণ পরিবারে আজকের একটা সুন্দর মুহূর্তে হয়তো বিশাল সংখ্যক মানুষের ভিড়় নেই, কিন্তু যাঁরা ইতিহাসের গুরুত্ব বোঝেন, তাঁরা অবশ্যই রয়েছেন, এটাই পরম প্রাপ্তি।
ইতিহাস উৎসবে ঠাঁই পেয়েছে প্রায় তিন হাজার বছর আগের মৃৎপাত্র থেকে শুরু করে স্বাধীনতার আগে কলকাতার ঐতিহ্য, ট্রামের টিকিট ও দুষ্প্রাপ্য ছবি। এ ছাড়াও আদিম মানুষের ব্যবহৃত পাথর ও ধাতুর বিভিন্ন পাত্রও বেশ আকর্ষণীয়।
বিশ্বের ২৮টি দেশ থেকে সংগৃহীত রাম ও রামায়ণ সংক্রান্ত ডাকটিকিট স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে। এ ছাড়াও রয়েছে চলচ্চিত্র পরিচালক তপন সিংহের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে তাঁর চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত সামগ্রী থেকে শুরু করে ছবি সম্পর্কিত দুষ্প্রাপ্য পোস্টার ও তথ্য।
প্রদর্শনীর একাংশ। কান্যকুব্জ থেকে আসা ব্রাহ্মণ ও তাঁদের কায়স্থ সহকারীদের তালিকা।
বাগদেবীর নানা রূপে ডোকরা থেকে শুরু করে পট রয়েছে এই উৎসবের প্রদর্শনীতে। ইতিহাস নিয়ে বর্তমান প্রজন্মের আগ্রহ ঠিক কতটা, এমন প্রশ্নের জবাবে নিউ আলিপুর কলেজের অধ্যক্ষ জয়দীপ ষড়ঙ্গী জানান, আমরা বেশ কয়েক বছর ধরে কলকাতার ইতিহাস নিয়ে কাজ করছি। গবেষণাধর্মী ভবানীপুরের ইতিহাস নিয়ে আমাদের বেশ কয়েকটি পাঠ্যপুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। তিনি আরও জানান, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা সমগ্র কলকাতার ইতিহাস নিয়ে একটা বই প্রকাশ করার চেষ্টা করছি, যা কলকাতার ইতিহাসপ্রেমী মানুষের কাছে আরও অনেকটা মনোগ্রাহী হবে বলে আশা করা যায়। বইটি ট্রাভেল গাইড হিসাবেও কাজ করবে বলে আশা করছেন কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরাও।
এ দিনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রায় শেষ পর্বে এসে উপস্থিত হন অভিনেতা সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, সাবর্ণ পরিবারের সঙ্গে তাঁর নাড়ির টান। অনুষ্ঠানের উপরি পাওনা সোমলতার কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত।
নতুন করে বলার নয়, ইতিহাস থেমে থাকে না। ইচ্ছে হলে আপনিও এক বার ঢুঁ মারতেই পারেন সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার পরিষদ আয়োজিত আন্তর্জাতিক ইতিহাস উৎসবে। চলবে সরস্বতী পুজোর দিন (১৪ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত। সময় সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা।
আরও পড়ুন
রবীন্দ্রসংগীত প্রতিযোগিতা ‘গানের ভিতর দিয়ে’-র তৃতীয় বর্ষের সূচনা
চিত্রসাংবাদিকদের উদ্যোগে কলকাতায় চতুর্থ বর্ষ সরস্বতী পুজো ও চিত্রপ্রদর্শনী