নিজস্ব প্রতিনিধি: মন্ত্রণাসভা থেকে পালিয়ে এসেছেন রাজা। এসেছেন কবির কাছে। কেন? মন্ত্রণাসভায় বসলেই সচিবরা নিজের নিজের বিভাগের জন্য টাকা দাবি করে। তাই পালানো ছাড়া গতি নেই। তা বলে শেষ পর্যন্ত কবির দলে? রাজার ইতস্তত ভাব দেখে কবি জানিয়ে দিলেন, এ দলে তিনি একজন সঙ্গী পাবেন। যে সে সঙ্গী নন, রাজসঙ্গী। ঋতুরাজ বসন্ত। তিনি রাজার মতোই পলাতক, তবে চিরপলাতক। পৃথিবী তাঁকে ভূপতি করতে চেয়েছিল, কিন্তু তিনি…। তিনি কি রাজকোষের অবস্থা দেখে পালাতে চান? না, তিনি পৃথিবীর রাজকোষ পূর্ণ করে দিয়ে পালান। দুঃখে নয়, আনন্দে পালান।
কবি জানিয়ে দিলেন, আজ বসন্ত-উৎসবে সেই পলাতকার পালা পরিবেশিত হতে চলেছে। কিন্তু পালা শুরু হবে কী দিয়ে? ঋতুরাজের আগমনের মধ্য দিয়ে। তার প্রস্তুতি হিসাবে আকাশে একটা ডাক পড়েছে। সেই ডাক বলছে, নিজেকে পূর্ণ করে সব দিয়ে ফেলতে হবে। যে-দেওয়া সত্যি, সে দেওয়াতে ভরতি করে। বসন্ত-উৎসবে দানের দ্বারাই ধরণী ধনী হয়ে ওঠে। শুরু হল পালা, ঋতুরাজের পরিচরদের গানের মাধ্যমে – ‘সব দিবি কে, সব দিবি আয়।/আয় আয় আয়’।
দুই শিশুশিল্পী উৎসা গুপ্ত ও নীলাভ্নি চক্রবর্তীর ‘সব দিবি কে’ গানের মধ্য দিয়ে সে দিন রবি ঠাকুরের গীতিনাট্য ‘বসন্ত’ পরিবেশনের শুভ সূচনা হল। কলাভৃৎ-এর অনুষ্ঠানকক্ষে ইন্দিরা শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজন করেছিল ‘বসন্ত’ পরিবেশনা। ‘ইন্দিরা’র অনুষ্ঠানের আর-একটি বিশেষত্ব হল ‘সময়’কে মূল্য দেওয়া। কাঁটায় কাঁটায় ছ’টায় শুরু হল অনুষ্ঠান শ্রীনন্দা মুখোপাধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে।
গীতিনাট্য পরিবেশন এগিয়ে চলল। একে একে এল ‘বনভূমি’, ‘আম্রকুঞ্জ’। বনভূমি জানিয়ে দেয় – ‘বাকি আমি রাখব না কিছুই’। আম্রকুঞ্জ বলে ওঠে – ‘ফল ফলাবার আশা আমি মনে রাখি নি রে’। রাজা বুঝলেন ‘আম্রকুঞ্জ’ মুকুল ঝরাতে ভরসা পায় বলেই তার ফল ধরে। উঠল দখিনহাওয়া। তাতে ‘বেণুবন’ উতলা – তার আকুল আহ্বান ‘দখিনহাওয়া জাগো জাগো’। ঘরের কোণের ‘দীপশিখা’ শঙ্কিত কণ্ঠে বলে, ‘ধীরে ধীরে ধীরে বও/ওগো উতল হাওয়া’। ‘বেণুবন’ আর ‘দীপশিখা’র মনের কথার আদান-প্রদানের মাঝে আসে ‘মাধবী’ – ‘সে কি ভাবে গোপন রবে’। শালবীথিকায় ‘ভাঙল হাসির বাঁধ’। ‘ও আমার চাঁদের আলো’ গেয়ে ‘বকুল’ বরণ করে নিল পূর্ণচন্দ্রকে।
রাজা সব বুঝছেন। চাঁদ আকাশ থেকে পৃথিবীর হৃদয়ে দোলা লাগাল। কিন্তু চাঁদকে দোলা দেওয়া যায় না? নদী তো আছে। সে গেয়ে উঠল – ‘ও চাঁদ তোমায় দোলা, দেবে কে’। এ বার এল ‘দখিনহাওয়া’, গেয়ে উঠল ‘শুকনো পাতা কে যে ছড়ায় ওই দূরে’।
রাজা ঋতুরাজকে খুঁজছেন। ঋতুরাজের গায়ের কাপড়খানা তো দু’ পিঠে দু’ রকম – এক পিঠে শুকনো পাতা, ঝরা ফুল, অন্য পিঠে সকালবেলার মল্লিকা, সন্ধ্যাবেলার মালতী, ফাল্গুনের আম্রমঞ্জরী, চৈত্রের কনকচাঁপা। কবি ওঁরই গানের তলপি বয়ে বেড়ান – গেয়ে ওঠেন ‘গানগুলি মোর শৈবালেরই দল’। ঋতুরাজের আসর জমে ওঠে। মাধবী-মালতীরা বরণ করে ঋতুরাজকে। তারা গেয়ে ওঠে – ‘তোমার বাস কোথা যে পথিক ওগো’। ঋতুরাজ জবাব দেন – ‘আমার বাস কোথা-যে জান নাকি’। সুরের দোলায় আসর জমে ওঠে – ঋতুরাজ, বনপথ, মাধবী-মালতীরা গাইতে থাকেন। যাওয়ার সময় হয়ে আসে ঋতুরাজের। কারণ পূর্ণ থেকে রিক্ত, রিক্ত থেকে পূর্ণ – এরই মধ্যে তাঁর আনাগোনা। ঋতুরাজ গেয়ে ওঠেন – ‘এখন আমার সময় হল,/যাবার দুয়ার খোলো খোলো’। ঋতুরাজের বিদায়বেলায় গান গেয়ে নিজেদের মনের কথা ব্যক্ত করে ‘মাধবী’, ‘ঝুমকোলতা’, ‘আকন্দ’, ‘ধুতুরা’, আর ‘জবা’। ‘প্রলয়গানের মহোৎসবে’ যোগ দেওয়ার ডাক দিয়ে সকলে মিলে গেয়ে ওঠে ‘ওরে পথিক, ওরে প্রেমিক,/বিচ্ছেদে তোর খণ্ড মিলন পূর্ণ হবে’।
শেষ পর্যন্ত মন্ত্রণাসভা ছেড়ে সবাই হাজির পলাতকার পালায়। আর ঋতুরাজ তাঁর রাজবেশ খসিয়ে বৈরাগী হয়ে বেরিয়ে চলেন – সকলে আবার ‘প্রলয়গানের মহোৎসবে’ মেতে ওঠে।
এ দিনের অনুষ্ঠানে ‘বসন্ত’-এর সংগীতসমূহ পরিবেশন করলেন শ্রীনন্দা মল্লিক, শ্রীনন্দা মুখোপাধ্যায়, শাশ্বতী বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীমন্তী মুখোপাধ্যায়, মিতা দে, কেয়া বসু, কুমকুম মজুমদার, পাপিয়া চট্টোপাধ্যায়, সোনালী ঘোষ, পাপিয়া মিত্র, নন্দিতা চক্রবর্তী, প্রবীর ঘোষ, প্রতীম চক্রবর্তী, রমিল মজুমদার, অরুণজ্যোতি দাশগুপ্ত ও অনিরুদ্ধ দে। নৃত্যে ছিলেন পাঠভবনের তিন ছাত্রী প্রতীতি ঘোষ, তানিশা দাশগুপ্ত ও সৃজনী ঘোষ এবং ছাত্র ময়ূখ মজুমদার। তালবাদ্যে ছিলেন গৌতম রায়, কী বোর্ডে দেবাশীষ সাহা।
সে দিনের আবহাওয়া বসন্তের ছিল না। আকাশ মেঘে ভারাক্রান্ত, মাঝেই মাঝেই ঝরে পড়ছে বৃষ্টি। কিন্তু সে দিনের আনন্দে সে বাধা হতে পারেনি। বাইরে মেঘমেদুর আবহাওয়া থাকলেও ঘরে বন্দি করা হল বসন্তকে। এ ভাবেই শ্রোতা-দর্শকদের মননে ‘বসন্ত’ এনে দিল ইন্দিরা। আর সকলের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নিতে শ্রীনন্দা মুখোপাধ্যায় ডাক দিলেন শ্রোতা-দর্শকদের। ফাগ-ফুলে সেজে ‘ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল’ গানের সঙ্গে কণ্ঠ দিয়ে সবাই নাচে-গানে মেতে উঠলেন। সব শেষে সকলকে চা-শিঙাড়া দিয়ে আপ্যায়ন। ওই দিনের অনুষ্ঠানের পূর্ণাঙ্গ সমাপন হল এ ভাবেই।
আরও পড়ুন
সুধীর চক্রবর্তী কথায়, ইন্দিরা দেবীর স্মৃতিতে ‘ইন্দিরা’র নিবেদন ‘দেওয়া নেওয়া ফিরিয়ে দেওয়া’