কলকাতার পথচলতি কত ইতিহাস হেলায় হারিয়ে যায়। সময়সাক্ষ্য পেরিয়ে যার মর্ম হয়তো কোথাও সমগ্রতাকে একটু হলেও স্পর্শ করে। কারণ তার পরিক্রমা আজও যে অব্যাহত। অথচ এ-কালের নগরে সে বড়ো বেমানান। তাকে ধরে রাখার কথা মানুষ কখনও ভাবেনি।
চারিদিক জনশূন্য, দুপুরের রোদে খালি মাথায় ‘ভিস্তিওয়ালা’ চলেছে। এই রোদে মাথা ফেটে যাচ্ছে। তৃষ্ণায় ছাতি ফাটছে। আহার এখনও তার বাকি, তবু এখন জল নিয়ে পৌঁছোনোর সময় গন্তব্যে।
তাপমাত্রা ছুঁতে পারে ৪৫-এর ওপর। এই সময় জল আর অক্সিজেনের খুব প্রয়োজন। অথচ আমরা নির্বিচারে গাছ ধ্বংস করছি। জলের বাড়ছে সংকট। ভাবার সময় এসেছে।

মোঘল যুগেও নাকি ভিস্তিওয়ালারা ছিলেন। বেহেস্ত থেকে ভিস্তি শব্দটা এসেছে। আগেকার দিনে মানুষেরা মনে করতেন যেন স্বর্গ থেকে ঠান্ডা জল বহন করে তারা নিয়ে আসেন। তাদের চামড়ার ব্যাগটিকে বলা হয় মশক। শোনা যায় হুমায়ুনকে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন এক ভিস্তিওয়ালা। তাই নবাব দিল্লির মসনদে সেই ভিস্তিওয়ালাকে একদিনের শাহেনশা বানিয়ে দেন। আজ তাদের আর কেউ সেভাবে মনে রাখে না।
কলকাতার হাওয়ায় তখন কোম্পানির আমল। সাহেব-মেমরা সকালবিকেল জুড়িগাড়ি চেপে পথে ঘুরতে বের হতেন। তার আগেই খুব ভোরে ভিস্তিওয়ালারা নিয়ম করে রাস্তা ধুয়ে দিতেন।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
‘তখন বেগে ছুটিল ঝাঁকে ঝাঁকে,
মশক কাঁধে একুশ লাখ ভিস্তি।
পুকুর বিলে রহিল শুধু পাঁক,
নদীর জলে নাহিকো চলে ভিস্তি।’
আজও টিকে আছে কলকাতায় এই পুরোনো পেশা। জনাকয়েক ভিস্তিওয়ালা শহরের রাস্তায় দেখা যায়। ঘরদোর পরিষ্কার ও নিত্য কাজের জন্য অনেকটা পথ পেরিয়ে ওরা ভালোবেসে মানুষকে একইভাবে জল পৌঁছে দিয়ে চলেছে। আর উপার্জন, সামান্য কিছু টাকা।
চিৎপুর ও দর্ম্মহাটা হাতের তেলোর মতো পরিচিত হলে কোনো একবার লটারির মতো দেখা পেতে পারেন ভিস্তিওয়ালার। খুঁজে পেতে পারেন ওদের একরাশ নৈরাশ্য আর শহরের প্রতি গভীর টান।