অরূপ চক্রবর্তী, গুয়াহাটি: অসম সরকার ১৯৮৩ সালের ভয়াবহ নেলি গণহত্যার তিওয়ারি কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিতেই রাজ্যের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। চার দশক আগে ছয় ঘণ্টার রক্তক্ষয়ী হত্যাযজ্ঞে মরিগাঁও জেলার নেলি ও আশপাশের গ্রামগুলি পরিণত হয়েছিল মৃত্যুকূপে। ২,১০০-রও বেশি মানুষ, যাঁদের অধিকাংশই ছিলেন বাঙালি ভাষাভাষী মুসলমান, সেই ঘটনায় প্রাণ হারান। সেই রক্তাক্ত ইতিহাসের নথি আবার জনসমক্ষে আনতে চলেছে সরকার। আর এই সিদ্ধান্তেই শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক, উদ্বেগ ও তীব্র প্রতিক্রিয়া।
মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সাংবাদিকদের জানান, রাজ্য মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী নভেম্বরে বিধানসভার অধিবেশনে তিওয়ারি কমিশনের প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে। প্রায় ৪০ বছর ধরে গোপন থাকা এই প্রতিবেদনই নেলি হত্যাকাণ্ডের একমাত্র সরকারি তদন্তনথি। ১৯৮৪ সালের মে মাসে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর শইকিয়ার সরকারের কাছে রিপোর্টটি জমা দেওয়া হলেও, তা কখনও প্রকাশ করা হয়নি।
সরকারের এই সিদ্ধান্তকে কেউ কেউ ইতিহাসের ‘স্বচ্ছতা আনার প্রচেষ্টা’ হিসাবে স্বাগত জানিয়েছেন, আবার বিরোধীরা দাবি করেছেন, সরকারের উদ্দেশ্য রাজনৈতিক। তাঁদের অভিযোগ, এই রিপোর্ট প্রকাশের মাধ্যমে সরকার সমাজে নতুন বিভাজনের রাজনীতি উস্কে দিতে চাইছে এবং জনগণের দৃষ্টি অন্য বিষয় থেকে সরাতে চাইছে।
বিরোধী দলনেতা দেবব্রত শইকিয়া বলেন, “এত পুরনো একটি রিপোর্ট এখন প্রকাশ করার প্রয়োজন কী? যখন সমাজের ক্ষত অনেক আগেই শুকিয়ে গিয়েছে, তখন কেন আবার সেই ক্ষত খোঁচানো হবে? এটা কি নির্বাচনের আগে মানুষকে বিভ্রান্ত করার কৌশল?”
দেবব্রতবাবু আরও বলেন, “নেলি এলাকায় এখন সব সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে একসঙ্গে বসবাস করছে। এমন সময়ে এই রিপোর্ট প্রকাশ করলে সেই সম্প্রীতি ও বিশ্বাসের পরিবেশ নষ্ট হতে পারে। জুবিন গার্গের মৃত্যুর পর সব ধর্ম ও জাতির মানুষ এক হয়ে ন্যায়বিচারের দাবিতে এগিয়ে এসেছে। সরকার সেই ঐক্য দেখে অস্থির হয়ে উঠেছে। গার্গের আদর্শ ছিল অসাম্প্রদায়িকতা, আর সেই আদর্শই আজ মানুষের মিলনের প্রতীক।”
মরিগাঁও জেলার অন্তর্গত নেলি ১৬টি গ্রাম নিয়ে গঠিত একটি অঞ্চল। ১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মাত্র ছয় ঘণ্টায়, স্বাধীনোত্তর ভারতের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ঘটে এই অঞ্চলে। স্থানীয় অসমীয়া হিন্দু ও জনজাতীয় সম্প্রদায়ের একাংশ, তৎকালীন রাজনৈতিক উত্তেজনা ও বিদেশি-বিতাড়ন আন্দোলনের আবহে, বাঙালি মুসলিম গ্রামবাসীদের ওপর ভয়ংকর আক্রমণ চালায়। সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ২,১৯১ হলেও, বেসরকারি অনুমানে তা আরও অনেক বেশি।
হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৮৩ সালের ১৪ জুলাই অসম সরকার টি পি তিওয়ারির নেতৃত্বে একটি অনুসন্ধান কমিশন গঠন করে। ৫৫১ পাতার এই রিপোর্টে প্রশাসনিক ব্যর্থতা, গোয়েন্দা তথ্যের প্রতি উদাসীনতা এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত আবেগকেই ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তবু, তৎকালীন সরকার রিপোর্টটি প্রকাশ না করে যুক্তি দিয়েছিল, “এতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ফের মাথাচাড়া দিতে পারে।” কিন্ত চার দশক পরে, ঠিক সেই একই আশঙ্কা আবার ফিরে এসেছে। বিশ্লেষকদের মতে, নেলি হত্যাকাণ্ড অসমের ইতিহাসে এমন এক অধ্যায় যা আলোচনায় এলেই সমাজে উত্তেজনা বাড়ে।
চলচ্চিত্রনির্মাতা পার্থজিৎ বরুয়া, যিনি ‘দ্য নেলি স্টোরি’ নামের পূর্ণ দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, বলেন, “অসম এখন জুবিন গার্গের মৃত্যুশোকে স্তব্ধ। এমন সময়ে এই রিপোর্ট প্রকাশের সিদ্ধান্ত বিস্ময়কর ও হতাশাজনক। সরকারের উচিত ছিল আগে গার্গের মৃত্যুর রহস্য উন্মোচনে মনোযোগ দেওয়া।” তিনি আরও যোগ করেন, “তিওয়ারি রিপোর্ট প্রকাশের ফলে গার্গের মৃত্যুর ন্যায়বিচারের দাবিটি আড়াল হয়ে যেতে পারে। আমার ছবিতে আমি দেখিয়েছি যে, নেলি হত্যাকাণ্ডে শুধু বাঙালি মুসলমান নয়, রাহা অঞ্চলের বহু জনজাতি মানুষও প্রাণ হারিয়েছিলেন—যা সমাজে তেমনভাবে আলোচিত হয়নি।”

গণহত্যার পরে নেলি। ছবি the Assam Tribune ‘X’ থেকে নেওয়া।
নেলি হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশ-বিদেশে বহু গবেষণা হয়েছে। আইআইটি বোম্বের অধ্যাপিকা জাবিন ইয়াসমিন তাঁর গবেষণাপত্র ‘Denying the Animosity: Understanding Narratives of Harmony from the Nellie Massacre, 1983’-এ লিখেছেন, “নেলি হত্যাকাণ্ড স্বাধীনোত্তর ভারতের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যা। এটিকে শুধু ‘massacre’ নয়, বরং ‘genocide’ বলা উচিত, কারণ হামলাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করা।” জাবিনের মতে, “নেলির মানুষ অতীতের দুঃখ ভুলে মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এই রিপোর্ট প্রকাশের ফলে সেই পুরনো ক্ষত আবারও জেগে উঠতে পারে।”
অন্য দিকে, সরকারের পদক্ষেপকে সমর্থন জানিয়েছে অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু, AASU)। সংগঠনের সভাপতি উৎপল শর্মা বলেন, “এত গুরুত্বপূর্ণ একটি নথি এতদিন গোপন রাখা ভুল ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, এত বছরে কেন কোনো সরকার এটি প্রকাশ করল না? জনগণের জানার অধিকার আছে। তবে আমরা নিশ্চিত করব, জুবিন গার্গের ন্যায়বিচারের দাবি এই বিতর্কের আড়ালে চাপা না পড়ে।”
নেলি হত্যাকাণ্ডের পর মোট ৬৮৮টি মামলা দায়ের হয়েছিল, যার মধ্যে ৩১০টির চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। কিন্তু ১৯৮৫ সালের অসম চুক্তি স্বাক্ষরের পর সমস্ত অভিযুক্তকে পুরোপুরি ছাড় দেওয়া হয়, যা এই গণহত্যার বিচারহীনতার এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি সরকার সত্যিই ঐতিহাসিক সত্য উন্মোচনের জন্য রিপোর্টটি প্রকাশ করে, তাহলে তা স্বাগত। কিন্তু যদি এর আড়ালে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে, তবে তা রাজ্যের সম্প্রীতির জন্য বিপজ্জনক হবে।
অসমের সামাজিক কর্মী রাজীব কুমার বলেন, “নেলি হল অসমের আত্মার ওপরে গভীর ক্ষত। ইতিহাস গোপন রাখা যেমন ভুল, তেমনি ভুল সময় ও ভুল উদ্দেশ্যে তা উন্মোচন করাও বিপজ্জনক। জুবিন গার্গের মৃত্যুর পর অসমবাসী একতাবদ্ধ হয়েছে। এমন এক মুহূর্তে নেলি হত্যাকাণ্ডের মতো সংবেদনশীল বিষয় প্রকাশ করা সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে।” শিক্ষাবিদ নীলিমা দত্তের মতে, “নেলি হত্যাকাণ্ড সমাজের বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করে। রিপোর্ট প্রকাশ জরুরি, কিন্তু তা যদি পুনর্মিলন ও সত্য উদ্ঘাটনের উদ্দেশ্যে হয়, তবেই তা ইতিবাচক হবে। যদি রাজনৈতিক স্বার্থে করা হয়, তবে তা নতুন বিভাজন তৈরি করবে।”
সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, তিওয়ারি রিপোর্টে প্রশাসনিক ব্যর্থতার একাধিক উদাহরণ উল্লেখ রয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন আগাম সতর্কতা পেলেও তা উপেক্ষা করে। আক্রমণের সময় সেনা ও পুলিশের প্রতিক্রিয়া ছিল “অত্যন্ত বিলম্বিত ও অপ্রতুল।” রিপোর্টের এই অংশগুলো প্রকাশ পেলে প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হতে পারে। একজন প্রাক্তন আমলা নাম প্রকাশ না করে বলেন, “নেলি হত্যাকাণ্ড শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক হিংসা ছিল না, এটি প্রশাসনিক উদাসীনতা ও রাজনৈতিক অসাড়তার ফল। যদি সরকার সত্যিই রিপোর্ট প্রকাশ করে, তবে সেটি পূর্ণ প্রেক্ষাপটে তুলে ধরা উচিত—শুধু দোষারোপের রাজনীতি নয়।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই সিদ্ধান্তের রাজনৈতিক তাৎপর্যও রয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, জুবিন গার্গের মৃত্যুর পর রাজ্যে যে ঐক্যের আবহ সৃষ্টি হয়েছে, তা ভাঙতেই সরকার এই বিতর্ক উস্কে দিতে চাইছে। যদিও সরকার পক্ষ বলছে, এটি কেবল “ইতিহাসের সত্য প্রকাশের সাহসী পদক্ষেপ।” জুবিন গার্গের মৃত্যুর পর অসমবাসী ধর্ম-বর্ণের বিভাজন ভুলে একত্রিত হয়েছে। সেই অভূতপূর্ব ঐক্যই এখন রাজ্যের শক্তি। কিন্তু এই সময়েই নেলি হত্যাকাণ্ডের মতো স্পর্শকাতর নথি প্রকাশ করা সম্প্রীতির পরিবেশে নতুন অস্থিরতা আনতে পারে—এমন আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকে।
এখন প্রশ্ন একটাই—তিওয়ারি কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ কি সত্যের মুখোমুখি হওয়ার এক সাহসী পদক্ষেপ, নাকি অসম রাজনীতিতে নতুন বিভাজনের খেলা? উত্তর সময়ই দেবে। কিন্তু যে ক্ষত চার দশক ধরে চাপা ছিল, সেটি আবার উন্মুক্ত হলে, সেই বেদনাই হয়তো অসমের সমাজে নতুন দাগ রেখে যাবে।


