Home খবর দেশ জলবায়ু পরিবর্তনে ভয়াবহ বিপর্যয়: শুকিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর জলচক্র, তৈরি হচ্ছে ‘মেগা-ড্রাইং জোন’

জলবায়ু পরিবর্তনে ভয়াবহ বিপর্যয়: শুকিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর জলচক্র, তৈরি হচ্ছে ‘মেগা-ড্রাইং জোন’

water crisis
প্রতীকী ছবি

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে—স্থলভাগ, আকাশ, সাগর এবং এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক উপাদান, জলচক্রেও। উপগ্রহ চিত্র ও দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, পৃথিবী এক ভয়ঙ্কর জলের সংকটের দিকে ধেয়ে চলেছে। গত প্রায় দু’দশকে অভূতপূর্ব হারে হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর স্বাদুজল (freshwater) সম্পদ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে বৃষ্টিপাত, বাষ্পীভবন এবং নদীর প্রবাহের যে স্বাভাবিক গতিপথ ছিল, তা এখন বিপর্যস্ত। এর ফলে বদলে যাচ্ছে স্থলভাগে জলের ভাণ্ডার (Terrestrial Water Storage বা TWS)—যার মধ্যে রয়েছে বরফ, তুষার, নদী-নালা, হ্রদ, মাটির আর্দ্রতা এবং ভূগর্ভস্থ জল।

এই পরিবর্তন শুধু পরিবেশ নয়, মানবসভ্যতার ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। জলসংকটের ফলে হুমকির মুখে পড়ছে খাদ্য নিরাপত্তা, জলাধার নির্ভর অর্থনীতি, বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য। এমনকি এই সংকট আগামী দিনে বাড়িয়ে দিতে পারে জলকেন্দ্রিক দেশীয় ও আন্তঃদেশীয় সংঘাত, এবং জলবায়ু উদ্বাস্তু সংকটের ঝুঁকি।

আরও পড়ুন: বৃষ্টিতে রেকর্ড! গত ৮ বছরে জুলাই মাসে এত বৃষ্টি হয়নি কলকাতায়

 ‘মেগা-ড্রাইং জোন’: কোথায় কতটা বিপর্যয়?

গবেষণা অনুযায়ী, উত্তর গোলার্ধের বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে এখন তৈরি হয়েছে চারটি বিশাল ‘মেগা-ড্রাইং জোন’, অর্থাৎ এমন অঞ্চল যেখানে বৃষ্টি কমে যাচ্ছে, ভূগর্ভস্থ জল কমছে, নদী-নালা শুকিয়ে যাচ্ছে। এই অঞ্চলগুলি হল:

  1. উত্তর কানাডা এবং উত্তর রাশিয়া:
    কিছু বছর আগেও যেসব অঞ্চল তুলনায় আর্দ্র হচ্ছিল, এখন সেগুলিও শুষ্ক হয়ে উঠছে।
  2. উত্তর ও মধ্য আমেরিকা:
    আমেরিকার পশ্চিম উপকূল, দক্ষিণ-পশ্চিম এবং মধ্য আমেরিকায় জলস্তর দ্রুত নামছে। প্রবল খরা গ্রাস করেছে কৃষি নির্ভর অঞ্চলগুলিকে।
  3. আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার সংযুক্ত অঞ্চল:
    উত্তর আফ্রিকা থেকে শুরু করে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া, উত্তর চিন এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল—এগুলি সবই এখন একটানা শুকিয়ে যাচ্ছে।
  4. দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশ:
    অতিরিক্ত গ্রীষ্মপ্রধান এবং অনিয়মিত মৌসুমি বৃষ্টির কারণে একদিকে যেমন বন্যা হচ্ছে, অন্যদিকে দীর্ঘ সময় শুষ্ক অবস্থাও থাকছে।

তবে এই চিত্রের মাঝে কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে—পূর্ব ও পশ্চিম সাব-সাহারান আফ্রিকার কিছু অঞ্চল তুলনায় বেশি আর্দ্র হয়ে উঠেছে। কিন্তু তা পুরো বিশ্বে জলের ভারসাম্য রক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়।

ভূগর্ভস্থ জলে নির্ভরতা বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে সংকট

যতদিন যাচ্ছে, নদী-নালা ও হ্রদ শুকিয়ে যাওয়ায় মানুষ ক্রমশ ভূগর্ভস্থ জলের ওপর নির্ভর হয়ে পড়ছে। কিন্তু এই জলও অপরিমিত উত্তোলনের ফলে দিন দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে। এটি এক দীর্ঘমেয়াদি জলদুষ্প্রাপ্যতার বিপদ ডেকে আনছে, যা আর সহজে পূরণ করা সম্ভব নয়।

এই প্রবণতা শুধু কৃষি বা পানীয় জলের সংকট নয়, ভবিষ্যতের রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং জনসংখ্যা প্রবাহের দিকও বদলে দিতে পারে।

 কেন এটা এত ভয়ানক?

  • জলবায়ুর চক্রের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে:
    স্বাভাবিক জলচক্র—বাষ্পীভবন, বৃষ্টিপাত, প্রবাহ, ভূগর্ভস্থ পুনর্ভরণ—সবই এখন ক্ষতিগ্রস্ত।
  • খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে:
    কৃষিকাজে জলের অভাব মানেই ফসলের ক্ষতি। খাদ্যসঙ্কটের আশঙ্কা বাড়ছে।
  • জলসংকট থেকে সংঘর্ষ:
    বিভিন্ন রাজ্য বা দেশের মধ্যে জলবণ্টন নিয়ে বিবাদ আরও বাড়তে পারে।
  • মানুষের বাস্তুচ্যুতি:
    জল না থাকায় বহু মানুষ নিজের অঞ্চল ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হবে। এতে বাড়বে জলবায়ু উদ্বাস্তু

কোন পথে সমাধান?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই না সচেতন হলে ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকার। তার জন্য জরুরি পদক্ষেপ—

  • ভূগর্ভস্থ জলের সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা
  • বর্ষার জল সংরক্ষণ ও পুনর্ভরণ প্রকল্প
  • জল ব্যবহার ও অপচয় রোধ
  • আর্দ্র অঞ্চল ও জলাভূমির সুরক্ষা
  • আন্তর্জাতিক জলের সম্পদ ভাগাভাগিতে কূটনৈতিক নীতি

জল আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি। কিন্তু এই অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। ‘জল’ নিয়ে যুদ্ধ নয়, বরং প্রয়োজন জলের ব্যবহারে সংহত ব্যবস্থাপনা। জলবায়ু পরিবর্তনের এই ভয়াবহ বার্তা এখনই যদি আমরা না শুনি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পড়ে থাকবে শুধু একটি শুকিয়ে যাওয়া গ্রহ।

সূত্র: ইন্ডিয়া টু ডে

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version