খবর অনলাইন ডেস্ক: দিল্লির বাতাসের গুণমান সূচক (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স, AQI) আবার ‘অতিমাত্রায় বিপজ্জনক’ পর্যায়ে পৌঁছেছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় সূচক ৪০০ ছুঁয়েছে, যা কার্যত প্রতিটি নাগরিককে এক ‘নীরব ধূমপায়ী’-তে পরিণত করছে।
সাবেক এমস (AIIMS) অধিকর্তা ও বর্তমানে মেদান্তা হাসপাতালের ইন্টারনাল মেডিসিন, রেসপিরেটরি ও স্লিপ মেডিসিন বিভাগের প্রধান ড. রণদীপ গুলেরিয়া সতর্ক করেছেন — দিল্লির বাতাস এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে প্রতিদিন শ্বাস নেওয়া মানে কমপক্ষে সাতটি সিগারেট ধূমপান করার সমান।
তিনি বলেছেন, “আমরা সকলে এখন ক্রনিক স্মোকার। এটা আর সিগারেটের ধোঁয়া নয় — এটা সেই বায়ু, যা আমরা নিঃশ্বাসে নিচ্ছি। বিভিন্ন উৎস থেকে আসা দূষণ আমাদের ফুসফুস ও শরীরে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।”
ড. গুলেরিয়ার মতে, সূক্ষ্ম কণিকা (PM2.5 ও তার চেয়েও ক্ষুদ্র কণা) ফুসফুসের গভীরে প্রবেশ করে রক্তে মিশে যায়, যা হৃদরোগ, স্ট্রোক, শ্বাসকষ্ট এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহের কারণ হতে পারে। এই খবর নিউজ১৮ সূত্রে পাওয়া।
দিল্লির একাধিক এলাকায় বাতাসের গুণমান ৪০০ ছাড়াল
দিল্লির বায়ুদূষণ পরিস্থিতি শনিবার মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। রাজধানীর একাধিক অঞ্চলে বাতাসের গুণমান ৪০০–এর ওপরে উঠে গিয়েছে, যা ‘গুরুতর’ (Severe) শ্রেণিতে পড়ে। বিষাক্ত ধোঁয়ায় ঢেকে গিয়েছে পুরো শহর, ফলে দিল্লি পরিণত হয়েছে দেশের অন্যতম দূষিত নগরীতে।
কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের (CPCB) তথ্য অনুযায়ী, শনিবার বিকেল ৪টায় দিল্লির ২৪ ঘণ্টার বাতাসের গড় গুণমান ৩৬১, যা দেশের দ্বিতীয় সর্বাধিক দূষিত শহরে পরিণত করেছে রাজধানীকে। শুক্রবার এই মান ছিল ৩২২।
শহরের ৩৮টি মনিটরিং স্টেশনের মধ্যে একাধিক জায়গায় দূষণের মাত্রা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। ওয়াজিরপুরে বাতাসের গুণমান ছিল ৪২০, বুরারিতে ৪১৮, বিবেক বিহারে ৪১১, নেহরু নগরে ৪০৬, আলিপুরে ৪০৪ এবং আইটিও এলাকায় ৪০২ — সব ক্ষেত্রেই সূচক ‘গুরুতর’ শ্রেণিতে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে সিপিসিবি-র ‘Sameer’ অ্যাপ।
দিল্লির এয়ার কোয়ালিটি আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেমের পূর্বাভাস বলছে, আগামী কয়েকদি নে বায়ুর মানে তেমন কোনও উন্নতি হবে না। বাতাসের গুণমান ‘অত্যন্ত খারাপ’ (Very Poor) পর্যায়েই থাকবে বলে অনুমান। দীপাবলির পর থেকেই দিল্লির বাতাস ‘খারাপ’, ‘অত্যন্ত খারাপ’ ও ‘গুরুতর’— এই তিন স্তরের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।
সিপিসিবি-র মানদণ্ড অনুযায়ী, বাতাসের গুণমান ০–৫০ হলে ‘ভালো’, ৫১–১০০ ‘সন্তোষজনক’, ১০১–২০০ ‘মাঝারি’, ২০১–৩০০ ‘খারাপ’, ৩০১–৪০০ ‘অত্যন্ত খারাপ’ এবং ৪০১–৫০০ ‘গুরুতর’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
শিশু ও গর্ভবতী মহিলারা সবচেয়ে ঝুঁকিতে
ড. রণদীপ গুলেরিয়া বলেন, শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে, কারণ তাদের ফুসফুস এখনও বিকাশমান। দীর্ঘমেয়াদি দূষণ তাদের ফুসফুসের ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং কাশি ও অ্যালার্জির প্রবণতা বাড়ায়।
তিনি অভিভাবকদের পরামর্শ দিয়েছেন, শিশুরা যেন বাইরে না যায় এবং সম্ভব হলে ঘরের ভিতরে বা শ্রেণিকক্ষে থাকে। তিনি এ-ও বলেন, একিউআই (AQI) যদি ‘গুরুতর’ পর্যায়ে যায়, তা হলে অনলাইন ক্লাসে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত স্কুলগুলোর।
গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রেও ঝুঁকি গুরুতর। “উচ্চ দূষণের প্রভাবে গর্ভের ভ্রূণের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, জন্ম ওজন কমে যায়, এমনকি গর্ভপাতও হতে পারে,” তিনি সতর্ক করেন।
‘পালিয়ে নয়, দীর্ঘমেয়াদি সমাধানই দরকার’
দূষণ থেকে সাময়িক মুক্তি পেতে অনেকে শহর ছাড়ার চিন্তা করছেন। তবে ড. গুলেরিয়া মনে করেন, এটি কোনও বাস্তবসম্মত সমাধান নয়।
তিনি বলেন, “দিল্লিতে বছরের ৬০-৭০ শতাংশ দিন বাতাস খারাপ থাকে। তাই আমাদের এখনই একটি সমন্বিত জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন — যেখানে সরকার, নাগরিক, ও শিল্প সবাই যোগ দেবে।” ড. গুলেরিয়া মনে করিয়ে দেন, নব্বইয়ের দশকে সিএনজি চালু করে দিল্লি একবার দূষণ কমাতে পেরেছিল, কিন্তু এখন সেই সাফল্য হারিয়ে গেছে।
দিল্লির নাগরিকদের জন্য ড. গুলেরিয়ার পরামর্শ
(ক) সকালে ও রাতে বাইরে যাওয়া এড়িয়ে চলুন
(খ) ঘরের বাইরে গেলে N95 মাস্ক ব্যবহার করুন
(গ) বাইরে ব্যায়াম করবেন না
(ঘ) পর্যাপ্ত পানি পান করুন
(ঙ) সবুজ শাকসবজি ও ফল খান
(চ) শ্বাসকষ্ট বা বুকে চাপ অনুভব করলে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন
শেষে তিনি সতর্ক করেন, “আমরা যদি এখনই পদক্ষেপ না নিই, এই ‘নীরব ঘাতক’ আমাদের ও আমাদের সন্তানের জীবন ধীরে ধীরে কেড়ে নেবে।”


