বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুস যে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিচ্ছেন, তা স্বীকার করলেও অমর্ত্য সেন মনে করেন, সংকট কাটিয়ে উঠতে এখনও অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে।
বাংলাদেশের সংকট নিয়ে অমর্ত্য সেনের উদ্বেগ
শান্তিনিকেতনে সংবাদ সংস্থা PTI-কে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে অমর্ত্য সেন জানান, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি তাঁকে গভীরভাবে চিন্তিত করেছে। তাঁর মতে, দেশটি এখন এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্য রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি।
“বাংলাদেশের পরিস্থিতি আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করে, কারণ আমার মধ্যে এক শক্তিশালী বাঙালিত্বের বোধ রয়েছে। আমি ঢাকায় অনেক সময় কাটিয়েছি, স্কুলজীবনও শুরু করেছি সেখানেই। ঢাকার পাশাপাশি মানিকগঞ্জ এবং মাতৃকুল বিক্রমপুরের সোনারং এলাকাতেও আমার যাতায়াত ছিল। এসব জায়গার সঙ্গে আমার গভীর আত্মীয়তা রয়েছে। তাই বাংলাদেশের বর্তমান সংকট আমাকে সত্যিই উদ্বিগ্ন করছে,” বলেন অমর্ত্য সেন।
বাংলাদেশের উন্নয়ন ও চ্যালেঞ্জ
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের অগ্রগতির কথা উল্লেখ করে অমর্ত্য সেন জানান, প্রতি ব্যক্তি আয়ের বৃদ্ধি, জন্মহার হ্রাস এবং ভারতের তুলনায় বেশি গড় আয়ু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতির প্রমাণ। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ নারী স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রগতি করেছে, যার কৃতিত্ব শুধু সরকার নয়, BRAC ও গ্রামীণ ব্যাংকের মতো বেসরকারি সংস্থারও।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম এখনও তুলনামূলকভাবে স্বাধীন, যেখানে সরকার-বিরোধী মত প্রকাশ করার সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের সেনাবাহিনী নিয়ে প্রশংসাসূচক মন্তব্য করে তিনি বলেন, “অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনী দখলদারি মনোভাব দেখায়নি। এটি এক ইতিবাচক দিক।”
আওয়ামী লিগ নিষিদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে সতর্ক বার্তা
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রসঙ্গে অমর্ত্য সেন বলেন, আওয়ামী লিগ নিষিদ্ধ করা হলে তা “একই ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে, যা অন্য দলগুলি আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল”। তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশকে দলগত বিভক্তির পরিবর্তে ঐক্যের পথে হাঁটতে হবে। মতপার্থক্য থাকলেও একসঙ্গে কাজ করার ঐতিহ্যই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।”
তিনি আশাবাদী যে ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলি আরও স্বচ্ছ হবে এবং বাংলাদেশ তার গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদকে রক্ষা করতে পারবে।
মহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্ব নিয়ে মন্তব্য
প্রশাসক হিসেবে মহম্মদ ইউনুসের দক্ষতা সম্পর্কে আশাবাদী অমর্ত্য সেন। তিনি বলেন, “ইউনুস আমার বহুদিনের বন্ধু। তিনি অত্যন্ত দক্ষ ও অসাধারণ মানুষ। তিনি বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, “যখন কেউ হঠাৎ করেই একটি দেশের দায়িত্বে আসেন, তখন তাঁকে বিভিন্ন পক্ষের কথা বিবেচনা করতে হয়। বাংলাদেশে ইসলামপন্থী দল যেমন আছে, তেমনই হিন্দু সম্প্রদায়েরও কিছু দাবিদাওয়া রয়েছে। আমি ইউনুসের নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল, কিন্তু তার সামনে কঠিন পথ রয়েছে।”
বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর হামলা নিয়ে ক্ষোভ
বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপর হামলা ও মন্দির ধ্বংসের ঘটনার কড়া সমালোচনা করেছেন অমর্ত্য সেন। তিনি সরকারের পাশাপাশি জনগণেরও দায়িত্ববোধের উপর জোর দেন।
“বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে গর্ব অনুভব করেছে। জামাতের মতো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ইতিহাসও রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি কিছু হামলার ঘটনা ঘটেছে, যা উদ্বেগজনক,” বলেন তিনি।
তিনি ভারতের পরিস্থিতির সঙ্গেও তুলনা করেন, বলেন “ভারতেও সম্প্রতি কিছু মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হিংসা, যে দেশেই হোক না কেন, বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।”
সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি
১৯৪০-এর দশকের দাঙ্গার স্মৃতি তুলে ধরে অমর্ত্য সেন বলেন, “নির্দিষ্ট কিছু ঘটনা বাছাই করে প্রচার করলেই সাম্প্রদায়িকতা বাড়ে। এভাবেই ১৯৪০-এর দশকের দাঙ্গা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে পরিণত হয়েছিল। অতীতের ভুল থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। গুজব ও পক্ষপাতদুষ্ট প্রচার বিপজ্জনক।”
বাংলাদেশের সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে দেশটি গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বহুত্ববাদকে রক্ষা করতে পারবে। অমর্ত্য সেনের মতে, সংকটের সমাধান সম্ভব, তবে তার জন্য সহনশীলতা ও ঐক্যের প্রয়োজন।