মঙ্গলবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় পাশ হওয়া অপরাজিতা মহিলা ও শিশু (পশ্চিমবঙ্গ অপরাধ আইন সংশোধনী বিল, ২০২৪) ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এই বিলটি ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডকে বাধ্যতামূলক করার কারণে আইনি বিশেষজ্ঞ, সমাজকর্মী এবং মানবাধিকার কর্মীদের সমালোচনার মুখে পড়েছে।
বিলটি ভারতে সদ্য প্রণীত ভারতীয় ন্যায় সনহিতা (বিএনএস) এর সংশোধনী হিসাবে আনা হয়েছে, যা ভারতের নতুন দণ্ডবিধি হিসেবে পরিচিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংশোধনীতে ধর্ষণের জন্য শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা অসাংবিধানিক এবং মানবাধিকারের পরিপন্থী।
শনিবার বাংলার একদল নারী, যাঁদের মধ্যে সমাজকর্মী, আইনি বিশেষজ্ঞ এবং মানবাধিকার কর্মী রয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন, যেখানে তাঁরা এই বিলের বিভিন্ন ধারা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এই চিঠিটি সামাজিক মাধ্যমে বাংলায় ও ইংরেজিতে পোস্ট করা হয়েছে এবং এটি বিলের বিভিন্ন দিক নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছে। বিশেষত, ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বাধ্যতামূলক উল্লেখ নিয়ে তাঁরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
মৃত্যুদণ্ডের বাধ্যতামূলক বিধান অসাংবিধানিক
আইনজীবী কৌশিক গুপ্ত বলেছেন, “বিলটি অসাংবিধানিক। কোনো অপরাধের শাস্তি হিসেবে শুধুমাত্র মৃত্যুদণ্ড রাখা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরিপন্থী। ১৯৮৩ সালে মিঠু বনাম স্টেট অফ পাঞ্জাব মামলায় সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ এই রায় দিয়েছিল যে, অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড বাধ্যতামূলক হতে পারে না। এটি আইনের মৌলিক নীতি এবং সংবিধানের মূল নীতির পরিপন্থী।”
তিনি আরও বলেন, “রাজ্য সরকার সম্ভবত RG Kar মেডিকেল কলেজের সাম্প্রতিক ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু এটি কেবল একটি প্রতিক্রিয়াশীল বিল, যা মহিলাদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পূর্ববর্তী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।”
চিঠির লেখকরা উল্লেখ করেছেন যে, “মৃত্যুদণ্ডকে শাস্তি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার ফলে বিচারপ্রক্রিয়ায় আরও জটিলতা সৃষ্টি হবে। বরং, সরকার ধর্ষণ প্রতিরোধের উপর বেশি জোর দিতে পারত, যার মাধ্যমে নারীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ গঠন করা যেত।”
গুরুতর শাস্তি, কম দোষী সাব্যস্তের হার
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, “এই বিল-এর নামে ‘অপরাজিতা’ শব্দটির প্রয়োগ অসঙ্গত। ধর্ষণ, অ্যাসিড আক্রমণ, হত্যা বা অন্যান্য জঘন্য অপরাধের প্রেক্ষিতে কোনও কাব্যিক শব্দের প্রয়োগ হিংসাকে লঘু করে দেখাতে পারে। আইনের নামকরণের একটি সর্বজনগ্রাহ্য প্রথা রয়েছে। তা থেকে রাজ্য সরকারের অকারণ এবং অসঙ্গত বিচ্যুতিতে আমরা অসন্তুষ্ট। “
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, “এই বিল-এ ধর্ষণ ও হত্যার (অথবা আঘাতের ফলে চেতনা হারিয়ে জড় অবস্থায় চলে যাওয়ার) একমাত্র শাস্তি নির্ধারিত হয়েছে প্রাণদণ্ড ও জরিমানা। এটা অসাংবিধানিক। সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ ১৯৮৩ সালের একটি রায়ে বলেছে যে, কোনও অপরাধের ক্ষেত্রেই ফাঁসি একমাত্র সাজা হতে পারে না। তাই আমরা বিস্মিত।”
বিশেষ আদালত এবং টাস্ক ফোর্স নিয়ে সংশয়
বিলটিতে যৌন অপরাধের ক্ষেত্রে বিশেষ আদালত এবং বিশেষ টাস্ক ফোর্স গঠনের কথা বলা হয়েছে। তবে মহিলাদের এই দলটি সংশয় প্রকাশ করেছে যে, যদি এই নতুন সংস্থাগুলি গঠন করা হয়, তবে সঠিক পরিকাঠামো, কর্মীসংখ্যা এবং অর্থায়নের অভাবে এগুলি কার্যকর হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
“এক তরুণী চিকিৎসকের নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যায় যখন জনসমাজ ক্রোধ ও শোকে উত্তাল, সেই অস্থির সময়ে, মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে এই বিল পাশ করা হল। যে কোনও আইন পাশ করার আগে তার খসড়া প্রকাশ করা, নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনা করার দীর্ঘ প্রথা চলে আসছে। রাজ্য সরকার তা করেনি, যা অগণতান্ত্রিক। এতে আমরা আশাহত।,” চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
LGBTQ+ সম্প্রদায়ের অধিকারের অবহেলা
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিলটি লিঙ্গ সংক্রান্ত অপরাধগুলিতে শুধুমাত্র নারীদের কথা উল্লেখ করেছে এবং ট্রান্সজেন্ডার বা কুইয়ার সম্প্রদায়ের কথা একেবারেই উল্লেখ করা হয়নি। এটি একটি বড় ফাঁক হিসেবে দেখা হচ্ছে, কারণ বিএনএসও এই সম্প্রদায়ের উপর যৌন নির্যাতন সম্পর্কে নীরব রয়েছে।
“এটি একটি গভীর বদ্ধমূল পক্ষপাতিত্বের প্রতিফলন, যেখানে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বৈষম্য রয়েছে। সম্প্রতি বেশ কিছু আদালতের রায়ে ট্রান্সওমেনদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু আইনি সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও, এই বিলটি তাদের প্রতি প্রয়োগযোগ্যতার কথা উল্লেখ না করে বৈষম্যকে জিইয়ে রেখেছে,” বলেন সমাজকর্মী অনিন্দ্য হাজরা।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারপার্সন আকার প্যাটেলও এই বিলটির সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, “মৃত্যুদণ্ড কোনো সমস্যার সমাধান নয় এবং এটি মহিলাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধের কোনো দ্রুত সমাধান হতে পারে না।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, “২০১২ সালে গঠিত বিচার বিভাগীয় কমিটি, যা ধর্ষণ সম্পর্কিত আইন সংস্কারের জন্য গঠিত হয়েছিল, তারা ধর্ষণের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করেছে। তাদের সুপারিশগুলির মধ্যে পুলিশি প্রশিক্ষণ, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং যৌন সহিংসতার অভিযোগের তদন্তের প্রক্রিয়া উন্নত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, যা দীর্ঘমেয়াদে নারীদের জন্য ভারতকে নিরাপদ করতে পারে।”